প্রতিযোগিতাই দুর্ঘটনা ঘটায়

নিসচার চালক সমাবেশে ইলিয়াস কাঞ্চন ।। শুধু সড়ক নয়, ফুটপাতের নিরাপত্তা চাওয়ারও সময় এসেছে : আজাদী সম্পাদক ।। এক বছরে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে পাঁচ হাজার। এর মধ্যে চালক ১২শর বেশি

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৬ অক্টোবর, ২০২১ at ৯:৫১ পূর্বাহ্ণ

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা এবং নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছেন, জীবন একটাই, এই একটি জীবনকে নিরাপদ রাখতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। পরিবহন শ্রমিক এবং চালকদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আপনি মরে গেলে কেউ আপনার খবর নেবে না, আপনার পরিবারের খোঁজ নেবে না। তাই নিজের জন্য, পরিবারের জন্য আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে। আপনাকে সচেতন থাকতে হবে। গত বছরের পরিসংখ্যান উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজারের মতো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এরমধ্যে ১২শ’ জনেরও বেশি হচ্ছে চালক। চিন্তা করতে পারেন! এক বছরে ১২শ’ চালক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। অথচ একটু সচেতন হলে, সতর্কতার সাথে গাড়ি চালালে এসব দুর্ঘটনার অধিকাংশই ঠেকানো যেতো। তিনি গতকাল শুক্রবার বিকেলে নগরীর দক্ষিণ খুলশী বিজিএমইএ ভবনস্থ মাহাবুব আলী হলে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত ‘গতিসীমা মেনে চলি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করি’ শীর্ষক গাড়ি চালক সমাবেশে প্রধান বক্তার বক্তব্যে এসব কথা বলেন। সংগঠনের সভাপতি, বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহ সভাপতি এস এম আবু তৈয়বের সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক।
সমাবেশে পরিবহন মালিক এবং চালক সমিতির নেতৃবৃন্দের সড়কের বেহাল দশার বর্ণনার সাথে একমত প্রকাশ করে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সব রাস্তাতো খারাপ নয়, ভালো রাস্তাও তো আছে। সেখানেও তো দুর্ঘটনা ঘটছে। স্ত্রী মৃত্যুর পর গত ২৮ বছর ধরে তিনি নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সাথে থাকার কথা উল্লেখ করে বলেন, ওই সময় দেশের মানুষ ছিল সাড়ে দশ কোটি। গাড়ি ছিল কয়েক হাজার। হাইওয়ে ছিল ৫/৭ হাজার কিলোমিটার। আঞ্চলিক সড়ক তেমন একটা ছিল না। গত ২৮ বছরে আমাদের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। এখন আমাদের হাইওয়ে প্রায় ২৫ হাজার কিলোমিটার। আঞ্চলিক সড়ক রয়েছে পৌনে দুই লাখ কিলোমিটার। গাড়ির সংখ্যাও বেড়েছে অনেক। তবে আশার কথা হচ্ছে, মানুষ বেড়েছে, রাস্তা বেড়েছে, যানবাহন বেড়েছে, তবে দুর্ঘটনার পরিমাণ আগের চেয়ে কমছে। আপনারা সচেতন হলে দুর্ঘটনা আরো কমে যাবে।
তিনি বলেন, আগে যখন রাস্তা বানানো হয়েছে তখন এত ভারী ভারী পণ্য নিয়ে ট্রেইলর চলার কথা মাথায় ছিল না। কেউ হয়তো ভাবেনি। রাস্তা বানানো হয়েছিল বাস ট্রাক বা প্রাইভেট গাড়ির কথা চিন্তা করে। এখন ওই রাস্তায় ধারণক্ষমতার বেশি ওজনের গাড়ি চলতে গিয়ে গর্ত হচ্ছে, রাস্তা নষ্ট হচ্ছে। ভবিষ্যতে রাস্তা বানানোর সময় নিশ্চয় ট্রেইলরের কথা মাথায় রাখা হবে। এসব সমস্যারও সমাধান হবে। কিন্তু আমরা আপনারা সচেতন না হলে শুধু রাস্তা ভালো হলেই জীবন বাঁচবে না।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সড়কের এবং গাড়ির অবস্থা বর্ণনা করে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, উন্নত দেশগুলোতে শুধুমাত্র একজন চালকই গাড়ি চালান, কোনো হেলপার নেই। ভাড়া গাড়িতেই বঙ দিতে হয়, সেনসরে কার্ড বা টিকেট ছোঁয়ালেই ভাড়া পরিশোধ হয়। একজন চালক নির্দিষ্ট সময়ের পরে গাড়ি চালান না, অন্য চালক গাড়িতে উঠেন। অথচ আমাদের দেশে কি করে ট্রিপ বাড়ানো যায়, কি করে কার আগে যাওয়া যায় তার প্রতিযোগিতা চলে। আর এসব প্রতিযোগিতাই দুর্ঘটনা ঘটায়, মৃত্যু ডেকে আনে। তিনি বলেন, সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে, মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। মানসিকতার পরিবর্তন হলে অন্যান্য অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে যাবে।
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, যানবাহন সব সময়ই নিয়ন্ত্রণ করে চালাতে হবে। নিয়ন্ত্রণহীন গতি মানুষের জীবনের গতিই থামিয়ে দিতে পারে। কারণ অনিয়ন্ত্রিত গাড়ির গতি দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আমার আপনার সকলেরই দায়িত্ব আছে। কেবল এক পক্ষের ওপর দায় চাপালে হয় না। যাত্রী বা পথচারী হিসাবে আমার নিজেরও কিছু দায়িত্ব আছে। আমি আমার দায়িত্ব পালন করলেও দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমবে। আমাদের সকলকে সব জায়গায় নৈতিকতার পরিচয় দিতে হবে। আমি আমার জায়গায় নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করলে অনেক সমস্যাই সমাধান হয়ে যায়। সড়ক দুর্ঘটনাও একটি সমস্যা। আমি নিজে সচেতন, দায়িত্বশীল ও নৈতিকতার পরিচয় দিলে দুর্ঘটনা কমবে।
সমাবেশে চালকদের মা এবং স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে সাধুবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, আপনার স্বামী কিংবা সন্তান যখন গাড়ি চালাতে যান তখন তাকে ফোন করে উত্তেজিত করার মতো কিছু বলবেন না। ঘর থেকে বেরুনোর সময়ও এমন কিছু বলবেন না যাতে তিনি ক্ষুদ্ধ হন, বিক্ষুদ্ধ হন। সংসারের বহু খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয়ও তাকে গাড়ি চালানোর সময় জানাবেন না। বাসায় ফেরার পর প্রথমে তাকে আদর যত্ন করে খেতে দিন। পরে ধীরে সুস্থে সংসারের কোনো সমস্যা থাকলে তা বলুন। এতে তার জীবন বাঁচবে, জীবন বাঁচবে অনেকের। গাড়ি চালানোর সময় ফোনে তাকে উত্তেজিত করলে, কোনো খারাপ খবর জানালে তিনি দুর্ঘটনা ঘটাতে পারেন। একটি দুর্ঘটনা ঘটানোর জন্য এক সেকেন্ডেরও কম সময় লাগে বলেও ইলিয়াস কাঞ্চন মন্তব্য করেন।
সমাবেশের প্রধান অতিথি দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেছেন, এই চট্টগ্রামের রাস্তায় যত গর্ত আছে, পুরো পৃথিবীর রাস্তায় এত গর্ত আছে কিনা সন্দেহ। উন্নত বিশ্বের কথা বাদ দিন, আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতেও রাস্তায় কোনো গর্ত নেই। খানাখন্দে ভরা এই ধরনের রাস্তায় যান চলাচল নিরাপদ রাখতে অনেক বেশি সচেতনতা দরকার। আর সেটিরই বড় অভাব। তিনি বলেন, রাস্তা একটি জড় পদার্থ। রাস্তা কাউকে আপদে ফেলতে পারে না। এই রাস্তার সাথে আপদ যুক্ত করছি আমি, আপনি, আমরা। আমরা প্রত্যেকে যদি আইন মানি, নিজেকে শুধুমাত্র নিজেকেই আইন মেনে চলাচল করি তাহলে সড়ক বহু বেশি নিরাপদ হয়ে উঠবে। তিনি বলেন, শুধু সড়কই নয়, ফুটপাতের নিরাপত্তা চাওয়ারও সময় এসেছে। এই নগরীতে ফুটপাতে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মারা গেছে। আরো হতভাগা একজনেরও তো লাশই খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফুটপাতে পড়ে একজন মানুষ পানিতে তলিয়ে গেলেন, অথচ পরিবার তার লাশটিই খুঁজে পেল না। এর থেকে বড় দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে! এই ধরনের ঘটনার জন্য সিটি কর্পোরেশন বা সিডিএকে দায়ী না করে তিনি নিজেকেই দায়ী করেন এবং দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে এই ধরনের অব্যবস্থাপনা এবং অনিয়ম নিয়ে প্রচুর সংবাদ এবং লেখা আমরা প্রকাশ করেছি। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য আমি সংশ্লিষ্টদের কাছে তা পৌঁছাতে পারিনি, তারা সচেতন হননি, ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। আমি যদি যথাযথভাবে তাদের শোনাতে পারতাম তাহলে এই ধরনের অঘটন ঘটতো না। ফুটপাতে হাঁটতে গিয়ে নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কিংবা ব্যবসায়ী মারা যেতেন না।
তিনি শুধুমাত্র নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে চালকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনার সন্তানের জন্যই আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে। আপনার পরিবারের জন্য আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে। আপনি নিজের নিরাপত্তার জন্য, নিজে বেঁচে থাকার জন্য সচেতন হয়ে সুষ্ঠুভাবে গাড়ি চালালে অনেক অঘটনই ঘটবে না। আপনি, আপনার প্রতিবেশি, সমাজ এবং দেশ নিরাপদ থাকবে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ এনামের সঞ্চালনায় সমাবেশ বিশেষ অতিথি ছিলেন বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেডের পরিচালক লায়ন মোহাম্মদ হাকিম আলী, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন (বেলাল), বাংলাদেশ অটোরিঙা হালকা যান পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন। স্বাগত বক্তব্য দেন, নিরাপদ সড়ক চাই চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক শফিক আহমেদ সাজীব। ধন্যবাদ বক্তব্য দেন, নিরাপদ সড়ক চাই চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আন্‌জুমান আরা বেগম।
অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নিরাপদ সড়ক চাই চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক আরশাদুর রহমান, নির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ মনজুরুল কিবরিয়া, সাবেক কাউন্সিলর রেখা আলম চৌধুরী, সনত তালুকদার, রেজাউল করিম রিটন, লায়ন মোহাম্মদ ইব্রাহিম, লায়ন আব্দুল মান্নান প্রমুখ।
সভাপতির বক্তব্যে এস এম আবু তৈয়ব বলেন, আমার চালক ভাইয়েরা অনেক স্মার্ট। তাদেরকে আরো স্মার্ট হতে হবে। তাদেরকে ‘সরি’ বলতে শিখতে হবে। মালিক যখন ট্রিপ বাড়ানোর কথা বলবেন, মালিক যখন দ্রুত কোথাও যাওয়ার জন্য বলবেন, মালিক যখন আনফিট গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামতে বলবেন তখন আমার চালক ভাইকে ‘সরি’ বলতে হবে। এই ‘সরি’ই তাকে বাঁচাবে, তার পরিবারকে বাঁচাবে, বাঁচাবে সমাজকে। দেশে চালকের চেয়ে যানবাহন বেশি বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরি বললে যদি এক জায়গায় চাকরি যায়, অনায়াসে অন্য জায়গায় চাকরি হবে। দেশের কোনো ড্রাইভারই চাকরির অভাবে নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বিশেষ অতিথি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, সচেতন হয়ে গাড়ি চালাতে হবে। একটি গাড়ির উপর অন্যের নয়, নিজের জীবনও নির্ভর করে। তাই সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। সচেতন হয়ে গাড়ি চালাতে হবে। একটি সড়ক দুর্ঘটনায় নানাবিধ কারণ ও সম্পর্ক থাকে। এর মধ্যে চালক, যাত্রী, পথচারী অন্যতম। তাই প্রত্যেককেই সড়ক দুর্ঘটনার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। কেবল এক পক্ষকে দোষারোপ করলে চলবে না। তিনি বলেন, পথচারীকে সচেতনভাবে রাস্তা পারাপার হতে হবে। কানে মোবাইল নিয়ে রাস্তা পার হলে দুর্ঘটনা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই পথচারীকে অবশ্যই সচেতন হয়ে সড়ক ব্যবহার ও রাস্তা পারাপার হতে হবে। আমাদের দেশে চালকদের আট ঘণ্টা গাড়ি চালানোর নিয়ম করতে হবে। সক্ষমতার বেশি গাড়ি চালালে চালকেরও সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
বিশেষ অতিথি লায়ন হাকিম আলী বলেন, গাড়ির অনিয়ন্ত্রিত গতি দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ। নিয়ন্ত্রিত গাড়ি চালালে সড়কে সিংহ ভাগ দুর্ঘটনা কমবে। তাই এখন গাড়ির গতি কমিয়ে জীবন বাঁচাতে হবে। গাড়ির গতিসীমা মেনে চলতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে। গাড়ির গতিসীমা মেনে চলতে হবে।
সমাবেশে মালিক ও শ্রমিক সমিতির নেতৃবৃন্দ রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, পুলিশী হয়রানি, ট্রো বাণিজ্যসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচবিতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ
পরবর্তী নিবন্ধসাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিরোধের আহ্বান কাদেরের