বইয়ের পাঠক বাড়াতে হবে

সালাহউদ্দিন শাহরিয়ার চৌধুরী | শুক্রবার , ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ

আমাদের ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি মাস, প্রাণের বইমেলার মাস, লেখক ও পাঠকের প্রাণের মিলন মেলার মাস। অমর একুশের গ্রন্থমেলা বা বইমেলা বাঙালি জাতিসত্তার সাথে মিশে গিছে। ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সর্বোপরি বাংলাভাষা ও সাহিত্যিকে সমৃদ্ধ করতে এই মেলা অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। অন্য কোনও দেশের যেকোনও মেলার সাথে আমাদের দেশের বইমেলার ভিন্নতা রয়েছে কারণ আমাদের বইমেলার সাথে রয়েছে আমাদের ভাষার জন্য রক্ত দেওয়ার ইতিহাস।

বইমেলা বলতে আমরা বুঝি অমর একুশের গ্রন্থমেলা, বছরের অন্য সময়ে বই প্রকাশিত হলেও মেলা উপলক্ষ্যে নবীনপ্রবীণ বই প্রকাশের হার নিঃসন্দেহে সারা বছরের চেয়ে বেশি। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে কাজী মনজুরে মাওলা মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে অমর একুশের বইমেলার আয়োজনের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে যেমন অর্থবহ করেছে তেমনি করেছে সাহিত্যপ্রেমিদের জন্য একটি বর্ণিল উৎসবের প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা। বাংলাদেশের প্রকাশনা ব্যবসার শুরু মূলত বইমেলাকে কেন্দ্র করে, যা ষাটের দশক থেকে শুরু হয়েছে। তবে আশির দশকে এসে বাংলাদেশে ছোটবড় অনেকগুলো প্রকাশনার আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে এর বিস্তার লাভ করে যারা এই বইমেলাকে ঘিরে উল্লেখযোগ্য বই প্রকাশ করে, এই নতুন নতুন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয় নতুন নতুন লেখকের। একটা সময় অমর একুশের বইমেলায় শুধু রাজধানীর বাংলা একাডেমিতে কেন্দ্রীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হতো যার জন্য লেখক ও পাঠকরা সবসময় ছিল রাজধানীমুখী। কিন্তু বর্তমানে সময়ে অনেক বিভাগীয় শহর এবং অনেক জেলা শহরে সরকারের পক্ষ থেকে বা সাহিত্যপ্রেমিদের সংগঠনের পক্ষ থেকে মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। সুতরাং এই বইমেলা আয়োজনের ফলে পাঠক এবং লেখক যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি এই বই মেলায় উৎসব আবহের কারণে বাংলা ভাষা সাহিত্য এবং ইতিহাসও সমৃদ্ধ হচ্ছে।

যারা সাহিত্য চর্চা করেন তারা অনেকটা এই একুশের বইমেলার জন্য তাদের সৃষ্টিকে জমিয়ে রাখেন, তেমনি সাহিত্যপ্রেমিক পাঠকও অপেক্ষায় থাকেন এই একুশের বইমেলায় তাদের প্রিয় লেখকের লেখা বইয়ের জন্য। একুশের বইমেলাকে নিয়ে প্রখ্যাত লেখকরা যেমন পাঠকের জন্য তাদের সাহিত্য কর্মকে ছড়িয়ে দেন তেমনি নতুন নতুন লেখকরাও নিজেদের পাঠকের মাঝে উপস্থাপনের সুযোগ পায়।

একটা সময় শুধু সাহিত্য প্রেমিকদের আনাগোনা থাকতো এই বই মেলায়, বর্তমান সময়ে পিতার হাত ধরে ছোট শিশুটিও ঘুরে বেড়ায় এই মেলা প্রাঙ্গনে, একটি বই এখন সেই ছোট শিশুটির হাতে শোভা পায়। এই মেলা আছে বলেই একজন লেখক অন্তত একটি বই লেখার চেষ্টা করেন।

