প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২১ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

বাগদাদের শেখ হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)

১১ রবিউস সানি পীরানে পীর বড় পীর হযরত শেখ আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)’র ওফাত বার্ষিকী। ইরানের কাস্পিয়াম সাগরের তীরে গিলান প্রদেশের বাসিন্দা বিধায় গিলানী। আমাদের এ অঞ্চলে উচ্চারণগত ব্যবধানে জিলানী।
বাগদাদবাসী তাকে শেখ হিসেবে সম্বোধন করে থাকে। শেখ অর্থ প্রধান, বুদ্ধিমান বৃদ্ধ, মুখ্য, সদর, শীর্ষস্থানীয়। বড় রাস্তা থেকে তাঁর মাজার কমপ্লেক্সের দিকে যেতে প্রকান্ড গেট রয়েছে। বাগদাদে যে কোন টেঙীওয়ালাকে বাবুশ শেখ বললে এক বাক্যে চিনে নেয়। অর্থাৎ শেখের গেইট। হযরত পীরানে পীর ছিলেন কাদেরিয়া তরিকার ইমাম।
পীরানে পীর (রহ.) ৪৭০ হিজরি তথা ১০৭৭-৭৮ সালে ১ লা রমজানে ইরানের গিলান অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন।
হযরত ইমাম হাসান (র.)’র বংশে তাঁর মাতা এবং ইমাম হোসাইন (র.)’র রক্ত প্রবাহে রয়েছে তাঁর পিতা। এ কারণে হযরত পীরানে পীর (রহ.) কে আল হাসানী ওয়াল হোসাইনী বলা হয়ে থাকে। ঐতিহাসিকগণ তথা ধর্মীয় বিজ্ঞগণ একমত পোষণ করেন যে, পীরানে পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) বিশ্বের ইতিহাসে অতুলনীয় রুহানী শক্তির অধিকারী ছিলেন এবং তা তাঁর মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থা হতে প্রতিফলন ঘটতেছিল।
তাঁর মাতা কর্তৃক বর্ণিত আছে, পীরানে পীর (রহ.) শিশুকালে রমজান মাসে দিনের বেলা দুধ পান করতেন না। একবার ২৯ সাবান তারিখে রমজানের চাঁদ দেখা না যাওয়ার কারণে পরের দিন রোজা রাখতে হবে কিনা এ বিষয়ে কেহ কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারল না। এতে শহরের এক বুজুর্গের পরামর্শেক্রমে সকালবেলা কয়েকজন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোক আমার ঘরের সামনে এসে জানতে চাইলে উত্তরে বললাম, আমার মহান শিশু আজ সকাল থেকে মোটেও স্তন্য দুধ পান করতেছেন না। এতে আমার মনে হচ্ছে আজ রমজান মাসের পহেলা তারিখ। আমার কথায় অবগত হয়ে আজ থেকে এ শহরে সবাই রোজা রাখা শুরু করে।
হযরত পীরানে পীর (রহ.) উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের লক্ষে নিজ জন্মভূমি গিলান অঞ্চল থেকে বাগদাদে গমন করেন। তথায় নিজামিয়া মাদ্‌রাসা থেকে সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন। এবাদতবন্দেগীতে নিজেকে মশগুল রাখতেন। বছরের পর বছর এশারের নামাজের অযু দ্বারা ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। বহু বছর রাত্রিকালে নফল নামাজে দাড়িয়ে কুরআন মাজীদ খতম করেছেন।
হযরত পীরানে পীর (রহ.) সর্ব প্রথম তৎকালীন মহান ওলি হযরত শেখ আবু সাঈদ মাখযূমী (রহ.)’র হাতে বায়াত হন। অল্প দিনের ব্যবধানে তিনি রুহানী এলমেও অতি উচ্চস্তরে উঠে যান।
কিছুদিন তিনি বাগদাদ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান।ঐ সময় ইসলামের ঘোর দুর্দিন ছিল। খলিফাগণ ভোগ বিলাসে ও সুখ সম্বোগে মগ্ন এবং রাজ্য বিস্তারের মোহেমত্ব। সাধারণ মুসলমানগণ ইসলামী ভাব ধারা হতে বহুদূর সরে পড়েছিলেন।
