বসন্ত এসে গেছে

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৮:৪১ পূর্বাহ্ণ

আজ হোক না রঙ ফ্যাকাসে/ তোমার আমার আকাশে/ চাঁদের হাসি যতোই হোক না ক্লান্ত,/ বৃষ্টি নামুক নাই বা নামুক/ ঝড় উঠুক নাই বা উঠুক/ ফুল ফুটুক নাই বা ফুটুক আজই বসন্ত।
আজ ফাল্গুনের ১ তারিখ, ঋতুরাজ বসন্তের আগমনী দিন। বসন্তের আগমন নীরবে নিভৃতে হওয়ার জন্য নয়, তাকে বরণ করে নিতে হয়। এই প্রকৃতি যেমন তার সবটুকু দিয়ে অর্ঘ্য সাজিয়েছে, তেমনি নগরবাসীও বসন্তকে বরণ করে নেবে আপন রঙে।
শীতের খোলস ছেড়ে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নাগলিঙ্গম এখন কোনো অলৌকিক স্পর্শে জেগে উঠেছে। পলাশ আর শিমুল গাছে লেগেছে আগুনের ছোঁয়া। প্রকৃতিতে মধুর বসন্তে সাজ সাজ রব। তাই তো প্রকৃতির সাজের সঙ্গে গুণ গুণ করে গেয়ে উঠছে মন, ‘আহা আজি এ বসন্তে… কিংবা মনেতে ফাগুন এলো…। পহেলা ফাল্গুনে আনুষ্ঠানিকভাবে মর্ত্যলোকে অভিষেক ঘটে ঋতুরাজের আর তাকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতি নেয় এক বর্ণিল সাজ। গাছে গাছে জাগে নতুন পাতা, নতুন ফুলের সমারোহ। সবাই যেন মত্ত শীতের শুষ্কতাকে প্রাণপণে আড়াল করার চেষ্টায় থাকে।
প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি জাঁকজমকভাবে পালিত হয় বসন্ত উৎসব। এবার করোনার ছোবলে বসন্তকে সম্ভাষণ জানানোয় হয়তো বর্ণাঢ্য আয়োজন থাকবে না। কিন্তু প্রাণের তাগিদ এতটুকু কম হবে না। পহেলা বৈশাখের পর এটি যেন বাঙালির দ্বিতীয় প্রাণের উৎসব। এ দিনটিতে প্রকৃতির সাথে সাথে বাসন্তি সাজে সেজে ওঠে বাংলার মানুষ। আর শুধু এই বাংলায় নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খন্ড ও উড়িষ্যাসহ অন্যান্য রাজ্যেও দিনটি বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হবে।
ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করে নিতে সিআরবির শিরীষতলা, থিয়েটার ইনস্টিটিউট, পাহাড়তলী আমবাগান শেখ রাসেল পার্কসহ বিভিন্ন স্থানে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। বাংলার চিরায়ত গান, নাচ, আবৃত্তি, কথামালাসহ নানা আয়োজনে শুরু থেকেই মুখর হবে উৎসব অঙ্গন। আজ বসন্তের প্রথম দিনটি ভালোবাসা দিবসও। তাই আনন্দ আয়োজনেও ভিন্নমাত্রা থাকাটাই স্বাভাবিক।
বাংলার প্রকৃতি, ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বড় স্থান দখল করে আছে বসন্ত। প্রাচীন আমল থেকেই এদেশে পহেলা ফাল্গুন পালন করা হতো। হিন্দুদের পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলোতে এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় থেকেই শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালন করার রীতি চলে আসছে। ১৪০১ বঙ্গাব্দে এদেশে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ পালিত হয়।
বসন্ত এলে প্রাণের তাগিদে প্রাণের মানুষকে খুঁজে ফিরে সবাই। মনে রং, বনে রং, সকলেই যেন রঙের মানুষ, রঙিলা বাতাসে ওড়ায় অন্তরের ফানুস। বসন্ত মানেই যৌবন-কথা। বসন্ত মানে সৃজন, জাগরণ আর উদ্বোধন। আমাদের প্রাণের ভেতরে যে আরেকটি প্রাণ আছে, জীবনের ভেতরে যে আরেকটি জীবন আছে, আত্মার গহীনে যে রূপ-অরূপের আকাক্সক্ষা আছে, জীবন ও প্রকৃতির সমান্তরালে তাকে অনুভব ও উৎসরণের নামই বসন্ত। আমাদের কথার ভেতরে কিছু কথা আছে, কথার অন্তরালে কিছু সূক্ষ্ম বার্তা আছে। প্রাত্যহিকের যাপিত গদ্যের ছায়ায় অদৃশ্য সুর ও গান আছে। সীমাবদ্ধ বাঁধনের তারে অসীমের তরঙ্গ স্পর্শ আছে। এই অদৃশ্য তরঙ্গের স্পন্দন, জীবনের দোলা, বাণী আর সুরের মূর্চ্ছনায়, রূপে-রসে, মনে ও প্রকৃতিতে জমে উঠে মায়ার খেলা, প্রাণের খেলা। যার কান আছে সে শোনে, যার চোখ আছে সে দেখে এবং যার হৃদয় আছে সে টের পায় কেউ আসছে, কেউ জেগে উঠছে।
কে সে? কার এই জাগরণ? সীমার ভেতরে অসীমের মূর্তিতে কার এই সম্ভোগ অভিসার? কার এই নীরব জিকির, গোপন আহ্বান? দেহে-মনে পুলকে, শিহরণে, বোধে-মননে এই আহ্বানকে স্পর্শ করার যে ইচ্ছা, বাঙালি তারই তো নাম রেখেছে বসন্ত। আর প্রকৃতির বসন্তকে জীবনের লৌকিক ও আত্মিক আনন্দের গভীরতম স্পর্শে-অনুরাগে, রূপলোকের প্রতিমার ছোঁয়ায় শিহরিত-স্পন্দিত করার মনন আয়োজনের নামই বসন্ত উৎসব। বাঙালি আদি ও অকৃত্রিম হৃদয় ছোঁয়ায় বরণ করতে প্রস্তুত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘যত প্রভাবশালী হোক খাল উদ্ধার করব’
পরবর্তী নিবন্ধআগেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে