বঙ্গবন্ধুর বৈষম্যহীন শিক্ষাভাবনা

পিংকু দাশ | বুধবার , ২০ জুলাই, ২০২২ at ৬:২০ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, জীবন বিকাশের প্রক্রিয়া, মানবিক গুণ বিকাশের প্রধান হাতিয়ার। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনার মূলে ছিল জাতি- ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা, বৈষম্যহীন, শোষণহীন উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থা, কর্মমুখী ও উৎপাদনশীল শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা। এ লক্ষ্যে তিনি শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে তিনি প্রথমেই মনোযোগ দেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠনে। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, শিক্ষাই হবে মুক্তির হাতিয়ার। এই মুক্তি হবে সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি, এই মুক্তি হবে মানবতার মুক্তি, এই মুক্তি হবে শোষিত জনগণের মুক্তি, এই মুক্তি হবে দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি।
তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৯৭২ সালে ২৬ জুলাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরত-এ-খুদাকে সভাপতি ও অধ্যাপক কবির চৌধুরীকে সদস্য সচিব করে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। ওই কমিশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন সমাজতান্ত্রিক দেশের উপযোগী নাগরিক তৈরির জন্য যে ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন, কমিশনের উচিৎ সে ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা সুপারিশ করা। এই কমিশন দেড় বছর কঠোর পরিশ্রম করে ব্যাপক জরিপ ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে শিক্ষা সংস্কারের একটি দীর্ঘমেয়াদী রূপরেখা প্রণয়ন করেন। যা ১৯৭৪ সালের ৩০ মে দাখিল করেন। কমিশনের উল্লেখযোগ্য সুপারিশসমূহ :

১। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত যে অবৈতনিক শিক্ষা চালু আছে তা ১৯৮০ সালের মধ্যে বাধ্যতামূলক করতে হবে। ১৯৮৩ সালের মধ্যে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন ধরনের অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করতে হবে।
২। শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করে সীমাহীন নিরক্ষরতা দূরীকরণ একই পদ্ধতিতে গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শুধু মাতৃভাষা বাংলায় শিক্ষাদান, ইংরেজী ও ধর্মীয় শিক্ষা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে শিক্ষাসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করে মাদ্রাসা শিক্ষাকে আরও যুগোপযোগী করার পরিকল্পনা করা হয়।
৩। শিক্ষাক্ষেত্রে ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির (গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ) প্রতিফলন ঘটানো।
৪। দরিদ্র, গরীব পরিবারের সন্তানদের জন্য নৈশ স্কুল চালু করা।
৫। কমিশন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাসূচীকে এদেশের জনগণের জীবনধারার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করার উপরও জোর দেন। যেহেতু নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণির মধ্যবর্তী সময়ে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে, অথচ তারা জীবিকা অর্জনের কোনো সহায়ক শিক্ষা পায় না। তাই মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। নবম শ্রেণি থেকে শিক্ষাক্রম বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষা এ দু’ধারায় বিভক্ত থাকবে। উভয় ধারাতে নবম ও দশম শ্রেণিতে কয়েকটি বিষয় অবশ্য পাঠ্য থাকবে। এর বাইরে কয়েকটি বিষয় শিক্ষার্থীরা ইচ্ছেমত বেছে নিতে পারবে। বৃত্তিমূলক শিক্ষা হবে তিন বছরের, সাধারণ ধারায় হবে চার বছরের।
৬। নারীশিক্ষা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বয়স্ক শিক্ষা ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের উপর জোর দেয়া।
৭। একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
৮। শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ ও সদ্ব্যবহারের কথা উল্লেখ আছে রিপোর্টে। শিক্ষকদের দায়িত্ব, মর্যাদার উপরও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
৯। ১৯৮০ সালের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতার গ্লানি দূর করতে হবে।
১০। শিক্ষার সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলন করতে হবে।
১১। স্বাস্থ্য শিক্ষা, শরীর চর্চা, সামরিক শিক্ষা, শারীরিক ও মানসিক বাধাগ্রস্তদের জন্য বিশেষ শিক্ষার কথা কমিশনের সুপারিশে উল্লেখ আছে।
১২। কৃষিশিক্ষা, ব্যবসায়শিক্ষা, বিজ্ঞানশিক্ষা, চিকিৎসাশিক্ষা, ললিতকলাশিক্ষা প্রভৃতি শিক্ষার জন্য আলাদা রূপরেখা কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখ আছে।

বঙ্গবন্ধু জানতেন দেশ গড়ার ক্ষেত্রে যেসব বিষয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন শিক্ষা তার মধ্যে অন্যতম। এজন্য কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হবার আগেই ১৯৭৩ সালে দেশের ৩৬১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এমনকি প্রতিরক্ষা খাতের চেয়েও বেশি। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষাখাতে এদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২১. ১৬ শতাংশ সরকারি ব্যয় বরাদ্দ ছিল। ১৯৭৪ সালের ৫ ফেব্রয়ারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অধিগ্রহণ আইন, ১৯৭৪ পাস করে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র

(ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইন দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য।
(খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সংগতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টি করার জন্য।
(গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়, ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বেতার টেলিভিশন ভাষণে শিক্ষাসংক্রান্ত যে কথা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন তা থেকে।

‘সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর হতে পারে না। ১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পরিসংখ্যান একটি ভয়াবহ সত্য। আমাদের জনসংখ্যার শতকরা ৮০ জন অক্ষরজ্ঞানহীন। প্রতিবছর ১০ লক্ষেরও অধিক নিরক্ষর লোক বাড়ছে। জাতির অর্ধেকেরও বেশি শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। শতকরা মাত্র ১৮ জন বালক ও ৬ জন বালিকা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। জাতীয় উৎপাদনের শতকরা কমপক্ষে ৪ ভাগ সম্পদ শিক্ষা খাতে ব্যয় হওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। কলেজ ও স্কুল শিক্ষকদের, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে হবে। নিরক্ষরতা অবশ্যই দূর করতে হবে। ৫ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ চালু করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার সকল শ্রেণির জন্য খোলা রাখতে হবে। দ্রত মেডিক্যাল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়সহ নয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দারিদ্র্য যাতে উচ্চশিক্ষার জন্য মেধাবী ছাত্রদের অভিশাপ হয়ে না দাঁড়ায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে’।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু গণমুখী শিক্ষার বিষয়কে শুধু সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে ক্ষান্ত হননি, শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে তিনি বেশকিছু গণমুখী পদক্ষেপও গ্রহণ করেন। তার মধ্যে অন্যতম ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বরাদ্দ। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছিলেন। এগুলো হচ্ছে ঢাকা, রাজশাহী , চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু তাই নয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে তিনি ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন’ গঠন করেন।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শনের মূল কেন্দ্রে ছিল বাংলার সাধারণ মানুষ। ১৯৭২ সালের ১৯ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ কর্মীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘বাবারা একটু লেখাপড়া শিখ। যতই জিন্দাবাদ কর, মুর্দাবাদ কর, ঠিকমত লেখাপড়া না শিখলে কোনো লাভ নেই। আর লেখাপড়া শিখে যে সময়টুকু থাকে, বাবা-মাকে সাহায্য কর। শুধু বিএ, এমএ পাশ করে লাভ নেই। আমি চাই কৃষি কলেজ, কৃষি স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও স্কুল। যাতে সত্যিকার মানুষ পয়দা হয়। বুনিয়াদী শিক্ষা নিয়ে কাজ করে খেয়ে বাঁচতে পারবে। কেরানি পয়দা করেই একবার ইংরেজ শেষ করে গেছে দেশটা। তোমাদের মানুষ হতে হবে’।

বঙ্গবন্ধু শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে শিক্ষা ও শিক্ষকদের সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। শিক্ষকদের সবচাইতে বেশি সম্মান দিতেন। চরম আর্থিক সংকটের মাঝেও তিনি শিক্ষকদের বেতনভাতার বিষয়ে আপস করেননি। কিন্তু দুঃখের বিষয় বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে শিক্ষকরা এখন আর ভালো নেই। প্রতিনিয়ত তারা মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সামনে শিক্ষককে অন্যায়ভাবে অপমান করা হচ্ছে। এমনকি ছাত্রের আঘাতে শিক্ষকের মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। শিক্ষা, শিক্ষক এবং ছাত্র একটি আরেকটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শিক্ষক যদি স্বাধীনভাবে শিক্ষা দান করতে না পারে, শ্রেণিকক্ষে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি কোনো ছাত্রকে শাসন করতে না পারে তাহলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলা নেমে আসবে, এবং অচিরেই দেশের শিক্ষা খাত মুখ থুবড়ে পড়বে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক (অর্থনীতি)
বোয়ালখালী হাজী মো: নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