বঙ্গবন্ধুর রসবোধ

রাশেদ রউফ | শুক্রবার , ৫ আগস্ট, ২০২২ at ৬:৪৬ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পর্বতপ্রমাণ অটল এক ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্বের উচ্চতা, চরিত্রের দৃঢ়তায় বিশ্বের সমসাময়িক নেতৃবৃন্দ থেকে তিনি ছিলেন আলাদা। ছিলেন সাহসী, বিনয়ী ও নিঃশঙ্ক। প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী বলেন, ‘তিনি এমন এক নেতা- যিনি জনগণকে মন্ত্রমুগ্ধ করার মতো বজ্রকণ্ঠের অধিকারী। শুধু কণ্ঠস্বর নয়- তিনি দেখতেও ছিলেন বিশালদেহী, শ্যামলকান্তির মানুষ। সম্ভবত তিনি বাঙালির একমাত্র নেতা- যিনি গায়ের রঙ, মুখের ভাষা, চলনে-বলনে, আকারে এক কথায় নৃতাত্ত্বিকভাবেও খাঁটি বাঙালি। এ ছাড়া তিনি ছিলেন অত্যন্ত বন্ধুবৎসল। শত্রুর সঙ্গেও তিনি কখনো খারাপ ব্যবহার করতেন না। শত্রুর সঙ্গেও মিত্রের মতো ব্যবহার করতেন। এই যে শত্রুর প্রতি বন্ধুর মতো আচরণ, এটা তার নেতৃত্বের একটা বড় গুণ।’ তাঁর কর্মে যেমন একাগ্রতা ছিল, তেমনি লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল। অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতা এবং কর্মীদের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা ছিল বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। নেতার চেয়ে কর্মীদের বন্ধু হতেই তিনি বেশি ভালোবাসতেন। রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলেন, ‘তাঁর স্বভাবসুলভ স্মিত হাসিতে কখনও কেটে যেতো মনের ঈশাণ কোণে জমে থাকা অভিমানের মেঘ, কখনও ঝরতো স্নেহসুধা। এমন অনেকবার হয়েছে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত হাসির ঝিলিকে মিলেছে প্রশ্রয়ের ইঙ্গিত, আবার কখনও ধরা পড়েছে সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ। যা তার রসিক মনের পরিচয়বাহী।’

বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা তিনটি বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’; এম আর আখতার মুকুলের ‘মহাপুরুষ’, ফারুক চৌধুরীর ‘জীবনের বালুকাবেলায়’ এবং এবিএম মূসার ‘মুজিব ভাই’ গ্রন্থের নানা অধ্যায়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর রসবোধের অনেক পরিচয় পাই। এ ছাড়া ‘হাস্যরসিক বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে তাপস রায় রচনা করেছেন আরেক নাতিদীর্ঘ রচনা। প্রখ্যাত সাংবাদিক এ বি এম মূসার ‘মুজিব ভাই’ বইয়ে একটা অধ্যায়ের নামই হলো ‘রঙ্গরসে বঙ্গবন্ধু’। এসব বই ও রচনা ঘেঁটে আজ বঙ্গবন্ধুর রসবোধের কয়েকটি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

১৯৭২ সালে প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে সোভিয়েত ইউনিয়ন গেছেন বঙ্গবন্ধু। মস্কোতে তাঁর আবাসস্থল ক্রেমলিন। পরাক্রমশালী জারদের এই আবাসস্থল আসলে ৩১টি প্রাসাদের সমষ্টি। একেবারে রাজকীয় ব্যাপার। সমস্যা একটাই- প্রতিবেলা তাঁদের খেতে দেওয়া হচ্ছে পোলাও কোরমা। এমনকি সকালেও! সঙ্গে ক্যাভিয়ার, টোস্ট, ডিম, কাটলেট- মহা আয়োজন। বঙ্গবন্ধু একদিন সাগ্রহে জানতে চাইলেন, ‘এরা প্রতি বেলা পোলাও-কোরমা দেয় কেন?’ সফরসঙ্গী ফারুক চৌধুরী বললেন, ‘স্যার, আমার ধারণা, এটা বাংলাদেশের সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত পপভের কীর্তি। তিনি নিশ্চয়ই এদের বলেছেন, এরা বাঙালি, ভাত-তরকারি খুব ভালোবাসে। মস্কোতে এই পোলাও-কোরমা সম্ভবত ভাত-তরকারির রূপান্তর।’ বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে বললেন, ‘ভাগ্যিস পপভ পান্তা ভাতের খবর পাননি। তাহলে তো রাতেও খেতে হতো পান্তা ভাতের রূপান্তর!’

