বঙ্গবন্ধু টানেল : স্বপ্ন যখন ধরা দিচ্ছে হাতের মুঠোয়

হাসান আকবর | রবিবার , ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ

কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে ঘণ্টায় ৮০কিলোমিটার বেগে ছুটবে গাড়ি। এটি এখন আর স্বপ্ন নয়, সময়ের ব্যাপারমাত্র। আগামী বছরই চালু হচ্ছে কর্ণফুলীর তলদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। দেশের প্রথম এই টানেল দিয়ে বছরে ১ কোটি ৪০ লাখ গাড়ি চলাচল করবে। চেহারা পাল্টে যাবে কর্ণফুলীর অপরপাড়সহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের। বহুল প্রত্যাশার এই টানেলের কাজ ইতোমধ্যে প্রায় ৭২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, চীনের সাংহাই শহরের আদলে চট্টগ্রামকেও ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে গড়ে তোলা, দক্ষিণ চট্টগ্রামের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়া, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ের বিস্তৃত জনপদকে শহরের মূল স্রোতে নিয়ে আসাসহ বিভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। কঙবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিস্তৃত এলাকার আবাসন, শিল্পায়ন এবং পর্যটনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার লক্ষেই মূলতঃ প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকার এই টানেল নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কয়েক বছর ধরে প্রকল্পটির নানা কার্যক্রম চলে। চীন এই প্রকল্পের অর্থায়নসহ নানা ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর যৌথভাবে এই টানেল নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনা রাষ্ট্রপতি শিং জিনপিং। চীনা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) টানেলটি নির্মাণ করছে। ২০১৬ সালে যৌথভাবে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলেও কার্যতঃ টানেল নির্মাণ শুরু হয় ২০১৯ সালে। ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মূল টানেল ছাড়াও পতেঙ্গা ও আনোয়ারা প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার একটি ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে। চার লেনের টানেলটিতে সামন্তরালভাবে দুইটি টিউব থাকবে। এর একটি দিয়ে শহর থেকে আনোয়ারামুখী গাড়ি যাবে এবং অপরটি দিয়ে আনোয়ারা থেকে শহরমুখী গাড়ি আসবে। ইতোমধ্যে টানেলটির একটি টিউবের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়েছে। ওই টানেলটিতে রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। অপর টিউবটি খননের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। একটি টিউব ১০ দশমিক ৮ মিটার বা ৩৫ ফুট চওড়া এবং উচ্চতায় হবে ৪ দশমিক ৮ মিটার বা প্রায় ১৬ ফুট। টিউব দুইটি কর্ণফুলী নদীর তলদেশের ১৮ মিটার বা ৬০ ফুট থেকে ৩১ মিটার বা ১০১ ফুট গভীরে খনন করা হয়েছে। এই টানেল জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে না।
কর্ণফুলীর তলদেশে দেশের প্রথম টানেল নির্মাণের কার্যক্রম করোনাকালে কিছুটা থমকে গিয়েছিল। চীনে করোনার প্রকোপ দেখা দেয়ার পর থেকে হোঁচড খেয়েছিল দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের কার্যক্রম। চীনে গিয়ে আটকা পড়েছিলেন টানেল নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীসহ অনেকেই।
আবার চীনের যে কারখানায় সেগমেন্ট তৈরি হচ্ছিল সেটিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। টানেলের শক্ত পদয়াল হিসেবে ২০ হাজারের বেশি সেগমেন্ট স্থাপন করা হচ্ছে দুইটি টিউবে। চীনের জিয়াংসু প্রদেশের জিংজিয়ান শহরে টানেলের সেগমেন্টগুলো তৈরি হচ্ছে। ওখান থেকে তৈরি সেগমেন্ট জাহাজে বোঝাই করে এনে কর্ণফুলীর তলদেশে স্থাপন করে টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। ৮টি সেগমেন্টে দুই মিটারের একটি রিং তৈরি করে। এভাবে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ মিটার করে টানেল নির্মাণের কাজ চলে। এভাবে প্রতিদিনই একটু একটু করে স্বপ্ন ছোঁয়ার কাজ চলছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরের ডিসেম্বরে এই টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করবে। করোনাকাল টানেল নির্মাণের ক্ষেত্রে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলেও প্রকল্পটি খুব বেশি পিছিয়ে নেই। বর্তমান গতিতে কাজ করতে পারলে নির্দিষ্ট সময়েই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণের ব্যাপারে পরিচালিত একটি সমীক্ষা উদ্ধৃতি করে সূত্র বলেছে, এই টানেল দিয়ে বছরে ১ কোটি ৪০ লাখ গাড়ি চলাচল করবে। এসব গাড়ির প্রায় ৫১ শতাংশ কন্টেনারবাহী ট্রেইলর এবং বিভিন্ন ধরনের পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান। বাকি ৪৯ শতাংশের মধ্যে ১৩ লাখ বাস, মিনিবাস ও মাইক্রোবাস এবং ১২ লাখ কার, জিপ ও বিভিন্ন ধরনের ছোটগাড়ি। এই বিপুল সংখ্যক গাড়ির চলাচল নির্ঝঞ্ঝাট করতে সর্বোচ্চ মাননিয়ন্ত্রণ করেই টানেলটি নির্মাণ করা হচ্ছে বলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে।
টানেলটি নির্মিত হলে শুধু দক্ষিণ চট্টগ্রামেরই নয়, পুরো চট্টগ্রামের গাড়ি চলাচলের ক্ষেত্রেও একটি বিপ্লব ঘটে যাবে। বিশেষ করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা কঙবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী বিপুল সংখ্যক গাড়ি শহরের ভিতরে প্রবেশ না করেই ফৌজদারহাট এবং বিপরীত দিকের গাড়ি নদীর অপর পাড়ের আনোয়ারা থেকে কর্ণফুলীর তলদেশের টানেল হয়ে আউটার রিং রোড ধরে চলাচল করতে পারবে। এতে শহরের উপর গাড়ির চাপ বহুলাংশে কমে যাবে।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিস্তৃত এলাকার যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার ফলে আবাসন এবং পর্যটন খাতের উপরও এই টানেল একটি ইতিবাচক আবহ তৈরি করবে। দক্ষিণ চট্টগ্রামে আবাসিক এলাকা গড়ে উঠার পাশাপাশি শিল্পায়নেরও বড় সুযোগ তৈরি হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার হারুনুর রশিদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত এই মেগা প্রকল্পের কাজ ইতোমধ্যে প্রায় ৭২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিতর দিয়ে গাড়ি চলাচল করবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধট্রেন যাচ্ছে কক্সবাজার : স্বপ্নের আরেক বাস্তবায়ন
পরবর্তী নিবন্ধলোকনাথ সেবাসংঘ সমন্বয় পরিষদের কেন্দ্রীয় সম্মেলন