প্রকল্প পরিচালককে মারধরে ১১ ঠিকাদার চিহ্নিত

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:২২ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন রাস্তা ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মো. গোলাম ইয়াজদানীকে তার দপ্তরে ঢুকে মারধর ও ভাঙচুর করার সময় একজন অফিস সহায়ক ছাড়া চসিক ভবনে উপস্থিত অন্য কোনো কর্মকর্তাকর্মচারী এগিয়ে আসেননি। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) মো. আকবর আলী ঘটনার সময় পাশের রুমে থাকলেও এগিয়ে আসেননি। এছাড়া দরপত্র কার্যক্রম মূল্যায়ন কমিটির চূড়ান্ত অনুমোদনের আগেই জেনে গিয়েছিল ঠিকাদাররা। এজন্য প্রকল্প পরিচালক ও চসিকের প্রধান প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্টরা দায়বদ্ধ। মারধরের সঙ্গে জড়িত ১১ জন ঠিকাদার। মো. গোলাম ইয়াজদানীকে মারধরের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক সৈয়দ শামসুল তাবরীজ। প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত’ ঘটনা এড়াতে চারটি পর্যবেক্ষণ এবং কর্পোরেশন অফিসে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য ১০ দফা সুপারিশ করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার বিষয়টি দৈনিক আজাদীকে নিশ্চিত করলেও সৈয়দ শামসুল তাবরীজ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, বেশিরভাগই নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট।

জানা গেছে, গত ২৯ জানুয়ারি চসিকের টাইগারপাসস্থ অস্থায়ী কার্যালয়ের চতুর্থ তলার ৪১০ নম্বর কক্ষে মো. গোলাম ইয়াজদানীকে মারধর এবং তার টেবিল ও নামফল ভাঙচুর করে ঠিকাদাররা। এ ঘটনার কারণ অনুসন্ধান, ঘটনার সঙ্গে চসিকের কোনো কর্মকর্তাকর্মচারী জড়িত আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা এবং আর্থিক ক্ষতি নিরূপণে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন চসিকের প্রধান নির্বাহী। তবে কমিটি আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারেননি। এর কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধান প্রকৌশলীকে বারবার বলার পরও ক্ষতিগ্রস্ত দ্রব্যাদির ক্রয় রশিদ দাখিল না করায় আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।

ঘটনার নেপথ্যে : মারধরের সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঘটনার সময় পর্যন্ত প্রকাশিত টেন্ডার বিজ্ঞপ্তির কাজ না পাওয়া এবং তাৎক্ষণিকভাবে সেই টেন্ডারসমূহের ড্রপিং এর সময় প্রদানকৃত জামানতের টাকা ফেরত দেওয়াকে কেন্দ্র করে ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া ঘটনায় জড়িত ঠিকাদাররা অন্য প্রতিষ্ঠানসমূহের কাজ পাওয়া নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

প্রকল্প পরিচালকও দায়বদ্ধ : ঘটনার সময় পর্যন্ত ইটেন্ডারের মূল্যায়ন কমিটির অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন থাকলেও সম্পূর্ণ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়নি। মূল্যায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার আগে ইটেন্ডার প্রক্রিয়ার গোপনীয় বিষয় ঠিকাদারদের নিকট প্রকাশ করা বা প্রকাশিত হওয়া প্রক্রিয়ার নিয়ম বহির্ভূত। কিন্তু এক্ষেত্রে তা প্রতিপালন করা হয়নি বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এ বিষয়ে বলা হয়, মূল্যায়ন কমিটির চূড়ান্ত অনুমোদনের পূর্বেই ঠিকাদারদের এই গোপনীয় বিষয় অবগত হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। যদি না প্রকৌশল দপ্তর থেকে কেউ তাদের এই গোপনীয় তথ্য সরবরাহ না করে। এ জন্য প্রকল্প পরিচালক, উপ প্রকল্প পরিচালক, প্রধান প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী, উপসহকারী প্রকৌশলী, কম্পিউটার অপারেটর কাম অফিস সহকারী সম্পূর্ণরুপে দায়বদ্ধ এবং তাদের আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন ছিল।

ঘটনার পর ছুটিতে সহকারী প্রকৌশলী : তদন্ত কমিটি চসিকের প্রধান প্রকৌশলীসহ প্রকৌশল বিভাগের ২৮ জনের সঙ্গে কথা বলেন। এর মধ্যে প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত একমাত্র সহকারী প্রকৌশলী তাসমিয়া তাহসিন ঘটনার পর একসপ্তাহের ছুটিতে চলে যান। যা তদন্ত কমিটিকে ‘হতাশ’ করে। এছাড়া ঘটনার সময় পাশের কক্ষে থাকলেও প্রকৌশলী মো. আকবর আলী তদন্ত কমিটির কাছে দাবি করেনঘটনা জানতেন, তবে পরবর্তীতে নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে ঘটনাস্থলের দিকে এগিয়ে আসেননি।

