প্যান্ডোরার বাক্স

মূল: পাওলো কোয়েলহো

অনুবাদ: শাহনাজ সিঁথি | শুক্রবার , ২১ জুলাই, ২০২৩ at ৫:১৪ পূর্বাহ্ণ

সকালের কোনও এক সময় আমি তিনটি মহাদেশের তিনরকম অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। লোরা জারদিম নামের এক সাংবাদিক আমাকে ইমেইল করেছে যেন আমি আমার সম্পর্কে কিছু তথ্য জানিয়ে একটা নোট লিখি এবং হসিনিয়া, রিও দো জানেয়রোর পরিস্থিতি উল্লেখ করি। আমার স্ত্রী ফোন করেছেন, সে কেবলমাত্র ফ্রান্সে পৌঁছেছে। সে আমাদের দুইজন ব্রাজিলের বন্ধু দম্পতিকে সঙ্গ দিচ্ছে পুরো দেশটি দেখাতে এবং দম্পতিদের অভিব্যক্তি ছিল ভয়ার্ত ও হতাশাজনক। তারপর যে সাংবাদিক রাশিয়ার টেলিভিশন থেকে আমার সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিল সে আমার কাছে জানতে চেয়েছিল যে ১৯৮০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে পাঁচ লক্ষ লোক ব্রাজিলে খুন হয়েছে কি না।

আমি জবাবে বলেছিলাম যে অবশ্যই এই কথাটা সত্য নয়।

অতঃপর, তিনি আমাকে একটা ব্রাজিলিয়ান সংস্থার (ব্রাজিলিয়ান ইনস্টিটিউট অব জিওগ্রাফি এন্ড স্ট্যাটিস্টিক বলে খ্যাত) পরিসংখ্যান দেখান।

আমি নীরব হয়ে গেলাম। আমার দেশের সন্ত্রাস মহাসাগর ও পর্বতমালা অতিক্রম করে মধ্য এশিয়ায় পৌঁছে গেছে। আমি কি বলতে পারি?

কিছু বলাটা যথেষ্ট নয়, যেমনটা উইলিয়াম ব্ল্যাক বলেছে, যে কথা কাজে রূপ নেয় না ‘মড়কের জন্ম’ দিয়ে থাকে। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। আমি দুজন গুণী মানুষকে, ইসাবেলা ও ইওল্যান্ডা মালতারোলী, সাথে নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান গড়েছি; যেখানে আমরা চেষ্টা করি পাভাওপাভাও জিনহো ফাভেলা বা ঝোপঝাড়ের শহর থেকে ৩৬০টি শিশুকে শিক্ষা, স্নেহ এবং ভালোবাসা দেওয়ার। আমি জানি, ঠিক এই মুহূর্তে হাজারো ব্রাজিলিয়ান আরও অনেক কাজ করছে; অনেকেই নীরবে কাজ করছে, কোনও দাপ্তরিক সাহায্য ছাড়া, কোনও ব্যক্তিগত সহায়তাহীন, শুধুমাত্র নিজেদের একটি সর্ব নিকৃষ্ট বিষয় থেকে রক্ষা করতে; আর তা হলো– ‘হতাশা’।

আমি ভাবতাম প্রত্যেকে যদি নিজের কাজের অংশটুকু ঠিকঠাক করতো, তাহলে পরিবর্তন আসতো; কিন্তু আজ রাতে, আমি চায়না সীমান্তে তুষারাচ্ছিদত পর্বতমালা দেখছি, আমার সন্দেহ হচ্ছে। সম্ভবত, যদি সবাই তার নির্ধারিত কাজটুকু করে থাকে, ছোটবেলায় আমি যে কথাটি জেনেছি তাই সত্য : ‘তুমি শক্তির সাথে দ্বন্দ্বে যেতে পারবে না।’

আমি চন্দ্রাহত পর্বতমালার দিকে আবার দৃষ্টি দিলাম। এইটা কি আসলে সত্য যে, শক্তির সাথে কোনও যুক্তিতর্ক চলে না? অন্য সব ব্রাজিলিয়ানের মতো আমি বিশ্বাস করি যে আমার দেশের পরিস্থিতি, একদিন উন্নত হবে; কিন্তু বছর পেরিয়ে যায়, সবকিছু আরও জটিল হতে থাকে, একেবারেই ব্যাপারটা এমন নয় যে রাষ্ট্রপতি কে, ক্ষমতায় কোন রাজনৈতিক দল, তাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কি অথবা, সত্যিই এই সবকিছুর অনুপস্থিতিতেও কিছু আসে যায় না।