‘মুজিব ভাই’ গ্রন্থে এ বি এম মূসা লিখলেন আরেকটি মজার ঘটনা। তাঁর বয়ানে দেখি: ‘নিজের মন্ত্রীদের নিয়ে মাঝেমধ্যেই রসিকতা করতেন বঙ্গবন্ধু। দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু ১১ জানুয়ারি সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন। এরপর বিকেল বেলা সংবাদ সম্মেলন করার পর যথারীতি আমাদের সঙ্গে সান্ধ্য আড্ডায় বসলেন। তখনো মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টন হয়নি। এ নিয়ে আমরা একটুখানি কৌতূহল প্রকাশ করায় তিনি কৃত্রিম গম্ভীরতার সঙ্গে জানালেন, সব এখন বলব না, একটু পরই জানতে পারবা। উপযুক্ত ব্যক্তিকেই যথাযথ দায়িত্ব দিয়েছি। তবে একটা দপ্তর নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। অনেক ভেবেচিন্তে সেটা জহুরের কাঁধে চাপালাম। দপ্তরটি হচ্ছে স্বাস্থ্য ও জন্মনিয়ন্ত্রণ (পরবর্তীকালে পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়)। ভেবে দেখলাম, আমার মতো সারা জীবন জেল খাইটা তার শরীরডা খ্যাংরা কাঠির মতো হইয়া গেছে। সব ডাক্তারকে সে মাইনসের স্বাস্থ্য ভালো করার তাগিদ দিতে পারব। সে আবার দুই বউয়ের ১৪টি বাচ্চা নিয়ে হিমশিম খাইতাছে। বেশি বাচ্চা হওয়ার জ্বালা সে-ই ভালো বোঝে। তাই তারে জন্মনিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দিয়েছি।’

প্রায় কাছাকাছি আরেক ঘটনা। স্বাধীনতার পরের বছর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। বঙ্গভবনে অনুষ্ঠান শেষে তিনি ১৪ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী প্রত্যেকের হাতে উপহারস্বরূপ একটি করে ভারতীয় বেঙ্গালুরু সিল্কের শাড়ি দিলেন। বলাবাহুল্য, শাড়িগুলো মন্ত্রীদের বেগম সাহেবাদের জন্য। শাড়ি বিতরণ শেষ, মন্ত্রীরা ইন্দিরা গান্ধীকে সমবেতভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। এমন সময় দূর থেকে এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু। তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধরের শাড়িখানি প্রায় ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে জহুর আহমদ চৌধুরীর হাতে ধরিয়ে দিলেন।

এ ঘটনায় ইন্দিরা গান্ধী অবাক হতেই বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘মনোরঞ্জন ধর ব্যাচেলর মানুষ। তাঁর শাড়ির দরকার নেই। বেচারা জহুরের দুই বউ। এক শাড়ি নিয়ে দু’জনে টানাটানি করবে। তাই তারটি জহুরের আরেকটি বউয়ের জন্য দিলাম।’

তিন সাংবাদিক বন্ধুকে বঙ্গবন্ধু নাম দিয়েছিলেন- আপদ, বিপদ এবং মুসিবত। ফয়েজ আহমদকে তিনি ডাকতেন ‘আপদ’, এবিএম মূসাকে ‘বিপদ’ এবং আবদুল গাফ্‌্‌ফার চৌধুরীকে ডাকতেন ‘মুসিবত’ নামে। এই হলো তাঁর আদরের ডাক! তাদের তিনজনকে একসঙ্গে দেখলেই বলতেন, এই যে আইসা পড়ছে আপদ-বিপদ-মুসিবত! কী না জানি কী ঘটায় এখন!

শুধু তাই নয়, ফেনীর তৎকালীন রাজনৈতিক কর্মী রুহুল আমিনকে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তিনি তার নাম দিয়েছিলেন ‘ভুসি’! কারণ তিনি ভুসির ব্যবসা করতেন।

রুহুল আমিন সুযোগ পেলেই এবিএম মূসার নিকট তার অপ্রাপ্তির কথা শুনিয়ে আক্ষেপ করে বলতেন, ‘আমার কিছু হলো না, দেশ ও দলের জন্য এত কিছু করেছি, সর্বস্বান্ত হয়েছি। মুজিব ভাই প্রধানমন্ত্রী হলেন অথচ আমি কিছুই পেলাম না।’

রুহুল আমিনের ঘ্যানঘ্যানে বিরক্ত হয়ে এ বি এম মূসা একবার তাকে নিয়ে এলেন ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বরে। বঙ্গবন্ধু তাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন। তারপর ‘ওরে আমার ভুসি এসেছে’ বলে হইচই করে উঠলেন। রুহুল আমিন কিন্তু যে কথাগুলো বলার জন্য এসেছিলেন, ভুলে গেলেন। বঙ্গবন্ধু তার কাছে যতবার জানতে চান, ‘কেমন আছিস, কোনো অসুবিধা নেই তো?’ রুহুল আমিন ততবারই তোতলান আর বলেন, ‘ভা-ভা ভালোই আছি। ক-ক কোনো অসুবিধা নাই।’ এভাবেই প্রায় ত্রিশ মিনিট কথোপকথন চললো। কিন্তু রুহুল আমিন মুখ ফুটে কিছুই চাইতে পারলেন না। ফেরার পথে এ বি এম মূসা যখন খোটা দিয়ে বললেন, ‘কী হলো, এত প্যানপ্যানানি গেল কই? কিছুই তো চাইতে পারলে না!’ রুহুল আমিন আমতা আমতা করে বললেন, ‘কী করবো, নেতাকে দেখে যে সবই ভুলে গেলাম!’
জাকারিয়া খান চৌধুরী ওরফে জ্যাক ছিলেন এবিএম মূসার বন্ধু। বিলেত থেকে স্বাধীন দেশে ফেরার পর তিনি বন্ধুকে ধরলেন একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে। মূসা তাঁকে ‘মর্নিং নিউজ’-এর সহকারী সম্পাদক পদে নিয়োগ দিলেন। একদিন সন্ধ্যায় দুই বন্ধু মিলে গেলেন গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। জ্যাক পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেই বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এটাকে আবার কে নিয়ে এলো?’ উল্লেখ্য, পারিবারিকভাবেই বঙ্গবন্ধু জ্যাককে ভালোভাবে চিনতেন। তারপরও মূসা বিস্তারিত শুনিয়ে বললেন, ‘ওকে আমার কাগজে নিয়েছি।’

