দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চমৎকার একটি দিন। আলো ঝলমল চারদিক। সবুজ চাদরের বুকে এক টুকরো ঐতিহ্য-ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। তাজমহলের মতো না হলেও অসাধারণ এর নির্মাণ শৈলী। দারুণ চাকচিক্য। রাণী ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য নির্মিত এই মেমোরিয়াল তৈরিতে কোন ধরণের কৃপনতা করা হয়নি। ঠিক যেখানে যা প্রয়োজন তা করা হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে কারনে অকারনে কিছুটা বেশিও করা হয়েছে। তৎকালীন শাসক এবং প্রভাবশালী জমিদারেরা মিলেমিশে এমন একটি স্থাপনা গড়ে তুলেছিলেন যা শত বছর পরও কলকাতার অন্যতম প্রধান একটি দর্শনীয় স্থান এবং সম্পদ হয়ে রয়েছে।
কী অনন্য সুন্দর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। শ্বেতপাথরগুলো সূর্যের আলোতে চকচক করছে। মুগ্ধ হওয়ার জন্য এর থেকে বেশি কিছু লাগে না। ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটাতেও লাগেনা আর বেশি কিছু। আমরা অনেকক্ষণ ধরে এদিক ওদিক ঘুরলাম। ঘাষের উপর বসলাম। বসলাম লেকের পাড়ে বেঞ্চিতে। বহু যুবক যুবতীর নিজেদের মতো করে সময় কাটানোও দেখলাম। প্রেমকুঞ্জ হয়ে উঠা মেমোরিয়ালের লেকপাড় কিংবা বেঞ্চিতে জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে বহুজন। আমরাও বসে বসে গল্প করলাম, স্মৃতি হাতড়ালাম। ঝালমুড়িও খেলাম। কলকাতার সাথে চট্টগ্রামের দূরত্ব অনেক হলেও ঝালমুড়ি বানানো এবং খাওয়ার সিস্টেমে খুব একটা পার্থক্য দেখা গেলো না। একই ধরনের আয়োজন। একই ধরনের রেসিপি। অবশ্য এখানে মুড়ি এবং চনাচুর মিশাতে আচারের তেল ব্যবহার করা হয়েছে। কিছুটা টকটক স্বাদ। সাথে বিপুল পরিমানে পেঁয়াজ এবং কাঁচামরিচ দিয়ে দারুণ এক আয়োজন!
পেঁয়াজের কথা মনে পড়তেই হেসে উঠলাম। মুড়িমাখার ঠোঙায় চোখ দিয়ে দেখলাম যে প্রচুর পেঁয়াজকুচি। নিজেদের পেঁয়াজ, হয়তো সস্তাও। তাই কৃপনতা করেনি। এখন পেঁয়াজের কি অবস্থা? প্রতিকেজির দাম কত কে জানে! ভারতীয় পেঁয়াজ নিয়ে কি যে যন্ত্রনা আমাদের! প্রতিবছরই এই যন্ত্রনা ভোগ করতে হয় বাংলাদেশের লাখো মানুষকে। পেঁয়াজের ঝাঁজ বেড়ে যায় যখন তখন। ব্যাপারটি ভীষণ গোলমেলে। আমাদের চাষীদের পেঁয়াজ যখন ঘরে উঠে তখন ভারতীয় পেঁয়াজে সয়লাব হয়ে উঠে সোনার বাংলা। আমাদের চাষীরা দাম পায়না। পানির চেয়ে কম দরেও পেঁয়াজ বিক্রি হয়। তখন ভারতীয় পেঁয়াজও একেবারে সস্তায় জুটে। কিন্তু আমাদের চাষীদের মজুদ ফুরোনোর সাথে সাথে ঝাঁজ বাড়তে থাকে ভারতীয় পেঁয়াজের। কয়েকগুন বেশি দামে আমদানি করতে হয়। বাজারে পেঁয়াজের দাম ক্রমান্বয়ে লাফাতে থাকে! কেন যে এমন হয়! প্রতিবছরই বা কেন এমনটা হয় ? এর থেকে প্রতিকারই বা কী!
যাক, আদা বেপারীর জাহাজের খবরে কাজ কী! তৃপ্তি সহকারে ঝালমুড়ি খাচ্ছিলাম। আমার ঘরণীর এসবে দারুণ এলার্জী। স্বল্পাহারী মানুষটি রাস্তাঘাটের কিছু মুখে দিতে নারাজ। আমি যখন ফুটপাতের নানা খাবার দারুণ তৃপ্তি খুঁজি তখন সে অসহায় মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে চটানোর জন্য আমি এমন ভাব করি যেন পৃথিবীর অমৃত খাচ্ছি। স্ত্রীকে চটাতে কেন যে এত ভালো লাগে!
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পাশ থেকে আমরা হাঁটতে হাঁটতে গড়ের মাঠের দিকে গেলাম। কলকাতার মানুষের অন্যতম প্রিয় জায়গা এই মাঠ। তারা আদর করে ডাকে ময়দান। চমৎকার সব গাছগাছালীতে ঘেরা মাঠটি এত নান্দনিক যে চোখ জুড়িয়ে যায়। শহরের বুকে এমন সুন্দর একটি মাঠ সত্যিই অসাধারণ। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিংবা কলকাতার প্রশাসক অত্যন্ত বোকা। শহরের এমন প্রাণকেন্দ্রে এত বড় একটি জায়গা অনেকটা অকাজে ফেলে রাখা হয়েছে! আমাদের শহরে এমন একটি মাঠ থাকলে আমরা কোটি কোটি টাকার বেসাতি করতাম। অবশ্যই দোকানপাট নির্মাণ করে নিজের এবং অপরের বাণিজ্য বাড়াতাম।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে বের হয়ে আমরা ধীরে ধীরে সামনে এগুলাম। গড়ের মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর গড়ের মাঠ একেবারে লাগালাগি। একসময় হয়তো গড়ের মাঠেরই অংশ নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। গড়ের মাঠ অতীতে কেমন ছিল কে জানে, তবে এখনো বিশাল। বিশাল মানে বিশাল। এই মাঠেরই অংশ হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেট স্টেডিয়াম ইডেন গার্ডেনস। নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামও এই মাঠেরই অংশ। এখানে কয়েকটি ফুটবল ক্লাবও রয়েছে। রয়েছে কলকাতার অভিজাত ক্লাব রয়্যাল ক্যালকাটা গলফ ক্লাব। আরো কত কিছু যে গড়ের মাঠের চারদিকে! ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্পত্তি হচ্ছে গড়ের মাঠ। পাশের ফোর্ট উইলিয়ামে সেনাবাহিনীর বড়সড় কার্যালয়ও রয়েছে। গড়ের মাঠ বা ময়দানকে কলকাতার ফুসফুস বলা হয়।
আমরা একপাশে গাছতলায় গিয়ে বসলাম। একদল কিশোর ক্রিকেট খেলছিল। দারুণ উত্তেজনা চলছিল তাদের মাঝে। এদের মাঝ থেকে হয়তো কোন একদিন তৈরি হবে সৌরভ গাঙ্গুলি কিংবা শচিন টেন্ডুলকার। মাঠের সবুজ ঘাষের উপর বসে থাকতে থাকতে আমি স্মৃতিকাতর হয়ে উঠছিলাম। আরো অনেকবার এই মাঠে এসেছি। ওই যে ফুচকা চটপটি বিক্রি হচ্ছে সেখানে বসে আগেও ফুচকা খেয়েছি। স্ত্রীকে চটানোর জন্য বললাম, চল, ফুচকা খাই। আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে ঘরণী বললো, চল।
পড়ন্ত বিকেলে রুমে ফিরলাম। হোটেলে ফেরার আগে নিউমার্কেটের পাশের একটি রেস্তোরায় লাঞ্চ সেরেছি। দারুণ বিরিয়ানি বানায় রেস্তোরাটি। হোটেলটির ব্যাপারে তথ্য দিয়েছেন আমাদের ড্রাইভার। তাকেও আমাদের সাথে বিরিয়ানি খাওয়ালাম। কাচ্চি বিরিয়ানী। রেস্তোরায় দারুণ ভিড়। অসংখ্য মানুষ। নরনারী। কলকাতায় এত মানুষ বাইরে খান! আমার মনে হলো, আশে পাশের বিখ্যাত বিখ্যাত সব অফিসের লোকজন এই রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছেন। আমরা দোতলায় কোনার মাঝে একটি টেবিল পেলাম। সেখানে বসে বিরিয়ানীর অর্ডার করে অনেকক্ষন পর খাবার পেলাম।
সন্ধ্যার আগ দিয়ে ঘুম ভাঙ্গলো আমার। প্রিয়তমা স্ত্রী তখনো ঘুমে। আহা, বেচারি, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এবং গড়ের মাঠে প্রচুর মাহাঁটাহাঁটি হয়েছে। কলেজে পড়িয়ে জীবন পার করা আমার স্ত্রী’র রিপোর্টার স্বামীর মতো হাঁটাহাটির অভ্যাস নেই। এতে করে অতি অল্পতে কাহিল হয়ে উঠে। পড়ন্ত বিকেলের এই গভীর ঘুম তারই প্রমান।
