প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও স্মৃতিশক্তির মূর্ত প্রতীক

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | বুধবার , ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

ধোঁয়াশে আলোচ্ছটায় হু হু করে কেঁদে উঠে মৃত্তিকা বালুকারাশি। সবুজ ঘন ছায়ায় পূর্ণিমার আলোয় ভেসে উঠে অনেকগুলো হৃদয়, হৃদয় তো নয়-অবিনাশী চেতনার করুণ সাইরেন। ভেতরটা দহিত হয় অবারিত মূর্চ্ছনায়। আমরা খুব তাড়াতাড়ি হারিয়ে ফেলেছি একজন সম্পূর্ণ মানুষকে-যিনি ছিলেন আত্মপ্রত্যয়, কঠিন জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, নির্মোহতা আর নির্লোভ গুণের অভিযাত্রী। ২০১৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর জুমাবার বিষাদের মেঘালয় স্কয়ার হাসপাতালের আকাশে। আমরা খুব কাছের স্বজনরা প্রতিটা ক্ষণ গণনা করছি। তানুফ-তিহামদের চোখের সমুদ্রে যেন অবিরাম জলোচ্ছ্বাস, আবেগময় অশ্রুতে ভেসে উঠে শ্বেত পাথর। আমাকে খুব বেশি মানাতে পারিনি এখনো, খুব কি তাড়াতাড়ি মাথার উপর থেকে ছায়াটা হারিয়ে গেল? আসমান-পৃথিবীর অদ্বিতীয় সুপার পাওয়ার, অসীম ক্ষমতার বাদশাহী যাঁর হাতে, তিনি ই তো জন্ম-মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক। সূরা আল্‌-আনআমের ২নং আয়াতে তিনি এভাবেই বলছেন, ‘তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতপর তিনি (সবার বাঁচার একটি) মেয়াদ নির্দ্দিষ্ট করে দিয়েছেন, (তেমনি তাদের মৃত্যুরও) তাঁর কাছে একটি সুনির্দ্দিষ্ট মেয়াদ রয়েছে, তারপরও তোমরা সন্দেহ করছ? এই অমোঘ সত্যটা কেউ এড়িয়ে যেতে পারবে না কষ্মিনকালেও। সৃষ্টির আদিকাল থেকে কেয়ামত অবধি প্রতিটি মানব সন্তানকেই সেই সত্তার কাছে ফিরিয়ে যেতে হবে। পবিত্র কোরআনে এভাবেই এসেছে, ‘সে দিনটিকে ভয় কর, যেদিন তোমাদের সবাইকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে, অতপর সেদিন প্রত্যেকটি মানুষকে (তার) কামাইর ফলাফল দিয়ে দেয়া হবে, তাদের উপর কোন ধরনের যুলুম করা হবে না’ সূরা বাকারা-২৮১। মরহুম আবু তাহের চৌধুরী আমার শ্রদ্ধাভাজন বড় ভাই, কিশোরকাল থেকে যাঁকে আমি দেখেছি খুব কাছ থেকে, অপরিসীম ধৈর্য আর সহিষ্ণুতার মাইলফলক এবং প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও স্মৃতিশক্তির মূর্ত প্রতীক ছিলেন। অসংখ্য মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমখানা ও বিভিন্ন জনহিতকর কাজে নিজেকে জিন্দেগীভর নিয়োজিত রেখেছিলেন। নীরবে দান করতেন সবচেয়ে বেশি, যেটা আমার আল্লাহ তায়ালার বেশি পছন্দ। সূরা বাকারার ২৬২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘যারা আল্লাহ তায়ালার পথে নিজেদের ধন সম্পদ ব্যয় করে এবং যা কিছু ব্যয় করে তা প্রচার করে বেড়ায় না, প্রতিদান চেয়ে (কাউকে) কষ্ট দেয় না, তাদের মালিকের কাছে তাদের জন্যে পুরস্কার (সংরক্ষিত রয়েছে), (শেষ বিচারের দিন) এদের কোন ভয় নেই, তারা (সেদিন) কোন দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হবে না’। এই অবিসংবাদিত সত্য কথাটাকে সারাজীবন আমার ভাই বুকে ধারণ করে রেখেছিলেন। তিন তিনবার সরকার ঘোষিত