ট্রেন যাচ্ছে কক্সবাজার : স্বপ্নের আরেক বাস্তবায়ন

শুকলাল দাশ | রবিবার , ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইন। দিনদিন বদলে যাচ্ছে চিত্র, দ্রুত দৃশ্যমান হয়ে উঠছে বহুল প্রতীক্ষিত এই প্রকল্পের কাজ। সমান তালে চলছে লাইন, ছোট-বড় সেতু, কালভার্ট, লেভেল ক্রসিংসহ স্টেশন নির্মাণের কাজ।
দীর্ঘদিনের স্বপ্ন আজ বাস্তবের দ্বারপ্রান্তে এসে কড়া নাড়ছে। এই আঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্নের ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইন’ এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবের হাতছানি। এই পর্যন্ত মোট প্রকল্পের ৬১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক।
এরই মধ্যে কক্সবাজার অংশে দুই কিলোমিটার রেল ট্র্যাক বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। একই সঙ্গে আইকনিক স্টেশন, ছোট-বড় সেতু, কালভার্ট, লেভেল ক্রসিং ও হাইওয়ে ক্রসিংয়ের নির্মাণকাজও এগিয়ে চলছে। অবশিষ্ট ৩৯ শতাংশ কাজ শেষ হলেই চট্টগ্রাম থেকে বহুল কাঙ্খিত ট্রেন যাবে কক্সবাজার। ট্রেন চলবে ঘন্টায় ১০০কিলোমিটার গতিতে।
কাজের অগ্রগতি প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইনের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. মফিজুর রহমান আজাদীকে জানান, ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৬১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আমরা নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করার টার্গেট নিয়েছিলাম কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতাসহ নানান কারণে সময় অনেক অপচয় হয়েছে। করোনায় অনেক ক্ষতি হয়েছে। চীনা প্রকৌশলীরা করোনার কারণে ঠিক সময়ে দেশে আসতে পারেননি। একই কারণে প্রকল্পের জিনিসপত্রও ঠিক সময়ে আসতে পারেনি। এখনো প্রকল্প এলাকা থেকে পিজিসিবি, বিপিডিবি ও বিআরইবির তাদের খুঁটি ও টাওয়ার সরাইনি। এগুলোর কারণে কাজ কিছুটা বাকি রয়ে গেছে। এসব কারণে আমরা প্রকল্পের মেয়াদ ২ বছর বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব করেছি। ২ বছর বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব করলেও ১ বছর হলে হয়ে যাবে। তারপরও এক বছর হাতে রেখেছি।
প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হলেও প্রকল্প ব্যয় বাড়বেনা বলে জানান তিনি। মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাবটি অনুমোদন পেলে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। এখন পুরোদমে কাজ চলছে বলে জানিয়ে প্রকৌশলী মো. মফিজুর রহমান বলেন, এখন এক সাথে ছোট-বড় কালভার্ড, ব্রিজ এবং লাইনের কাজ, লেভেল ক্রসিং ও হাইওয়ে ক্রসিংয়ের নির্মাণকাজও এগিয়ে চলছে।
প্রকল্প পরিচালক সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেল লাইনের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে চট্টগ্রাম-থেকে রামু-কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় পর্যায়ে ঘুনধুম পর্যন্ত বাকি ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে।
দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি আইকনিক ষ্টেশন (কক্সবাজার সদর)সহ মোট ৯টি ষ্টেশন হচ্ছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. মফিজুর রহমান। ষ্টেশন গুলো হলো-দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজরা, ইসলামাবাদ (ঈদগাও), রামু ও কক্সবাজার এছাড়াও রয়েছে চারটি বড়, ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বক্স কালভার্ট, ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট। এর বাইরে সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে তিনটি বড় সেতু। রেললাইনে থাকবে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যাল সিস্টেম এবং ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম।
এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হচ্ছে। এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ হলে কক্সবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আসবে।