মোতাযেলা ও বেদাতী সম্প্রদায়ের সৃষ্ট নানা প্রকার কুসংস্কারে দেশ অচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। দুনিয়ার আলেমগণ ইসলামের সনাতন ন্যায়-নীতিকে বিসর্জন দিয়ে ইসলামকে বিকল ও বিকৃত করে রেখেছিলেন। এমন সময়ে হযরত বড় পীর (রহ.) যাহেরী ও বাতেনী এলমে পূর্ণতা লাভ করেন। মৃতপ্রায় ইসলামকে সজীব করে তোলার জন্য আল্লাহ পাকের ইঙ্গিতে পুনরায় বাগদাদে আবির্ভূত হলেন।
হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)’র পীর হযরত শায়খ আবু সাঈদ মাখযূমী (রহ.) একজন জগৎশ্রেষ্ঠ আলেম ও কামেল ওলি ছিলেন। তিনি বাগদাদে একটি মাদ্‌রাসা প্রতিষ্ঠা করে নিজেই উহাতে শিক্ষকতা করতেন। হযরত বড় পীর (রহ.) বাগদাদে এসে পৌঁছলে হযরত আবু সাঈদ (রহ.)’র নিতান্ত আগ্রহ সহকারে তাঁর মাদ্‌রাসার শিক্ষকতা ও পরিচালনার ভার হযরত বড় পীর (রহ.)’র হাতে অর্পণ করেন। হযরত বড় পীর (রহ.)ও ইসলামের খেদমতের জন্য প্রথমে এই পথে চলা সমীচিন মনে করেছিলেন।
তিনি শৈশবেই নিজের অস্তিত্ব ও আমিত্ব ভূলে গিয়ে নফসের কামনা বাসনাকে সম্পূর্ণরূপে দমন করে আল্লাহ তালার সহিত অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে। আল্লাহ তালার বিধি নিষেধ পূর্ণরূপে মেনে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলীন করে দেন। তৌহিদ ভাবের মধ্যে সর্বদা বিভোর হয়ে থাকতেন। শৈশবকালে এমন উচ্চতর অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া তাঁর শ্রেষ্ঠ কারামত। তারপরও তাঁর বহু অলৌকিক কার্যাবলি বহু পুস্তকে উদ্বৃত দেখা যায়।
মূলতঃ বিশ্বের ইতিহাসে পীরানে পীর বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)’র এত বেশি কারামত বিভিন্ন গ্রন্থে লিখিত রয়েছে যে, তা আর কারও আছে বলে মনে হয় না। তিনি ওলিগণের সর্দার, পীরগণের পীর, ইমামগণের ইমাম হিসেবে জনগণের কাছে স্বীকৃত।
ইরাকের রাজধানী জ্ঞান বিজ্ঞানের নগরী ছিল বাগদাদ। ইমামে আযম আবু হানিফা (রহ.)সহ বহু বিশ্বখ্যাত ওলি দরবেশ এ বাগদাদে শায়িত। বিশেষত হযরত জুনায়েদ বোগদাদী (রহ.), হযরত ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.), হযরত বাহলুল দানা (রহ.), হযরত মারুফ কারখী (রহ.), হযরত মনছুর হাল্লাজ (রহ.), হযরত সাহাবউদ্দীন সোহরওয়ার্দী (রহ.), আবু বকর শিবলী (রহ.) এ বাগদাদে শায়িত।
হযরত মাখজুমী ছিলেন হযরত আবুল হাসান আলী (রহ.)’র খলিফা। এদিকে পীরানে পীর (রহ.) তথায় শিক্ষকতা করতেন। এতে শুধু বাগদাদ নয়, তাঁর নিকট জ্ঞানার্জনের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে জ্ঞান পিপাষুরা আসতে শুরু করে। এতে তিনি ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিতেন-বিশেষ করে তাফসীর, হাদীস, আদব, উসূল, কাওয়ায়েদ,আক্বায়েদ আদব-কায়দা, আচার-ব্যবহার ইত্যাদি। প্রথম দিকে তিনি শাফী মাজহাব মতাবলম্বী ছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর থেকে শিক্ষা গ্রহণকারীদের মধ্যে রয়েছে শত হাজার জ্ঞানী ওলি দরবেশ। এদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় মাদ্‌রাসার মাঠে, নিকটতম ঘরসমূহের ছাদে এমনকি সড়কের উপরে জ্ঞানার্জনকারীরা অবস্থান নেন।
হযরত পীরানে পীর (রহ.) আড়ম্বরপূর্ণ উত্তম পোশাক পরিধান করতেন। তিনি সহজে মানুষের হাদিয়া গ্রহণ করতেন না। কেউ কিছু দিলে অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। বাগদাদের খলিফা মনসুরের পুত্র ইউসুফ এক থলি স্বর্ণ মুদ্রা উজিরের মাধ্যমে পাঠান, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। সপ্তাহে ৩ দিন নসিহত করতেন। শুক্রবার জুমার পর মসজিদ প্রাঙ্গণে, শনিবার রাতে মাদ্‌রাসা প্রাঙ্গনে, বুধবার বাদ ফজর ঈদগা ময়দানে। খলিফা থেকে আরম্ভ করে জ্ঞানী-গুণী, আলেম-ফাজেল, সুফি-দরবেশ, ইহুদি-খ্রিস্টান-মুশরিক, কুলি-মজুর লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত। তাঁর নসীহত শুনতে শুনতে হাজার হাজার মানুষ আত্নহারা হয়ে যেত।
হিজরি ৫২১ সাল থেকে হিজরি ৫৬১ সাল পর্যন্ত শিক্ষা দীক্ষা কাজে মশগুল ছিলেন। তাঁর অসংখ্য কারামতের মধ্যে ইহা একটি ছিল যে, সে সময় হাজার হাজার শ্রোতা সামনে পেছনে সবাই এক সমান আওয়াজ শুনতে পেত।
হযরত আবদুল কাদের জিলানী অনেক অমূল্য গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। তৎমধ্যে কয়েকটি হল-(১) গুন্‌ইয়াতুত ত্বালেবীন (২) আল-ফাত্‌হুর-রাব্বানী (৩) ফুতহুল গুয়ুব (৪) হিযবুল বোশাইরী (৫) জিয়াউল খাতির (৬) আল-মাওয়াহিবুর-রাহমানিয়া (৭) ওয়াকেয়াতুল হিকাম (৮) আল- ফায়েদাতুর রাব্বানিয়া ফিল-আওরাদিল কাদিরিয়া (৯) বাহ্‌জাতুল আসরার।
অধিকাংশ জ্ঞানীগুণী লেখকেরা তাঁকে অতি উচ্চ মর্যাদাবান ব্যক্তি বলে উল্লেখ করে গেছেন এবং তাঁকে নানান লক্ববে ভূষিত করেন। তৎমধ্যে ওলি দরবেশগণের সুলতান অন্যতম। যথা- পীরানে পীর, তথা পীরগণের পীর।
তাঁর কারামতের (কেরামত) ভান্ডার বিশাল। সে সময় এবং পরবর্তী কালেও আহলে হাদীস পন্থিরা তাঁর কারামতের বিশালত্ব নিয়ে দ্বিমত পোষণ করতে সাহস করেননি। তবে তাদের পক্ষ থেকে একটি যৌক্তিকতা গ্রহণযোগ্য রয়েছে। তা হল পীরানে পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) সারা জীবন ইসলামের খেদমত করে গেছেন। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ের প্রচারের চেয়ে কারামতের প্রচারটা হয় বেশি।
তিনি জীবনের শেষ বয়সে বাগদাদ থেকে জন্মভূমি গিলানে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাগদাদবাসীর অতি আবদার অনুরোধ উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি। বিশ্বখ্যাত মহান ওলি পীরানে পীর ৫৬১ হিজরি ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দে ১১ রবিউস সানি প্রায় ৯১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। বাগদাদ নগরীর প্রাণকেন্দ্রে বিশাল মাজার কমপ্লেক্স নিয়ে শায়িত।
যেয়ারত:
১৯৯৭ সালে হজ্বের পর যেয়ারতের উদ্দেশ্যে জেদ্দা থেকে আম্মান হয়ে সড়কপথে বাগদাদ গমন করার সৌভাগ্য হয়। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কর্তৃক কুয়েত দখল করে। আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের সম্মিলিত আক্রমণে সাদ্দাম হোসেন কুয়েত ছাড়তে বাধ্য হয়। বিশ্বখ্যাত ইরাকের সেনাবাহিনীকে ইজ্জত সম্মান বিসর্জন দিয়ে কুয়েত ছাড়তে হয়। ইরাক পড়ে চরম অবরোধে। এমনি অবস্থায় জর্ডানের রাজধানী আম্মান থেকে ৯৫০ কি.মি দীর্ঘ সড়কপথে প্রায় ২২ ঘণ্টা এক নাগাড়ে বাসে যাত্রা করে সপ্তাহখানেকের প্রোগ্রামে বাগদাদ পৌঁছতে সক্ষম হই।
হযরত পীরানে পীর বড় পীর (রহ.)’র মাজার কমপ্লেক্স এর ৩/৪ শ’ মিটার দূরত্বে একটি হোটেলে অবস্থান করি আমরা ১৮ জন বাংলাদেশী যেয়ারতকারী। ফলে নিয়মিত এখানে আসা হত যেয়ারতের উদ্দেশ্যে। বাম পাশ সংলগ্ন তাঁর মাজার, ডানপাশ সংলগ্ন প্রকান্ড মসজিদ। এ বিশাল মাজার কমপ্লেক্সে রয়েছে তাঁর পরিবারবর্গের কবরস্থান, মাদ্‌রাসা, মেহমানখানা, অফিসাদী।
এখানে অবস্থানকালে বৃহত্তর বাগদাদের পাশাপাশি কুফা, নজফ, কারবালা, কাজেমাইন, মসূল গমন করা হয়েছিল যেয়ারতের উদ্দেশ্যে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধহৈমন্তিকা