জড়িত ঠিকাদার : প্রতিবেদনে অভিযুক্ত ১১ জন ঠিকদারের নাম উল্লেখ করা হয়। এরা হচ্ছেনএস জে ট্রেডার্স এর সাহাব উদ্দিন, মেসার্স বাংলাদেশে ট্রেডার্স এর সঞ্জয় ভৌমিক কংকন, মাসুদ এন্টারপ্রাইজ এর মো. ফেরদৌস, মেসার্স জয় এন্টারপ্রাইজের সুভাষ মজুমদার, মেসার্স খান কর্পোরেশন এর হাবিব উল্ল্যাহ খান, মেসার্স নাজিম এন্ড ব্রাদার্স এর নাজিম উদ্দিন, মেসার্স রাকিব এন্টার প্রাইজ এর মো. নাজমুল হোসেন ফিরোজ, ইফতেখার এন্ড ব্রাদার্স এর মো. ইউসুফ, মেসার্স জ্যোতি ও হ্যাপি এন্টারপ্রাইজ এর আশীষ কুমার দে ও হ্যাপি দে এবং মেসার্স তানজিল এন্টারপ্রাইজ এর আলমগীর।

চার পর্যবেক্ষণ : তদন্ত প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত’ ঘটনা এড়াতে চারটি পর্যবেক্ষণ রয়েছে। এগুলো হচ্ছেপ্রকল্প গ্রহণ, প্রাক্কলন, টেন্ডার কার্যক্রম এর প্রত্যেক ফাইলে নিয়মতান্ত্রিক ও স্বচ্ছতা আনয়নে মেয়রের অনুমোদনে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে অপরিহার্য করা। এক্ষেত্রে প্রাক্কলন ব্যয় নির্ধারণসহ অন্যান্য কার্যক্রমে আবশ্যিকভাবে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা প্রয়োজন। টেন্ডার সংক্রান্ত বিষয় চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য অফিসের কোনো পর্যায় থেকে যেন ফাঁস না হতে পারে সেজন্য দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আরো যত্নবান হওয়া। প্রত্যেক টেন্ডার প্রক্রিয়ায় গোপনীয়তার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকর্মচারীদের নাম ও পদবী উল্লেখপূর্বক লিখিতভাবে তালিকা করে দায়বদ্ধতার দায়িত্ব প্রদান করা। সম্পূর্ণ টেন্ডার প্রক্রিয়া চলাকালে ঠিকাদারগণ বা তাদের লোকজনদের অফিস এলাকায় অপ্রয়োজনীয় অনুপ্রবেশ সংরক্ষিত করা।

নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে ১০ সুপারিশ : চসিক অফিসে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার ১০ দফা সুপারিশ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে। এগুলো হচ্ছেপ্রত্যেক কর্মকর্তার রুমে অথবা প্রত্যেক ফ্লোরে একাধিক ইমার্জেন্সি এলার্মের সুইচ স্থাপন করা। যাতে কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী আক্রান্ত হলে তিনি ঐ সুইচ বাজালে অন্যরা তার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা জানতে পারবেন।

চসিকে প্রবেশে ইচ্ছুক সকল বহিরাগতের নাম, মোবাইল ও দপ্তরে প্রবেশের কারণ প্রবেশ গেটে নথিভুক্ত করা। প্রত্যেক ফ্লোরে কমপক্ষে দুইজন করে নিরাপত্তাকর্মী রাখা। পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও সিসিটিভি ফুটেজ স্টোরেজ ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি করা। সিটি কর্পোরেশনে দর্শনার্থীদের প্রবেশের সময়সীমা নির্ধারণ করা। এক্ষেত্রে বিকেল ৪টার পর মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তর এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত অন্য কোথাও দর্শনার্থী প্রবেশ নিষিদ্ধ করা। মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অনুমতি ব্যতিরেকে ভবনে প্রবেশ সংরক্ষিত করা। টেন্ডার সংক্রান্ত বিষয় চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য অফিসের কোনো পর্যায় থেকে যেন ফাঁস না হতে পারে সেজন্য দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আরো যত্নবান হওয়ার জন্য পরামর্শ প্রদান করা।

এছাড়া অফিস চলাকালীন সময় অফিসের সামনের রাস্তায় বহিরাগতদের চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য চেকপোস্ট বসানো, চসিক এর নিরাপত্তা বিভাগে কর্মরত কর্মচারীদের উপযুক্ত ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, প্রতি শিফটে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিকিউরিটির উপস্থিতি নিশ্চিত করা, টেন্ডার প্রক্রিয়া চলাকালীন পুরো সময়ে অফিস টাইমে স্বস্ব বিভাগসহ সম্পূর্ণ অফিস এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্বাভাবিক এর চেয়ে আরো জোরদার করা এবং সহকর্মীদের সঙ্গে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বৃদ্ধি করার সুপারিশ করা হয়।

উল্লেখ্য, প্রকল্প পরিচালকের উপর মারধরের ঘটনার রাতেই চসিকের নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. কামাল উদ্দিন বাদী হয়ে ১০ জন ঠিকাদারের নাম উল্লেখ করে খুলশী থানায় মামলা দায়ের করেন। এ পর্যন্ত মামলার পাঁচ আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. গোলাম ইয়াজদানীকে ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট চসিকের প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি সপ্তাহে মাত্র দুইদিন চসিকে অফিস করেন। তবে ঘটনার পর থেকে কর্মস্থলে যোগ দেননি তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবারো উৎপাদনে যাচ্ছে শিকলবাহা বিদ্যুৎকেন্দ্র
পরবর্তী নিবন্ধআমাকে সাইজ করার চেষ্টা করলে নিজেরাই সাইজ হয়ে যাবেন : নজিবুল বশর