টুনা মাছ শিকারে পাঁচ বছরেও বিনিয়োগ করেনি ১৯ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান

হাসান আকবর

অবশেষে সরকারের কেনা দুটি জাহাজের একটি আসছে চলতি মাসে | শুক্রবার , ৩ মে, ২০২৪ at ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ

পাঁচ বছর আগে টুনা মাছ শিকারের জন্য ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয়া হলেও একটি প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে আসেনি। গভীর বঙ্গোপসাগরে টুনা মাছের সমৃদ্ধ মজুদের আশাবাদ বহু বছর ধরে শোনা গেলেও বাণিজ্যিকভাবে এই মাছ শিকারে বাংলাদেশের কোনো সাফল্য নেই। অথচ ভারত শ্রীলংকাসহ প্রতিবেশি দেশগুলো বিদেশে টুনা ফিশ রপ্তানি করে কোটি কোটি ডলার আয় করছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে না আসায় সরকারি উদ্যোগে দুইটি জাহাজ কিনে টুনা মাছ শিকারের ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হলেও নানা জটিলতায় তা পিছিয়ে যাচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারিতে দুইটি জাহাজ বাংলাদেশে আসার কথা থাকলেও আসেনি। অবশ্য কিছুদিনের মধ্যে একটি জাহাজ দেশে নোঙর করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে গতকাল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশ্ব টুনা ফিশ দিবস পালিত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাংলাদেশের একক মালিকানা রয়েছে। বিস্তৃত এলাকাজুড়ে এই এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন থাকলেও বিশাল এই সাগরে মাছ ধরার সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। বিস্তৃত এই এলাকার এক পঞ্চমাংশ এলাকাতেই কেবল বাংলাদেশের জাহাজগুলো মাছ শিকার করতে পারে। সাগরের ২৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার সাউথ প্যাচেস, সাউথ অফ সাউথ প্যাচেস, মিডল গ্রাউন্ড এবং সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডে মৎস আহরণ করা হয়। সমুদ্র উপকূল থেকে এসব অঞ্চলের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। সেখানে পৌঁছাতে দেশীয় জাহাজগুলোর ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা সময় লাগে। সাগরের এসব অঞ্চলের গভীরতা ১০০ মিটারের ধারে কাছে। এর থেকে বেশি গভীরতায় মাছ শিকারের সক্ষমতা বাংলাদেশী জাহাজগুলোর নেই বললেই চলে। অথচ টুনা ফিশসহ সমগোত্রের অন্যান্য মাছগুলোর বসবাস সাগরের অন্তত দুইশ’ মিটার গভীরে। এত গভীর থেকে টুনা ফিশ তুলে এনে তা রপ্তানি করার সক্ষমতা বাংলাদেশ ৫০ বছরের বেশি সময়েও অর্জন করতে পারেনি।

সূত্র জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশের জাহাজগুলো উপকূল থেকে ১০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত গিয়ে মাছ শিকার করতে পারে। অথচ টুনা ফিশের বিচরণ স্থলে যেতে হলে জাহাজগুলোকে পাড়ি দিতে হবে কমপক্ষে ৩৮০ নটিক্যাল মাইল। ওই অঞ্চলটি ভারত এবং শ্রীলংকার কাছাকাছিতে হওয়ায় তারা মাত্র ৪/৫ ঘণ্টার মধ্যে ওই অঞ্চলে পৌঁছাতে পারে, যেখানে আমাদের পৌঁছাতে ৪দিন সময় লাগবে। টানা চারদিন জাহাজ চালিয়ে ওই অঞ্চলে মাছ শিকার করতে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রচুর জ্বালানিসহ অনেক বিনিয়োগ প্রয়োজন। মাছের প্রকৃত অবস্থা না জেনে এতো অর্থ বিনিয়োগ করতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসছে না বলেও সূত্র মন্তব্য করেছে।

কাছাকাছিতে হওয়ায় ভারত, মালদ্বীপ এবং শ্রীলংকা অনায়াসে ওই অঞ্চল থেকে মাছ শিকার করছে। পাশাপাশি থাইল্যান্ড,

ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তানও গভীর সাগর থেকে প্রচুর টুনা মাছ শিকার করে। এসব দেশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে টুনা ফিশ রপ্তানি করে কোটি কোটি ডলার আয় করে।

বঙ্গোপসাগরের এঙক্লুইসিভ ইকোনমিক জোন এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় টুনাসহ পেলাজিক মাছের বিশাল ভান্ডার রয়েছে বলে বহুদিন ধরে ধারণা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময় ফিশিং ভ্যাসেলগুলোতে অন্যান্য মাছের সাথে কিছু টুনা মাছও উঠে আসে। তবে তা পরিমাণে কম হওয়ায় বিদেশে রপ্তানি হয় না। বঙ্গোপসাগরে টুনা মাছের বিশাল ভান্ডার থাকার ধারণা করা হলেও তা অধরা রয়ে গেছে। অথচ বহুদিন ধরে এই বিদেশ থেকে প্রচুর টুনা মাছ বাংলাদেশে আমদানি হচ্ছে। প্রক্রিয়াজাতকরণকৃত টুনা ফিশ ক্যান ভর্তি হয়ে দেশে আসছে। যা দেশের ধনিক শ্রেণি এবং অভিজাত রেস্তোরাঁগুলোতে বিক্রি হয়ে থাকে।

বঙ্গোপসাগরের টুনা মাছ শিকার এবং তা রপ্তানির জন্য সরকার বছর কয়েক আগে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সরকারি এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০১৯ সালে বেসরকারি ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় জাহাজ আমদানিসহ টুনা মাছ শিকারের অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু পাঁচ বছর গত হলেও ১৯টি কোম্পানির একটিও কোনো জাহাজ আমদানি বা সাগর থেকে একটি টুনা মাছও শিকার করেনি। অনুমোদন পাওয়া বেসরকারি একটি কোম্পানির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা অনুমোদন পেয়েছি একথা ঠিক। আমরা নিজেরাও কিছুটা এগিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু পরে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হওয়ায় পিছিয়ে গেছি। তিনি বলেন, সাগরে টুনা মাছের ভান্ডার থাকার কথা বলা হলেও কোনো বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা নেই। আসলে কত মাছ আছে বা আদৌ আছে কিনা তাও অজানা। এমন অনিশ্চিত একটি ব্যাপারে শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলেও তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, টুনা মাছ শিকারের উপযোগী এক একটি জাহাজের দাম ৫০ কোটিরও বেশি টাকা। এখন সরকার যদি নিজেদের উদ্যোগে জাহাজ কিনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতো তাহলে অন্যরা এগিয়ে আসতো বলেও তিনি মন্তব্য করেন। বেসরকারি ১৯টি কোম্পানির উপরোক্ত অবস্থার মাঝে সরকারের মৎস্য অধিদপ্তর নিজেরা জাহাজ কিনে সাগরে জরিপ এবং টুনা মাছ শিকারের উদ্যোগ নেয়। শুরুতে তিনটি জাহাজ কেনার কথা থাকলেও পরবর্তীতে ২৪ কোটি টাকায় দুইটি জাহাজের জন্য চীনের ইউনি মেরিন সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড নামের কোম্পানির সাথে চুক্তি করা হয়। বলা হয়েছিল গত ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাহাজ দুইটি দেশে পৌঁছাবে এবং মাছ শিকার শুরু করবে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত জাহাজ দুইটি আসেনি। তবে চলতি মাসের মধ্যে একটি জাহাজ আসছে বলে গতকাল মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে।

জাহাজটি দেশে পৌঁছালে গভীর সাগরে টুনা মাছ শিকারের জন্য ইতোমধ্যে ৩০ জন ক্রু নিয়োগ এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, টুনা মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বিশ্বে। বাংলাদেশেও প্রচুর টুনা মাছ আমদানি হয়। তবে তা মাছ আকারে না এসে প্রক্রিয়াজাত করে ক্যানে করে আনা হয়। জাপান এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে টুনা মাছের বিশাল বাজার রয়েছে।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) বেলাল হায়দার পারভেজ বঙ্গোপসাগরের গভীরে টুনাসহ পেলাজিক জাতীয় মাছের প্রচুর মজুদের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেন, বিভিন্ন সময় আমাদের জাহাজগুলোতে বেশ কিছু টুনা ফিশ ধরা পড়েছে। এগুলো দলছুট টাইপের টুনা ফিশ। সাগরের আরো গভীরে যেতে পারলে প্রচুর টুনা ফিশ শিকার করা সম্ভব হতো বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্বে ব্লু ইকোনমি অনেক বড় একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের সম্ভাবনা অনেক। সরকার এক্ষেত্রে নানা পরিকল্পনা এবং প্রকল্প গ্রহণ করছে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে ব্লু ইকোনমি আমাদের অর্থনীতির একটি বড় অংশকে সমৃদ্ধ করবে। তিনি টুনা ফিশ শিকারে সরকারের যে উদ্যোগ তা ব্লু ইকোনমি নিয়ে সরকারের লক্ষ্য অর্জনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও মন্তব্য করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅবশেষে স্বস্তির বৃষ্টিতে শীতল পরশ
পরবর্তী নিবন্ধঝড়ো হাওয়ায় উড়ে গেছে ঘরের চালা ভেঙেছে অনেক গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি