প্রত্ননিদর্শন দর্শনে ভ্রমণ

রফিক আহমদ খান | সোমবার , ১৩ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৮:৫৭ পূর্বাহ্ণ

দেয়াঙ পরগণাখ্যাত চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা প্রত্নসম্পদে ভরা এক ঐতিহাসিক জনপদ। কর্ণফুলী উপজেলাও দেয়াঙ পাহাড় ঘেঁষা। দেয়াঙ পাহাড়কে ঘিরেই বিস্তৃতি ঘটে এই জনপদের। আনোয়ারা-কর্ণফুলী দুই উপজেলা ভৌগোলিক অবস্থানে অনন্য রূপ ও গুণের অধিকারী। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণকূল ঘেঁষে এই দুই উপজেলার অবস্থান। শুধু কি কর্ণফুলী নদী? আনোয়ারার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরের উপকূল- আনোয়ারার গহিরা, রায়পুর, পারকিসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। আনোয়ারার দক্ষিণে বয়ে গেছে শঙ্খ নদী। পূর্বে চানখালি ও ইছামতি খাল। অর্থাৎ এই আনোয়ারার চারপাশ সাগর, নদী, খালে ঘেরা। মাঝখানে-তার সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত খুঁটি ‘দেয়াঙ পাহাড়’। যে দেয়াঙ পাহাড়ে ঝিওরি অংশে হাজার বছর আগে পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল বলে মনে করেন ইতিহাস-গবেষকরা। এই বিস্তীর্ণ দেয়াঙ পাহাড়ের দক্ষিণাংশে বিশ শতাব্দীর আশির দশকে স্থাপন করা হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর রাডার কেন্দ্র। আমাদের স্কুল চাঁপাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আমরা ঘুরে বেড়াতাম দেয়াঙ পাহাড়ের বুক জুড়ে। পাহাড় ঘেঁষা আমাদের স্কুল। সম্ভবত আটাশি সালের দিকে। হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় পাহাড়ে উঠা। পাহাড়ে ছোটাছুটি করা। কারণ এখানে রাডার কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। বিমান বাহিনীর সদস্যরা তখন কর্ণফুলীর ওপাড়ে বিমানঘাঁটি থেকে প্রতিদিন কয়েকবার করে পাহাড়ে আসা-যাওয়া করতেন বিমানে। আমরা বিমান উঠানামার দৃশ্য দেখতাম দূর থেকে। বিমানের পাখার হাওয়ায় পাহাড়ের ছোটো-ছোটো গাছের দোল খাওয়া দেখতাম। এভাবেই দেয়াঙ পাহাড়ের বিরাট একটি অংশ সংরক্ষিত একালায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল চোখের সামনে ; যে দেয়াঙে আমরা হেঁটেছি, খেলেছি, ঘুরেছি- আমাদের শৈশবে। বর্ষা শেষে শরত-হেমন্তে কুড়িয়েছি জীবন্ত নুড়িপাথর। সে জীবন্ত নুড়িপাথরগুলো এখন আর নেই। কারণ দেয়াঙ-এর বুক এখন ক্ষতবিক্ষত। আমাদের গ্রামও দেয়াঙের পাদদেশে।
দেয়াঙের উত্তর পাশে বিশ শতাব্দীর একেবারে শেষ দিকে শুরু হয় কোরিয়ান ইপিজেড স্থাপনের কাজ। যেখানে এখন বিভিন্ন কলকারখানায় জীবিকা অর্জনে নিয়োজিত আছেন প্রায় অর্ধ লক্ষ নারী-পুরুষ। উত্তর বন্দর এলাকায় দেয়াঙ-এর পাদদেশেই এদেশের নৌপ্রকৌশল শিক্ষার উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘মেরিন একাডেমি’র অবস্থা। দেয়াঙের দক্ষিণ পাশে রাডার কেন্দ্রের বাইরে যে-জায়গাটুকু খালি ছিল সেখানে এখন চায়না অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠছে। আরো দক্ষিণে একেবারে পাহাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের আরেক বিদ্যাপীঠ বটতলী শাহ মোহছেন আউলিয়া কলেজ। যেখানে আমরা উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছি। বলতে গেলে দেয়াঙ পাহাড় পাদদেশে আনোয়ারাবাসী সরাসরি উপকার ভোগের প্রধান প্রতিষ্ঠান এই কলেজ। কলেজটিতে অনার্স কোর্স চালুসহ সরকারিকরণ করা এখন সময়ের দাবী। এক ফাঁকে বলে রাখলাম এই প্রাণের দাবীর কথা।