আমার প্রিয় এডিটর স্যারের রুমে ফোন করলাম। ম্যাডাম মিসেস কামরুন মালেক ধরলেন। স্যারকে দিলেন। কোথাও বের হবেন কিনা জানতে চাইলাম। স্যার বললেন, ‘তেমন কোন কাজ নেই। নিউমার্কেটের দিকে যাবো।’ আমাকে তৈরি হয়ে নিচে নামতে বললেন। ম্যাডাম এবং আমার স্ত্রীকে রুমে রেখে আমি এবং স্যার বাইরে বেরুলাম। আমাদের গাড়ি পার্কিং এ আছে। দুই দুইটি গাড়ি। কিন্তু গাড়ি না নিয়ে আমরা হেঁটে বের হলাম। স্যার আমাকে নিয়ে ‘শ্রী লেদার’ নামের একটি দোকানে ঢুকলেন। স্যারের পায়ের একজোড়া জুতা নিয়ে গল্প হচ্ছিল সিমলাতে। হাঁটার জন্য জুতাটি দারুণ। রাফ ইউজের জন্য অতুলনীয়। দেখতেও বেশ সুন্দর। গল্পে এবং কথায় জুতাটির ব্যাপারে হয়তো আমার আগ্রহ প্রকাশ হয়েছিল। স্যার শ্রী লেদারে ঢুকে সেলস ম্যানকে নিজের পায়ের জুতা দেখিয়ে এক জোড়া জুতা দিতে বললেন। সেলস ম্যান কত সাইজের জুতা দেবেন প্রশ্ন করলে স্যার আমার দিকে তাকালেন। আমি যেন আকাশ থেকে পড়তে শুরু করলাম। বললাম, লাগবে না স্যার। আমার জুতা আছে। স্যার কোন কথা শুনলেন না। অনেকটা ধমক দিয়ে আমাকে চুপ করালেন এবং নিজের পায়ে যেই ডিজাইন মান এবং দামের জুতা ঠিক একই জুতা আমাকেও কিনে দিলেন। জ্বী, ইনি আমার এডিটর, আমার স্যার। যাঁর কাছে দৈনিক আজাদীর প্রতিজন মানুষই পরিবারের সদস্য। সবাইকে নিয়েই আজাদী পরিবার।
নতুন জুতা পায়ে দিয়ে কচকচ শব্দ করতে করতে হাঁটছিলাম স্যারের সাথে। বেশ আরামদায়ক জুতা। নতুন জুতা শুরুতে যেভাবে কষ্ট দেয়, এটি সেভাবে দিচ্ছিল না। অনেকটা মোলায়েম। স্যার এবার একটি দর্জির দোকানে ঢুকলেন। টেইলারিং শপ। দোকানের মালিক এবং কাটারমাস্টার স্যারকে দেখে যেভাবে উচ্ছ্বসিত হলেন তাতে আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে স্যার এখানে নিয়মিতই আসেন। কলকাতা আসলে নাকি স্যার এই দোকানটিতে ঢুঁ মারেন এবং শার্ট প্যান্ট সেলাই করতে দেন। আগেরবার দিয়ে যাওয়া দুইটি শার্টও বের করা হলো। স্যার কয়েকটি কাপড় পছন্দ করলেন। আমার জন্যও দুইটি শার্টের কাপড় দিতে বললেন। এবার আর স্যার আমাকে ধমক দিয়ে চুপ করাতে পারলেন না।
স্যারের গায়ের একটি কটি অসাধারণ সুন্দর লাগছিল। সেটিও চন্ডিগড়ের ঘটনা। চন্ডিগড়ের ফুরফুরে আবহাওয়া শার্টের উপর দারুণ একটি কটি পরে ঘুরছিলেন তিনি। অত্যন্ত সুদর্শন আমার এডিটর স্যারের গায়ে শার্টের উপর কটির অসাধারণ কম্বিনেশনে চোখ আটকে যাচ্ছিল। কথায় কথায় কথাটি বলেছিলাম। কটি দারুণ হয়েছে স্যার, কোত্থেকে নিয়েছেন! স্যার বলেছিলেন, গতবার নিয়েছিলাম, কলকাতা থেকে। ব্যাস এটুকই। কটি প্রসঙ্গ ওখানেই শেষ।
নিউমার্কেটের পাশের বেশ বড়সড় একটি দোকানে আমাকে নিয়ে ঢুকলেন স্যার। স্ট্যান্ডে শত শত কটি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। নানা ডিজাইনের, নানা কাপড়ের। স্যার একটির পর একটি কটি দেখলেন। বললেন, ‘না, আগেরটির মতো তো নেই। এটি নাও।’ আমি স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রখর বুদ্ধিমত্তা ও স্মৃতিশক্তির মূর্ত প্রতীক
পরবর্তী নিবন্ধপ্রধানমন্ত্রী নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে যুগান্তকারী কাজ সাধন করে চলেছেন