বইমেলাকে সফল করার পেছনে লেখক ও দর্শকদের ভূমিকার সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে প্রকাশকদের। এই প্রকাশকদের ব্যস্ততা সারা বছর না থাকলেও মেলা শুরুর কয়েকমাস পূর্বেই তাদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। প্রত্যেক লেখক চায় একটি স্বনামধন্য প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের বইটি পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে তাতে তাদের বইয়ের প্রকাশনায় প্রিন্টিং যেমন নিখুঁত হয় তেমনি মেলায় তাদের বইয়ের কাটতিও ভালো হয়। বর্তমান সময়ে কাগজের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে বইয়ের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে কিন্তু বই বিক্রি বা পাঠক সংখ্যা খুব একটা বাড়েনি। বাংলাদেশে কপি রাইট আইন থাকলেও তা সঠিকভাবে খুব একটা প্রয়োগ হয় বলে মনে হয় না। তাই কিছু অসাধু প্রিন্টিং প্রেস নিম্নমানের কাগজ বা যে সমস্ত লেখকের বইয়ের কাটতি বেশি সে সব বই ছাপিয়ে বিক্রি করে ফলে এতে প্রকাশক যেমন আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হয় তেমনি লেখকও বইটি পুনঃ প্রকাশের রয়েলটি থেকে বঞ্চিত হয়। এত কিছুর পরেও লেখকের লেখা যেমন থেমে নেই তেমনি প্রকাশকও ছাপা থেকে বিরত নেই। বইমেলা আসলেই প্রকাশক যেমন তার বই বিক্রি বাড়াতে চায় তেমনি পাঠকও অপেক্ষা করে এই বইমেলা উপলক্ষ্যে বইয়ের উপর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ঘোষিত ছাড় এর জন্য। পাঠক যেন উচ্চ মূল্যের কারণে কোনওভাবেই বই কেনা থেকে দূরে সরে না যায়, সে বিষয়ে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে, লেখক যেন তার বই এর প্রকৃত লভ্যাংশ বা সম্মানী পায় সেদিকেও লক্ষ্য রাখার দায়িত্বও কিন্তু প্রকাশকদের। প্রকাশনার ক্ষেত্রে নবীন সৃজনশীল মান সম্পন্ন লেখক ও প্রকাশকদের জন্য বিশেষ পুরস্কার এবং প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকলে তবে নবীন, তরুণদের মধ্যে সৃজনশীল লেখার প্রতি আরও আগ্রহ সৃষ্টি হতো তাতে তাদের মধ্যে বই লেখালেখির মাঝেও একটি নির্ভরশীল পেশাদারিত্ব সৃষ্টি হতো।

উন্নত বিশ্বে প্রতি বছর বেস্ট সেলিং বইয়ের একটি তালিকা প্রকাশ করার জন্য থাকে বিভিন্ন প্লাটফর্ম, যাতে বইয়ের একটি তালিকা এবং সংক্ষিপ্ত সার দেওয়া থাকে, যার ফলে পাঠক মানসম্মত এবং তার আগ্রহের বইটি বেছে নিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে আজ পর্যন্তু বেস্ট সেলার বই এর তালিকা প্রকাশ করার নির্ভরযোগ্য কোন প্রতিষ্ঠান তৈরী হয়নি। কিছু কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হয়তো তাদের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে বেস্ট সেলার বই এর নাম প্রকাশ করে। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন মিডিয়ার বিস্তার লাভ করলেও তাতেও বই নিয়ে খুব বেশি রিভিউ থাকে না। সুতরাং বুক রিভিউ না থাকায় পুরানো লেখকরাই বইমেলাকে ঘিরে প্রাধান্য পায়, নতুন সৃজনশীল লেখকরা হয়তো আড়ালেই থেকে যায়। যেহেতু বইমেলাকে ঘিরে সাহিত্যপ্রেমিকদের আগ্রহ তাই লেখক প্রকাশক বই মেলাতে বই প্রকাশ করার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হন, ফলে সারা বছর বই প্রকাশিত হচ্ছে খুব কম। নতুন বই কেনার আগে পাঠক কিন্তু সেই বইয়ের পাতা উল্টিয়ে কিছুটা তার সারসংক্ষেপ পড়ে কিনতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, কিন্তু বই মেলা ছাড়া লাইব্রেরি থেকে বইয়ের পাতা পড়ে কেনার সুযোগ খুব একটা নেই। তাই প্রতিটি বইমেলায় প্রকাশনা সংস্থার পাশাপাশি বই পড়ার জন্য পাঠকের জন্য একটি নির্ধারিত স্থান থাকা প্রয়োজন।

এই বইমেলাকে ঘিরে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছে বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতি, এই বইমেলা আমাদের সাহিত্যসেবিদের মেধাবিকাশের বাতিঘর। লেখকের সৃষ্টি পাঠকের জন্য এবং পাঠক হচ্ছে লেখকের প্রাণ, সে প্রাণ ভ্রমরকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে চাই মান সম্পন্ন লেখা। অভিভাবক যেমন সন্তান ভবিষ্যতে তাদের জন্য কী করবে তা নিয়ে চিন্তা করে না, তেমনি কোনও লেখক পুরস্কার পাওয়ার জন্য তার লিখনি লিখে না, তবুও এই বইমেলাকে ঘিরে লেখক তার স্বীকৃতি কামনা করে। তবুও আশার কথা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রকাশনা সংস্থা লেখকদের পুরস্কৃত করে থাকে। তবে আর্থিক স্বীকৃতির বাইরে স্বীকৃতি হিসেবে বলা যায় একুশের বইমেলায় লেখক, পাঠক, প্রকাশকের সৃজনশীল একটি প্রীতি সম্মিলন ঘটে।

একুশের বইমেলায় প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে, এবারের বইমেলার প্রতিপাদ্য ‘পড়ো বই গড়ো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। আমাদের গর্ব আমাদের বইমেলা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তৈরী কোনও মেলা নয়, বরং বাঙালির ভাষাসংস্কৃতির গণ আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন।

লেখক: প্রাবন্ধিক; ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকুশের চেতনা
পরবর্তী নিবন্ধএকুশের প্রকাশনা আর একুশের প্রথম প্রহর