‘তা ওর কী কাজ?’ বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলেন। মূসা বললেন, ‘সম্পাদকীয় আর বিভিন্ন বিষয়ের ওপর উপসম্পাদকীয় লিখবে।’ ‘বেশ ভালো।’ বঙ্গবন্ধু মুচকি হেসে বললেন, ‘যা লেখাবার ওকে দিয়ে সন্ধ্যার আগে লেখাবি। খবরদার সন্ধ্যার পর যেন কিছু না লেখে।’ কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে উঠলেন। শুধু জ্যাকের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। কারণ সন্ধ্যার পর বিশেষ পানীয় পান শেষে তার বেহাল পরিস্থিতির কথা বঙ্গবন্ধু জানতেন। এজন্যই এই ইঙ্গিত।

চীনের এক সেলুনে চুল কাটতে গেলে নানা কথার পর সেলুনওয়ালা যখন তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন, তিনি হেসে বললেন, ‘এমনি ঘুরে বেড়াই, দেশ-বিদেশ দেখি। মনে মনে বলি, আমার আবার পরিচয়? পথে পথে ঘুরে বেড়াই, বক্তৃতা করে বেড়াই। আর মাঝে মাঝে সরকারের দয়ায় জেলখানায় পড়ে খোদা ও রাসুলের নাম নেওয়ার সুযোগ পাই। এই তো পরিচয়। কতটা রসবোধসম্পন্ন মানুষ হলে নিজেকে এমন সহজভাবে প্রকাশ করতে পারেন, কল্পনা করা যায় না।

একদিন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহকর্মী কাজী আলতাফ হোসেনকে নিয়ে মওলানা শামসুল হক সাহেবের বাড়ি যাচ্ছেন। জরুরি প্রয়োজন, রাতেই নৌকায় রওনা হয়েছেন। মধুমতীর ওপর দিয়ে ছোট্ট নৌকা ভেসে চলেছে। অধিক ক্লান্তিতে বঙ্গবন্ধু ঘুমিয়ে পড়েছেন। গভীর রাত। চারদিকে সুনসান নীরবতা। নদীর এক জায়গায় বেশ চওড়া। সেখানে প্রায়ই ডাকাতি হয়। নৌকা সেখানে আসামাত্র একটা ছিপ নৌকা এগিয়ে এলো। একজন আগুন আছে কিনা জানতে চাইল। আগুন চেয়েই ডাকাতেরা নৌকার কাছে আসে। এটা তাদের কৌশল। একজন জিজ্ঞেস করল, ‘নৌকা যাবে কোথায়?’ মাঝি বলল, ‘টুঙ্গিপাড়া’। নৌকা একদম নিকটে চলে এসেছে। এমন সময় আবারও প্রশ্ন, ‘নৌকায় কে?’ মাঝি তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম বলতেই ডাকাতরা মাঝিকে বৈঠা দিয়ে আঘাত করে বললো, ‘শালা আগে বলতে পারো নাই শেখ সাহেব নৌকায়।’ বলেই তারা দ্রুত নৌকা ঘুরিয়ে নিলো।

ওদিকে শব্দ পেয়ে বঙ্গবন্ধুর ঘুম ভেঙে গেছে। কাজী সাহেব তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘ডাকাতরা আপনাকে শ্রদ্ধা করে। আপনার নাম করেই বেঁচে গেলাম। না হলে উপায় ছিল না।’ বঙ্গবন্ধু তখন হাসতে হাসতে বললেন, ‘বোধহয় ওরা আমাকে ওদের দলের একজন বলে ধরে নিয়েছে।’

এরকম অনেক ঘটনার উল্লেখ করা যায়, যেখানে বঙ্গবন্ধুর রাশভারী ব্যক্তিত্বের ভেতরে তাঁর রসিকতা ও কৌতুকবোধ ধরা দিয়েছে। তিনি যেমন দৃঢ়চেতা, তেমনি শিশুর মতো সরল।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাঁচ কর্মকর্তাকে একযোগে বদলি, তিন পদে নতুন নিয়োগ
পরবর্তী নিবন্ধনৌপথে পণ্য পরিবহনে নতুন সংকট