প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট দেশে রূপান্তরের যাত্রা মসৃণ করতে বিনিয়োগের জন্য বিশ্বের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আপনারা আসুন, বিনিয়োগ করুন। বাংলাদেশ সব সময় প্রস্তুত আপনাদের আগমনের জন্য। বাংলাদেশকে নিজের দেশ মনে করেই বিনিয়োগ করুন।’
গত শনিবার সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে তিন দিনব্যাপী ‘বাংলাদেশ বিজনেস সামিট ২০২৩’ উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান।
সম্মেলনে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ী নেতাদের স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উচ্চ আয়ের উন্নত, সমৃদ্ধ এবং উদ্ভাবনী স্মার্ট দেশ হিসেবে বিনির্মাণের জন্য আমাদের অভিযাত্রায় যুক্ত হওয়ার জন্য আমি আপনাদের উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।’
এ সময় ব্যবসায়ীদের দ্রব্যমূল্য কমানোর উপায় খুঁজতে বলেন প্রধানমন্ত্রী, অন্যথায় তাঁরা নিজেরাই নিজেদের বাজার হারাবেন বলে সতর্ক করেন। তিনি বলেন, কভিড–১৯–এর অভিঘাত, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বাণিজ্যিক অবরোধ ও পাল্টা অবরোধ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নকামী দেশগুলোকে কঠিন সমস্যার মুখোমুখি করেছে। উন্নত দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধিসহ মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। তাদের কথা বিবেচনা করে ব্যবসায়ী নেতাদের জিনিসপত্রের দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসার উপায় খুঁজে বের করতে হবে এবং সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে নিজেরা নিজেদের বাজার হারাবেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং স্থানীয় বেসরকারি বিনিয়োগ উভয়ের জন্য ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এখন দেশের জাতীয় ব্যবসায়িক পরিবেশ কর্মসূচি ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট ইমপ্রুভমেন্ট প্রোগ্রাম’ (বিআইসিআইপি) বাস্তবায়ন করছে। এর আওতায় আগামী ৫০ সপ্তাহে ৫০টি সংস্কার এবং আগামী তিন বছরে ১০০টি বিনিয়োগ পরিবেশ সংস্কার করা হবে। তিনি বলেন, ‘যেন ওই লাল ফিতার দৌরাত্ম্য না থাকে, সেটা সরিয়ে দেওয়া হবে। সিদ্ধান্ত হবে, সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবায়ন হবে।’
সরকার প্রধান বলেন, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ আমাদের দেশের জন্য একই সঙ্গে অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করবে। আবার অনেক চ্যালেঞ্জও আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, আমরা কঠোর বাণিজ্য প্রতিযোগিতাসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সক্ষমতাও অর্জন করব। আমি দেশের ব্যবসায়ী সমপ্রদায়কে এসব সুযোগ কাজে লাগাতে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। উত্তরণ–পরবর্তী পরিবেশে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার ব্যবসায়ীদের সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাবে বলেও কথা দেন তিনি।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নিজ অবস্থান করে নিয়েছে। ফলে বিদেশী বিনিয়োগের জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিশেষ ইউটিলিটি সার্ভিস দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিনিয়োগ বান্ধব আইন বা নীতিমালা করা হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের প্রতিযোগিতামূলক প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ জ্বালানি অবকাঠামোর বিস্তার করা হয়েছে। বিভিন্ন সেবা–পরিসেবা প্রদানে ওয়ান– স্টপ সার্ভিসও চালু করা হয়েছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বান খুবই গুরুত্ব বহন করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য গত বছর শুরু হয়েছিল অস্থিতিশীলতায়। কভিড–পরবর্তী পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে জ্বালানি পণ্যের বাজারদর ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যেই গোটা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের আলোড়ন তৈরি করে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের সূত্রপাত। এ আলোড়নের আঘাত এসে পড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। এরই প্রভাব পড়েছে বিদেশী বিনিয়োগের ওপরও।
সমপ্রতি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রকাশিত বিনিয়োগের পরিবেশ সংক্রান্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সীমিত অর্থায়নের সুযোগের মতো বেশ কিছু কারণ বড় বাধা সৃষ্টি করছে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ সরকার বলছে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থাকলেও সেগুলো সমাধানের চেষ্টা হচ্ছে এবং বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। বিশ্লেষকরা বলেন, বিদ্যুৎ, গ্যাস বা পানিসহ যেসব সেবা পাওয়ার কথা, সেগুলো সরবরাহের ক্ষেত্রে যে সমস্যা আছে, তার সুরাহা হলে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে নিঃসন্দেহে। তাঁরা বলেন, ‘নানা বাধা পেরিয়ে অনেক বিদেশী বিনিয়োগকারী নিবন্ধন করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের কম সংখ্যকই বিনিয়োগ করে থাকেন। বলা যায়, বাংলাদেশে যা নিবন্ধন হয়, তার এক তৃতীয়াংশও কার্যকরভাবে বিদেশী বিনিয়োগ হয় না।’ এ ক্ষেত্রে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে।
আনন্দের বিষয়, বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ অব্যাহত রেখেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে সুবিধাজনক অবস্থানটি হলো অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি বাড়ছে। কারণ জনসংখ্যা বেশি। ফলে নিকট ভবিষ্যতে বিনিয়োগ নিয়ে সবাই আশাবাদী।