আমি এই পৃথিবীর চার কোণের সন্ত্রাস প্রত্যক্ষ করেছি। আমার স্মৃতিতে আছে, একবার লেবাননে, সেখানকার বিধ্বংসী যুদ্ধ শেষে, বন্ধু সোলা সাদের সাথে বিধ্বস্ত বৈরুতের পথে হাঁটছিলাম। সে আমাকে বলেছিল এই নিয়ে সপ্তমবারের মতো তার শহর বিধ্বস্ত হয়েছে। মজার ছলেই জানতে চাইলাম, তারা কেন পুনঃর্নিমাণের আশা ছেড়ে দিচ্ছে না এবং অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে না। ‘কারণ, এইটা আমাদের শহর’, সে প্রতিত্তোর করেছিল। ‘কারণ, যে ব্যক্তি তার পূর্ব পুরুষদের জগতকে, যেখানে তারা সমাহিত, শ্রদ্ধা করে না; অনন্তকালের জন্য তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।’

যে ব্যক্তি তার দেশকে অসম্মান করে, সে নিজেকে অসম্মান করে। ধ্রুপদী গ্রীক পুরাণের একটি গল্প আছে। দেবতা জিউস প্রমিথিউসের উপর ক্ষুব্ধ হয়েছিল সে আগুন চুরি করেছিল এবং এভাবে মরণশীল মানুষকে স্বাধীন করে দিয়েছিল বলে। প্যান্ডোরাকে পাঠানো হয়েছিল প্রমিথিউসের ভাই ইফামেথিউসকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য। প্যানডোরাকে একটি বাক্স দিয়ে বলা হয়েছিল সে যেন তা না খুলে। তথাপি, খ্রিষ্টান পুরাণের ইভের মতোই তারও মন আগ্রহী হলো। সে বাক্সের ভেতর কি আছে দেখার জন্য ঢাকনা খুলতেই পৃথিবীর সকল ‘মন্দ’ বাক্স থেকে বেরিয়ে এসে পৃথিবীময় ছড়িয়ে গেল। কেবল একটি বিষয় বাক্সের ভেতর থেকে গেল; আর তা হলো ‘আশা’।

অর্থাৎ, সবকিছুই বিরোধিতা করা, আমার দুঃখকষ্ট এবং আমার অনুভূতির বন্ধাত্ব্য, এমন কি এই মুহূর্তে এই উপলব্ধি হওয়া যে আর কিছুই ভালোর দিকে যাবে না সত্ত্বেও আমি একটা বিষয় থেকে দূরে যেতে পারছি না যা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে: ‘আশা’যে শব্দটিকে বিদ্রুপ করে থাকে তথাকথিত বোদ্ধারা, যারা শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করে ‘প্রতারণা’। সেই শব্দটি, সরকার কর্তৃক এতো বেশি ব্যবহার করা হয়, যারা প্রতিজ্ঞা করে কিন্তু তারা জানে তা কখনও রক্ষা হবে না, আর এভাবেই জনগণের হৃদয়ে আরও ক্ষত সৃষ্টি করে। সেই শব্দটি যা প্রায়শই আমাদের সাথে জেগে উঠে ভোরের আলোতে, দুঃখজনকভাবে আহত হতে থাকে বেলা বাড়ার সাথে সাথে, রাতের আঁধারে মৃত্যুবরণ করে, এবং আবার তার পুনর্জন্ম হয় নতুন দিনের নতুন আলোয়।

হ্যাঁ, একটি প্রবাদ আছে ‘তুমি শক্তির সাথে তর্কে যেতে পারো না’; কিন্তু আরও একটি প্রবাদ বাক্য আছে, ‘যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ।’ আর আমি শেষের প্রবাদ বাক্যটির সাথেই আছি যখন আমি প্রত্যক্ষ করছি চায়না সীমান্তের তুষারে ঢাকা পর্বতমালা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলছে
পরবর্তী নিবন্ধএকজন আহসান হাবীব