এই লক্ষ্যে রেল মন্ত্রণালয় চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার পুরনো রেল লাইন সংস্কারেরও উদ্যোগ নিয়েছে। পুরনো কালুরঘাট সেতু বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে আবার সংস্কার করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে আরো দুই বছর: বহুল কাঙ্ক্ষিত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্পের মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতাসহ করোনার কারনে চীনা প্রকৌশলীরা সঠিক সময়ে দেশে না আসায় এবং বিদ্যুতের খুঁটি স্থানান্তর কাজ শেষ না হওয়ায় কাজে বিলম্ব হয়েছে। এসব কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আবেদন করেছেন প্রকল্প পরিচালক। চলমান প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত। ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকার এ মেগা প্রকল্পের ব্যয় না বাড়িয়ে দ্বিতীয় দফায় আরো দুই বছর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছে প্রকল্প পরিচালক। আবেদনটি রেলমন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। রেলমন্ত্রণালয় থেকে আবেদনটি পরিকল্পনা কমিশনে যাবে। পরিকল্পনা কমিশন থেকে মেয়াদ বাড়ানোর সেই আবেদনের অনুমোদন হয়ে আসতে সময় লাগবে বলে জানা গেছে। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা, করোনার প্রকোপে কাজের গতি থেমে যাওয়া এবং বিদ্যুতের টাওয়ার স্থানান্তর না হওয়াসহ ৫টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রথমে ২০১০ সালে নেওয়া এ প্রকল্পটির কাজ ২০১৩ সালে শেষ করার কথা ছিল। তবে ২০১৬ সালে প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। সে সময় প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ধরা হয়। ২০২২ সালের আগেই দ্বিতীয় দফা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হয়েছে।
কালুরঘাট সেতু মেরামতের উদ্যোগ : রেল কর্তৃপক্ষ কালুরঘাট বিদ্যমান সেতুটি মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছেন। পরমার্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট)। বুয়েটের বিশেষজ্ঞ টিম গত ৩ সেপ্টেম্বর সেতু এলাকায় গিয়ে সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। এই বিশেষজ্ঞ টিমের পরামর্শ অনুযায়ী সেতুটি মেরামত করা হবে বলে জানান রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ব্রিজ) আহসান জাবির।
রেল ভবনের একটি সূত্র জানায়, কালুরঘাট নতুন সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হতে আরো অনেক সময় লাগবে। কবে নাগাদ সেতুর কাজ শুরু হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। অর্থের যোগান না হওয়ায় এখনো প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়নি। টেন্ডার হয়নি। এখনো অনেক কাজ বাকি। আবার নতুন করে ডিজাইন করতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ফান্ডের বিষয়টি এখনো আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। তাই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার রুটে ট্রেন চলাচলের জন্য কালুরঘাট বিদ্যমান সেতুটি আবারও মেরামত করা হচ্ছে।
এজন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারস্থ হয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। বিদ্যমান পুরনো সেতুটি মেরামতের জন্য বুয়েটকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাওয়ার জন্য আবেদন করলে তাতে বুয়েট সাড়া দেয়। এরই প্রেক্ষিতে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল সরেজমিনে কালুরঘাট সেতু পরিদর্শনে আসেন।
এই ব্যাপারে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ব্রিজ) আহসান জাবির আজাদীকে জানান, বুয়েটের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এক দেড় মাসের মধ্যে রিপোর্ট দেবে। ওরা যেভাবে পরামর্শ দেবে-সেই ভাবে এগুবো। তাদের পরামর্শের উপর ভিত্তি করে আমরা টেন্ডার আহবান করবো। তারপর কাজ শুরু করবো। করোনার কারণে আমাদের কাজের কিছুটা বিঘ্ন ঘটেছে। বুয়েট এতোদিন কাজ শুরু করতে পারেনি।
এদিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইনের কাজ ২০২২ সালের শেষের দিকে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পের মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। এতো দিন বারবার বলা হয়েছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজারে ট্রেন ভ্রমণ করা যাবে। কিন্তু বর্তমান কাজের গতিতে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ হবে না বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা নিজেরাই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আবেদন করেছেন। এই প্রস্তাব অনুযায়ী ২০২৪ সালে রেল লাইন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। এখন স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্য থেকে প্রশ্ন উঠেছে ২০২৪ সালের মধ্যে কালুরঘাট নতুন সেতু নির্মাণ হবে কিনা। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইনের মেয়াদ যখন বেড়েছে- সুতরাং অর্থের সংস্থান হলে এই সময়ের মধ্যে অবশ্যই কালুরঘাট নতুন সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রকৌশল বিভাগের এক প্রকৌশলী কর্মকর্তা।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে গ্যাস সংকট ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু টানেল : স্বপ্ন যখন ধরা দিচ্ছে হাতের মুঠোয়