দেয়াঙ অঞ্চল অত্যন্ত গৌরবোজ্জল ঐতিহ্যের অধিকারী। হাজার বছরের অধিক সময়ে এখানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, শাসক শ্রেণি গড়ে তোলে অসংখ্য ইমারত, প্রাসাদ, দুর্গ, মন্দির, মসজিদ, দিঘি ও সমাধিসৌধ। এসব ঐতিহ্যের অধিকাংশই পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কালের গর্ভে বিলীন হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংস্কৃতি চিহ্ন দেয়াঙের বিভিন্ন এলাকায় আজও টিকে আছে; যা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে সমধিক পরিচিত। এসব প্রত্ননিদর্শনের অনুসন্ধানে সদা নিজেকে নিয়োজিত রাখেন এমন ব্যক্তিত্বদের একজন ইতিহাস-গবেষক জামাল উদ্দিন। সচরাচর আমরা ঘুরে বেড়াই বিনোদনের জায়গায়। আনোয়ারায় এমন বিনোদনমূলক জায়গা পারকি সৈকত, গহিরা প্যারাবন ও সৈকত। এছাড়াও শঙ্খ নদীর পাড় ও ইছামতির পাড়। কিংবা ইছামতিতে নৌকোয় চড়ে ঘুরে বেড়ানো। সেদিন ছিল বসন্তের মধ্যফাগুনের দিন। ১ মার্চ ২০২১ সোমবার। সারাটাদিন আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি আনোয়ারা-কর্ণফুলীর নানা প্রত্নসম্পদ দেখতে-দেখতে। সে এক চমৎকার দিন কাটিয়েছি আমরা।
প্রথমেই আমাদের গাড়ি প্রবেশ করে কোরিয়ান ইপিজেডের উত্তর গেইট দিয়ে দেয়াঙ পাহাড়ে। কোরিয়ান ইপিজেডের মনোরম সড়ক দিয়ে পথ চলতে চলতে আপনার মনে হবে এটা কোন দেশে এলাম! বিদেশ নয় তো? হ্যাঁ, এমনই চমৎকার সুন্দর কোরিয়ান ইপিজেডের ভেতরের সড়কগুলো। আনোয়ারার বাইরের মানুষ আমাদের দলের অন্যতম সদস্য লেখক-গবেষক শিমুল বড়ুয়া, কবি শেখ ফিরোজ আহমদ ও লেখক রেবা বড়ুয়া সেই মুগ্ধতার কথা বারবার প্রকাশ করেছেন। প্রথমেই আমরা গেলাম ‘মরিয়ম আশ্রম’। শতবছরের অধিক পুরানো প্রার্থনালয়, পল্লী, স্কুল, জপমালার বাগান, সাংস্কৃতিকমঞ্চ, বিশালকার মাঠসহ চট্টগ্রামের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বনকারীদের ঐতিহ্যবাহী এক স্থান এই মরিয়ম আশ্রম। কোরিয়ান ইপিজেড অঞ্চলের ভেতরে থাকলেও ঐতিহ্যবাহী স্থানটি খ্রিস্টানদের দখলেই আছে। মরিময় আশ্রম দেখা শেষ করে আমরা গেলাম ঐতিহাসিক ‘চাঁদ সওদাগরের দিঘি’ দেখতে। পৌরাণিক কাহিনি ‘মনসা-মঙ্গলের কাহিনি’তে উল্লিখিত চাঁদ সওদাগরের দিঘি এটি। ছায়াশীতল দিঘির পাড়ে ছবি তোলাতুলি করে আর পাশে উত্তর বন্দর গ্রামের খোট্টা গোষ্ঠীর খোট্টাভাষা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করলাম। বিশেষ করে আমাদের দলের অন্যতম সদস্য ঢাকা থেকে আগত বাবু ভাইকে (কবি ও নাট্যনির্দেশক শেখ ফিরোজ আহমদ) খোট্টাভাষা সম্পর্কে ধারণা দিলাম আমরা। চাঁদ সওদাগরের দিঘি ও খোট্টাদের গ্রাম আমাদের বৈরাগ ইউনিয়নে হলেও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই চাঁদ সওদাগরের দিঘি প্রথমবার দেখতে গিয়েছিলাম মাত্র ছয় মাস পূর্বে, তা-ও আরেক শিক্ষাবিদ-লেখক শামসুদ্দিন শিশির-এর সাথে। তাই বিজ্ঞ জামাল ভাইয়ের সাথে আমারও কিঞ্চিত ধারণা থাকায় আগত নতুন অতিথিদের সাথে একটু পণ্ডিতিভাব দেখাতে পেরেছি আর কী! বাবু ভাইকে জানালাম যখন আপনাদেরকেও সামান্য জানানো দরকার খোট্টা গোষ্ঠী সম্পর্কে। খোট্টারা নিজের মধ্যে কথা বলেন খোট্টা ভাষায়। যা আমরা একদমই বোঝতে পারি না। তবে যখন আমাদের সাথে কথা বলেন তখন চট্টগ্রামে আঞ্চলিক ভাষা বা প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তাদের পড়ালেখাও আমাদের সাথে। শুধু নিজেদের মধ্যে কথা বলেন নিজেদের ভাষায়। যে ভাষা এখনো প্রচলন আছে তাদের মাঝে। চট্টগ্রাম কলেজে পড়ালেখা করেন এমন এক শিক্ষার্থী সাথে কথা বলেছি। আমরা বাংলা ভাষায় প্রশ্ন করেছি, সে উত্তর দিয়েছে সম্পূর্ণ খোট্টা ভাষায়। পরে অবশ্যই তরজমা করে দিয়েছিলেন তিনি। এতে বুঝেছি, তারা তাদের নিজস্ব ভাষাকে ভালোবাসেন গভীরভাবে। ঐতিহ্য হিসেবেই হৃদয়ে ধারণ করে রেখেছেন নিজস্ব মাতৃভাষাটি। চট্টগ্রামের ভাষাকে যদি আঞ্চলিক ভাষা বলি, খোট্টা ভাষাকে আমরা একটি উপভাষা বলতে পারি। এটা এখানে বড় কোন জনগোষ্ঠীর ভাষা নয়, ছোট্ট একটা গ্রামের জনগোষ্ঠীর ভাষা। তারা নিজেদের ভারতের বেনারস থেকে আগত বলে জানান। গবেষক জামাল উদ্দিনের মতে খোট্টারা মোগল সৈনিক ছিলেন। পাশের গ্রামের স্থানীয় শিক্ষিত মুরুব্বিদের মত ভিন্ন। তাই কোনটা যে সত্যি তা জানতে হলে ইতিহাসের বই পড়তে হবে। এ-সব ইতিহাসের সত্যতা জানতে হলে একই বিষয়ে একাধিক বই পড়া দারকার। এটা শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বটে। জামাল উদ্দিনের ‘দেয়াঙ পরগণার ইতিহাস’ গ্রন্থটিও পড়তে পারেন খোট্টা গোষ্ঠীর ইতিহাস জানতে।
চাঁদ সওদাগরের দিঘির পাড় থেকে কাছেই কিল্লার পাহাড়। দিঘির পাড় থেকে একটু হেঁটে পাহাড়ে ওঠার পর দেখা গেলো চার টিলার মাঝখানে থলেতে মাটি কেটেকুটে মাঠ বানিয়ে ফুটবল খেলছে স্থানীয় কিশোরেরা। তাদের কাছে কিল্লার পাহাড় কোন দিকে জিজ্ঞেস করতেই তারা হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল। ওদের একজনকে আমাদের সাথে আসার অনুরোধ করলে দেখি খেলা ভেঙে পুরোদলই আমাদের পথ দেখাতে ছুটে এল। বোঝা গেলা তারা ইতোমধ্যে খেলতে খেলতে ক্লান্ত প্রায়। তাই সহজেই খেলা ভেঙে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এলো। তাদের সাথে উঠলাম কিল্লার পাহাড়। এই কিল্লার পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বিস্মিত হলাম চট্টগ্রাম বন্দরের কয়েকশো বছর পুরোনো এক স্মৃতিচিহ্ন দেখে। খুব পুরোনো এক দালান দাঁড়িয়ে আছে এখানে। যেটি স্থানীয়ভাবে বওটা লরি নামে পরিচিত। বওটা শব্দের প্রমিত শব্দ পতাকা, লরি অর্থ নড়াচড়া। অর্থাৎ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে দেশি-বিদেশি জাহাজের যাওয়া-আসার সময় এই পাহাড় থেকে বিশালাকারের বিভিন্ন পতাকা নড়াচড়া করে নানা সংকেত দেওয়া হতো জাহাজ চালকের উদ্দেশ্যে। পতাকার সংকেত পেয়েই তখন চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজের প্রবেশ ও বহিঃ গমন হতো। এই বওটা লরি আমাদের প্রত্নসম্পদের অংশ বিশেষ নিঃসন্দেহে। দুঃখের বিষয় এই প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণে দেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কোনো উদ্যোগ নেই বলে মনে হয়েছে। সেখানে ভবনে উপরে উঠে দেখা গেলো আরামে বিভোরে ঘুমিয়ে আছেন এক মাদকসেবি। স্থানীয় কয়েকজন জানালেন, সন্ধ্যা নামলে ভবনটি মাদকাসক্তদের আখড়ায় পরিণত হয়। এমন একটি নিদর্শন এখানে আছে সে খবর আমাদের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আছে কি-না জানি না। সেখান থেকে খোট্টা পাড়ার দিকে নিচে নামার সময় দেখলাম পাহাড়ের পাদদেশে বড়প্রস্তের বিশাল প্রাচীর। এই সীমানাপ্রচীর বা পাহাড়রক্ষা দেয়াল-টাও প্রত্নসম্পদ বলে মনে হলো। (চলবে)

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিজয় মঞ্চে শিশু কিশোরদের নৃত্য ও সঙ্গীত প্রতিযোগিতা
পরবর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল