করোনাভাইরাস মহামারীর ক্ষতি সামলে উঠতে সরকার সহজ শর্তে এবং কম সুদে সোয়া লাখ কোটি টাকার যে প্রণোদনা দিচ্ছে, সেই টাকা বাজারে এসে মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর শঙ্কা জাগিয়ে তুলেছে। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, কোভিড–১৯ এর প্রভাব মোকাবেলা করতে টাকার জোগান বাড়ানোর ফলে পণ্যমূল্যের স্থিতিশীলতায় ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এতে বেড়ে যেতে পারে মূল্যস্ফীতির হার।
দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গত রোববার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ ত্রৈমাসিক (এপ্রিল–জুন) প্রতিবেদনে এই শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) গতি বাড়ানো এবং বাজারে ভারসাম্য বজায় রাখতে নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি তা বাস্তবায়নের ওপর নজর বাড়ানোর সুপারিশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যাতে কোনো অবস্থাতেই টাকার প্রবাহ উৎপাদন খাতের বাইরে বেশি না যায়। একই সঙ্গে এসব অর্থ অর্থনীতির মূল ধারায় ঘূর্ণায়মান থাকে। খবর বিডিনিউজের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ আশঙ্কা যৌক্তিক বলে মানছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর। তারা বলেছেন, প্রণোদনায় বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে গেছে। আর এই টাকা মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলবে–এটাই অর্থনীতির স্বাভাবিক সূত্র। এ পরিস্থিতিতে খুব বেশি সতর্ক থাকতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দিয়েছেন এই দুই অর্থনীতিবিদ।
করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্ব অর্থনীতিতে ধস নামানোর পর দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার ২০টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। এই অংক জাতীয় বাজেটের এক–পঞ্চমাংশের বেশি। এই প্রণোদনার অর্ধেকের বেশি অর্থ ঋণ হিসেবে ইতোমধ্যে পেয়েছেন বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তারা। সহজ শর্তে এবং কম সুদে এই ঋণ পেয়েছেন তারা। এই সব ঋণের সুদে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে।
দেশে গত কয়েক বছর ধরে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। ২০০৭–০৮ অর্থবছরে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে তা নিম্নমুখী। ২০১৯–২০ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। আর পয়েন্ট–টু–পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) চলতি ২০২০–২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ। সর্বশেষ আগস্টে এই হার কিছুটা বেড়ে ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ দাঁড়িয়েছে।
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, নানা বাধা–বিপত্তি সত্ত্বেও গত কয়েক বছর ধরে দেশে ফসলের ভালো ফলন হয়েছে। বিশ্ববাজারেও জ্বালানি তেল ও খাদ্য পণ্যের দাম কম ছিল। সে কারণে দেশে মূল্যস্ফীতিও লাগামের মধ্যেই ছিল।
অর্থনীতির পরিভাষায়, বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়লে চাহিদা তৈরি হয়। তখন স্বাভাবিক নিয়মে পণ্যের ওপর চাপ পড়ে। এতে দাম বেড়ে যায়। ফলে বাড়ে মূল্যস্ফীতির হার। এতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার উপর বাড়তি চাপ পড়ে।
আহসান মনসুর বলেন, এখন পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। বাজারে ইতোমধ্যে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, আটা, শাকসবজি, মাছ, মাংসসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়তির দিকে। কোভিড–১৯ এর কারণে সরবরাহ চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, বন্যার প্রভাব ও কারসাজির কারণে এগুলোর দাম বেড়েছে। এর সঙ্গে বাজারে প্রণোদনার টাকার প্রবাহ বাড়ায় মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২০১৯–২০ অর্থবছরে টাকার প্রবাহ বেড়েছে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি ২০২০–২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে তা বাড়িয়ে ১৫ দশমিক ৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত জুন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। আগামী জুনের মধ্যে তা ১৯ দশমিক ৩ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।