প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৩ মার্চ, ২০২১ at ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণ

ইরানে হযরত খেরকানী (রহ.) ও তাঁর তিক্ত দাম্পত্য জীবন
ইরানের সেমনান প্রদেশে শায়িত রয়েছেন বিশ্বখ্যাত মহান সুফি দরবেশ হযরত আবুল হাসান (রহ.)। খেরকান অঞ্চলের বাসিন্দা বিধায় হযরত আবুল হাসান খেরকানী বিশ্বে প্রসিদ্ধ। তাঁর জন্ম তারিখ জানা যায়নি। তবে তিনি ১০ মহরম ৪২৫ হিজরিতে ৭৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন বলে জানা যায়। কিশোর বয়সে পারিবারিকভাবে পশুপালন করতেন। দীর্ঘকাল কঠোর রেয়াজত তথা মোরাকাবা মোশাহাদার পর অতি উচ্চ আধ্যাত্মিক মর্যাদা লাভ করেন। তাঁর বুজুর্গী প্রকাশ পেতে থাকায় অসংখ্য লোকজন তাঁর কাছে আসা যাওয়া করতে থাকে। এতে সেকালের শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিত্বগণও আসা যাওয়া করতেন। তন্মধ্যে আবুল কাশিম আল-কুসাইরী, আবু আলী ইবনে সীনা (ইবনে সীনা), গজনীর সুলতান মাহমুদ অন্যতম। সুফি দরবেশের জংশন নিশাপুর থেকেও অনেক ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হযরত খেরকানীর মোলাকাত প্রার্থী হয়ে আসতেন।
উনি আধ্যাত্নিক জগতের বিশ্বখ্যাত মহান অলি। আমাদের দেশেও ধর্মীয় সচেতন ব্যক্তিত্বগণের কাছে তিনি যথেষ্ট পরিচিত। হযরত খেরকানী (রহ.)’র জন্মের অনেক আগে হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) তাঁর আগমনের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন। হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) প্রতি বছর শহীদানের যেয়ারতের উদ্দেশ্যে দাহস্থা গমন করতেন। পথিমধ্যে খেরকান অতিক্রমকালে সেখানে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতেন। খাদেম প্রশ্ন করলে উত্তরে বলেন তিনি এখানে একজন বান্দার খুশবু পাচ্ছেন। তাঁর নাম আলী কুনিয়াত হবে আবুল হাসান। তিনি তিনটি বিষয়ে আমার অগ্রণী হবেন। যথা- সন্তান-সন্ততির ভরণপোষণ, চাষাবাদ ও বৃক্ষরোপণ বিষয়ে।
এ মহান অলি হযরত খেরকানী (রহ.) জীবদ্দশায় খেরকানে এশারের নামাজ আদায় করে প্রায় ১৫/১৬ কি.মি দূরত্বে বাস্তাম গমন করতেন হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.)’র যেয়ারতে। ফয়েজ ও বরকত হাছিলের জন্য আল্লাহর দরবারে তিনি দোয়া করতেন। পুনঃ খেরকানে ফিরে এসে এশার অজুতে জামাতের সাথে ফজরের নামাজ আদায় করতেন।
সিলসিলা তত্ত্বে জানা যায় হযরত আবুল হাসান খেরকানী (রহ.) তৎ পীর হযরত আবু মোজাফ্‌ফর তুসী (রহ.) তৎ পীর হযরত ইরাবী ইয়াজিদ ইশকী (রহ.) তৎ পীর হযরত মুহাম্মদ মগরেবী (রহ.) তৎ পীর সুলতানুল আরেফীন হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) তৎ পীর হযরত ইমাম জাফর সাদেক (রা.)। তবে আধ্যাত্নিকভাবে তাকে হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)’র শিষ্য বলা হয়।
৪০ বছর যাবৎ তিনি বালিশের ওপর মাথা রাখেননি। ফজরের নামাজ এশার অজুতে পড়তেছিলেন। আল্লাহ প্রাপ্তিতে তাঁর রেয়াজত, ত্যাগ মানবের জন্য অতি কঠিন বলা চলে। তারপরেও তিনি তা করে গেছেন। হয়ত বা এতে তাঁর দাম্পত্য জীবনে অশান্তি চলতে থাকে।
তাঁর খানকাতে বহু দরবেশসহ হযরত খেরকানী (রহ.) একাদিক্রমে ৭ দিন উপবাস ছিলেন। উপবাসের অবস্থা বুঝতে পেরে এক ব্যক্তি একটি ছাগল ও কিছু আটা নিয়ে হাজির হলেন এবং বলেন, এটা সুফিদের জন্য নিয়ে এসেছি। এতে হযরত খেরকানী (রহ.) লক্ষ্য করে বললেন আপনাদের মধ্যে যিনি সুফি আছেন তিনি এসব হাদিয়া নিতে পারেন। যেহেতু এ হাদিয়া কবুল করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি সুফি দাবি করতে পারি না। এ হাদিয়া কবুল করার জন্য কেউ অগ্রসর হলেন না। ফলে সে ব্যক্তি আটা ও ছাগল নিয়ে ফিরে গেলেন।
একবার এক ব্যক্তি তাঁর খেদমতে আরজ করলেন, মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান জানানোর জন্য আমাকে অনুমতি দিন (যাকে পীরের খেলাফত হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে)। তখন হযরত খেরকানী (রহ.) বললেন, আল্লাহর পথেই আহ্বান জানাবেন, খুব সাবধান নিজের প্রতি নহে। উক্ত ব্যক্তি (মুরিদ) বললেন, নিজের প্রতি আহ্বানের অর্থ কি? এতে হযরত খেরকানী (রহ.) বলেন-যদি অপর কোন ব্যক্তিও আল্লাহর প্রতি আহ্বান জানায় এবং তাতে আপনি যদি অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েন, তবে এটাই হল নিজের প্রতি আহ্বানের লক্ষণ।
হযরত খেরকানী (রহ.)’র দাম্পত্য জীবন সুখকর না হয়ে ছিল তিক্ত, বিষাক্ত। উক্ত বিষয়ে উল্লেখ করার আগে এখানে বলা প্রাসঙ্গিক যে, দাম্পত্য জীবন সুখকর না হওয়াও আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা। মানুষের তথা নারী- পুরুষের ভাল উত্তম চরিত্র যেমনি আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে আসে তেমনি মানুষের নানান নিকৃষ্ট চরিত্র আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে তথা হুকুমের মাধ্যমে হয়ে থাকে। আখিরাতের দীর্ঘ কল্যাণের জন্য ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াতে আল্লাহ তার বান্দাদের পরীক্ষায় ফেলে থাকেন। তন্মধ্যে অন্যতম কঠিন পরীক্ষা হল দাম্পত্য জীবন। চারিত্রিক দোষ ছাড়া অন্য সবকিছু ধৈয্য, সহ্য, তথা ছবর করে মেনে নিলে হয়ত আল্লাহ পাক পরবর্তী জীবনে মঙ্গল বিনিময় দান করবেন। তবে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে ধৈর্য্য সহ্যের গন্ডি অতিক্রম করলে এতে দাম্পত্য জীবন ভেঙ্গেও যায়। অপরদিকে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে অধিকতর মিল থেকে দাম্পত্য জীবন অধিকতর সুখময় হওয়ার সংখ্যাও তত বেশি নয়। দাম্পত্য জীবনে এমন স্বামীর সংখ্যা কম নয়, যারা অকর্মন্য, উচ্ছৃংখল, বেকার অথবা পৈত্রিক প্রাপ্ত সম্পত্তি বিক্রি করে ছারখার করা, স্ত্রীর স্বর্ণ অলংকার, স্ত্রীর পৈত্রিক অর্জিত সম্পত্তি সম্পদাদি বিক্রি বা বন্ধক করে নষ্ট করা, একাধিক বিয়ে করা, ব্রেইনের স্বল্পতা তথা ঢিলা বা উন্মাদ এ সবকিছু থাকার পরেও গুণী স্ত্রী নীরবে ছবরের মাধ্যমে সন্তানাদি নিয়ে দুঃখে কষ্টে দিন অতিবাহিত করতে থাকেন। অপরদিেক, এমন গুণী ছবরী স্বামীর সংখ্যাও কম নয়, যারা বেছবরী স্ত্রী, স্বামীর আর্থিক অবস্থা বুঝতে চায় না, নানা উচ্চাকাঙ্ক্ষী চলাফেরা করে স্বামীকে ঋণগ্রস্ত করা, স্বামীর পক্ষের লোকজনকে আতিথেয়তা না করা, স্বামীর নিকট আত্নীয় স্বজনকে সহ্য না করা, স্বামীর আর্থিক প্রতিকূলতা মেনে নিয়ে ছবর বা ধৈর্য্য ধরতে চায় না এ রকম স্ত্রীর সংখ্যাও কম নয়।
মহান অলি স্বামীগণকে এ রকম নিকৃষ্ট আচরণের স্ত্রীগণকে ত্যাগ না করে মহান আল্লাহর সৃষ্টি একজন নারীকে স্ত্রী হিসেবে হজম করে অতি কঠিন ধৈর্য্য ধরে দাম্পত্য জীবন টিকিয়ে রেখে জীবন অতিবাহিত করা সহজ কথা নয়।
বিশ্বের ইতিহাসে অনেক মহান অলিগণকে আল্লাহ পাক নিকৃষ্ট আচরণের স্ত্রী দিয়ে তিক্ত, দাম্পত্য জীবন দিয়ে দুনিয়ার সুখ শান্তি উঠিয়ে নিয়েছেন। তন্মধ্যে হযরত আবুল হাসান খেরকানী (রহ.) অন্যতম।
হযরত খেরকানী (রহ.)’র দাম্পত্য জীবনের নানা তিক্ত ঘটনার একটি এখানে পেশ হচ্ছে- এক ব্যক্তি হযরত খেরকানী (রহ.)’র সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে ঘরের দরজায় এসে ভেতরে আছেন কিনা জানতে চাইলেন-এতে ভেতর হতে হযরত আবুল হাসান খেরকানী (রহ.)’র স্ত্রী জবাব দেন জিন্দিক ও কাজ্জাবের (অবিশ্বাসী ও মিথ্যাবাদীর) তোমার কি প্রয়োজন? এরপর হযরত আবুল হাসান খেরকানী (রহ.)’র আরও অনেক সমালোচনা করলেন। এতে আগত ব্যক্তির মধ্যে ইতস্ততা ভাব আসারই কথা। তারপরও খবর নিয়ে জঙ্গলের দিকে চলে গেলেন। জঙ্গলে পৌঁছতে দেখলেন হযরত খেরকানী (রহ.) একটি বাঘের পিঠে কাঠ বোঝাই করে নিয়ে আসছেন। এতে উক্ত ব্যক্তি হতভম্ব হয়ে যাওয়ারই কথা। আগত ব্যক্তি বলেন-আপনার ঘরের অবস্থা এক রকম আর এ দিকের অবস্থা অন্য রকম। এতে হযরত খেরকানী (রহ.) জবাবে বলেন-যতক্ষণ ঘরের বাঘিনীর (স্ত্রীর) বোঝা উঠাইবে না, ততক্ষণ বনের বাঘও এরূপ বোঝা বহন করবে না। অর্থাৎ হযরত খেরকানী (রহ.) আল্লাহর সৃষ্টি এ রকম উচ্ছৃঙ্খল নিকৃষ্ট আচরণের স্ত্রী হিসেবে রেখে বোঝা বহন করছেন বিধায় আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হয়ে বনের বাঘকে হযরত খেরকানী (রহ.) আনুগত্যে এনে নিজের বোঝা বহন করাচ্ছে।
এক পরিচিত ব্যক্তি (বর্তমানে মরহুম) দাম্পত্য বিষয়ে কিছুটা জানা; নিজের ঘরে প্রবেশ করতেই স্ত্রী স্বামীর সাথে খারাপ আচরণ করে, সব সময় অভাব অভিযোগ উপস্থাপন করে, প্রায় সময় গালমন্দ করতে থাকে। কিন্তু মহান অলি স্বামী নীরবে সবকিছু সহ্য করে দাম্পত্য জীবন চালিয়ে যান।
ইসলামে দাম্পত্য জীবন বিচ্ছেদ করার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে অনুমতি দেয়া আছে। অর্থাৎ ইসলাম দাম্পত্য জীবন ভাঙ্গার পক্ষে নয়। যে কোন ভাবে ধৈর্য্য ধারণের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখার পক্ষে। এতে পরকালে পুরস্কার ত আছেই আল্লাহ পাক ইচ্ছা করলে দুনিয়াতেও পুরস্কৃত করতে পারেন।
হযরত খেরকানী বিশ্বাসে, নিয়তে পর্বতের ন্যায় অবিচল থাকতেন। তাকে সুলতানুল মাশায়েখ এবং আবদাল ও আওতাদগণের কুতুব বলা হয়। তিনি সর্বদা রেয়াজত সাধ্য সাধনায় নিজের দেহকে নিয়োজিত এবং মনকে সর্বদা আল্লাহ পাকের যিকির ও ধ্যানে মশগুল রাখতেন। তিনি অত্যন্ত বেপরোয়া ধরনের উচ্চ সাহস অতি উচ্চ মর্র্যাদাশীল বুজুর্গ ছিলেন। মহান আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভে ছিলেন অসাধারণ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধনাইক্ষ্যংছড়িতে বিজিবি-ইয়াবা কারবারি গোলাগুলি