সিআইপি (বাণিজ্য ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি), যশ-ধনসম্পদ আর প্রতিপত্তি আজ তাঁর কোন কাজে আসবে না। দুনিয়ার পদবী আল্লাহতায়ালার কাছে যেন খড়খুটোর মতন। দুনিয়ায় তিনি আল্লাহর ও বান্দার হকের সমন্বয়ে যে আমলগুলো পরিপূর্ণ করেছেন, সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেগুলোর আজ। পৃথিবীজোড়া খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সাথে সাথেই তাদের জন্য দুনিয়াটা হয়ে যায় কপর্দকহীন। আমরা ৮ ভাই বোন একজন ছাড়া এখন, যিনি আমাদের পারিবারিক সমস্ত সিদ্ধান্তে ছিলেন সবার উপরে-তাঁর প্রতিটি বাক্য আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম। আমরা ফ্যাল ফ্যাল করে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতাম একটি সুন্দর সিদ্ধান্তের আশায়। ঊনি চলে যাওয়ার পর আমাদের সবুজ গাঁয়ের গাছপালাগুলো যেন বিলাপ করে কাঁদছে, এই গ্রামের আকাশটা যেন ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। সমস্ত পরিবারে যেন নেমে এসেছে বেদনার আস্তরণ। আমার রাসূল (সা.) বিলাপ করে ক্রন্দন করতে নিষেধ করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) থেকে বর্ণিত, নবীজি বলেছেন, ‘যে শোকে মস্তক চাপড়ায়, জামা ছিড়ে এবং বিলাপের সুরে মূর্খ যুগের কথাবার্তা বলে সে আমাদের দলের নয়’। বুখারি শরীফের একটি হাদিসে বর্ণিত, ‘যে ব্যক্তি মৃতের জন্য বিলাপের সুরে ক্রন্দন করবে, তার ক্রন্দনের দরুণ তাকে আযাব দেওয়া হবে’। পাঁচ’টি বছর গত হয়ে গেল, এখনো আমার ভাইয়ের চেহারাটা প্রতিক্ষণে, প্রতিমুহুর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠে, শোকের কফিনে পেরেক আটকিয়ে দিই-অন্তর আত্মায় যেন শুরু হয বহুমাত্রিক দুঃসহ দহন। অসংখ্য স্মৃতির মাঝে তাঁকে খুঁজে পাই-মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি করাতে ছুটছিলেন স্কুলপানে- আমার দু’টো কচি হাত ধরে। আমি বড় স্কুলটার দিকে ইশারা করি-কিন্তু না অদম্য এই মানুষটি সেই স্কুলেই আমাকে নিয়ে গেলেন, যেন হার না মানা এক দুরন্ত সিপাহী। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি আমাদের পরিবারের সবার কাছে ছিলেন অনন্য অভিভাবক, একটি সাহসী পুরুষ। জিন্দেগীর পুরোটা সময় অতিক্রম করেছেন অসম্ভব রকমের পরিশ্রমী সাহস দিয়ে, প্রেরণা যুগিয়েছেন অন্যদের। শেষমেষ আল্‌-কোরআনের সেই চিরন্তন কথাটি দিয়েই শেষ করি, ‘কোনো প্রাণীই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া মরবে না, (আল্লাহ তায়ালার কাছে সবার) দিনক্ষণ সুনির্দ্দিষ্ট, যে ব্যক্তি পার্থিব পুরস্কারের প্রত্যাশা করে আমি তাকে (এ দুনিয়াতেই) তার কিছু অংশ দান করি, আর যে ব্যক্তি আখেরাতের পুরস্কারের ইচ্ছা পোষণ করবে, আমি তাকে সে (পাওনা) থেকেই এর প্রতিফল দান করব এবং অচিরেই আমি কৃতজ্ঞদের প্রতিফল দান করব- সূরা আল্‌ ইমরান- ১৪৫।
লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব; সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধজার্মান দার্শনিক রুডল্‌ফ ক্রিস্টফ অয়কেন
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে