কবি মিনার মনসুর

তাঁকে যেমন দেখেছি

ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন | শুক্রবার , ২৪ মে, ২০২৪ at ৭:০০ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুলের সহপাঠী, আমার আবাল্য বন্ধু মিনার মনসুর। ক্লাসরুমের মাঝামাঝি দেয়াল ঘেঁষে বসতো মিনার। এক মাথা ঝাঁকড়া চুল, অসম্ভব উজ্জ্বল টানা টানা দু’চোখ স্বল্পভাষী মিনারকে দেখলে ওর ভেতরটা জানার জন্য আমার কৌতূহল জাগতো। মনে হত, ওর শান্ত চেহারার নীচে যেন লুকিয়ে আছে একটি সৃজনশীল সত্তা। আমি তখন সবেমাত্র কবিতা লেখা শুরু করেছি। ওই সময় কবিতার ম্যাগাজিন বের করার জন্য উঠতি লেখকদের মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলত। ‘নবোযা’ নামের একটি কবিতার সংকলন সম্পাদনায় হাত দিলাম।

লেখা জোগাড় করতে গিয়ে প্রথমেই মনে পড়লো ক্লাসের ভাবুক ছেলেটির কথা। অনুরোধ করতেই পরদিন সকালেই লেখা দিল মিনার। কবিতার শিরোনাম “প্রকৃতির খেলা।” দিন গড়িয়ে গেছে। আমার ক্লাসের সৃজনশীল সেই ছেলেটিই এখন আমাদের সময়ের অন্যতম প্রধান কবি মিনার মনসুর। যিনি কবিতায় নিজস্ব ভাষা সৃষ্টি করে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব সত্তা। তবে কেবল কবি পরিচয়ে নিজেকে আটকে রাখেননি মিনার। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় বিচরণ করেছেন আপন মহিমায়। সব্যসাচী লেখক মিনার মনসুর একাধারে কবি, সাংবাদিক, গবেষক, সংগঠক ও প্রাবন্ধিক।

কবি মিনার মনসুরের জন্ম ১৯৬০ সালের ২০ জুলাই চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বড়লিয়া গ্রামে। চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুল ও গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট (বর্তমানে সরকারি মহসিন কলেজ) কলেজ থেকে যথাক্রমে এসএসসি (১৯৭৫) এবং এইচএসসি (১৯৭৭) শেষ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (১৯৮৩) ও স্নাতকোত্তর (১৯৮৪) পাশ করেন। উভয় পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তির জন্যে শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ স্মৃতি পুরস্কার পান। তবে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পর্বে প্রথম হয়েও বাংলা বিভাগে শিক্ষক হতে পারেননি পরিস্থিতির বৈরিতায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে তুখোড় রেজাল্টের পাশাপাশি মিনার মনসুর ছাত্র রাজনীতিতেও দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ক্যাম্পাস। আশির দশকের প্রথম দিকে ছাত্র শিবিরের দাপটে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে তুমুল লড়াই করে ১৯৮১ সালের চাকসুর নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোটে বার্ষিকী সম্পাদকের পদে জয়লাভ করেন মিনার মনসুর। ওই বছরের বার্ষিকী সংখ্যাটি তিনি নিজের মতো করে সাজান। তাতে স্থান পায়নি চাকসু নির্বাচনে বিজয়ী শিবিরের ভিপি ও সাধারণ সম্পাদকের বাণী কিংবা কোনো লেখা। হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল সারা ক্যাম্পাসে। কিন্তু নিজের নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে জেনেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে ছিলেন মিনার অটলঅবিচল। আপস করেননি অপশক্তির সাথে ।

যাবতীয় দুঃশাসন, সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মীয় সংকীর্ণতা, কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে মিনার মনসুর প্রতিবাদী আদর্শের প্রতীক। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, একাশিতে এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন ও ২০০৫ সালে দেশব্যাপী সিরিজ বোমা বিস্ফোরণের সময় গর্জে উঠেছিল মিনার মনসুর। কবিতার অন্তর্গত শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের জন্য অন্যদের চেয়ে আলাদা স্বতন্ত্র একটি ভাষাও খুঁজে বের করেছিলো মিনার। ১৯৭৫৮৫ সালে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন বৈরী শক্তির বিরুদ্ধে অবিরাম কলমযুদ্ধ চালিয়ে গেছেন মিনার মনসুর তাদের একজন।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৭৯ সালে মিনার মনসুরের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় স্মারকগ্রন্থ “শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ”। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত এটিই প্রথম সংকলন। এর আগে ১৯৭৮ সালের ১৫ আগস্ট তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় “এপিটাফ”যার প্রচ্ছদ জুড়ে ছিল বঙ্গবন্ধুর ছবি। এই প্রকাশনাগুলো সেই সময়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সারাদেশে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে”(১৯৮৩) প্রকাশিত হবার পর পরই স্বৈরাচারী সামরিক সরকার বইটি নিষিদ্ধ করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এটাই সম্ভবত প্রথম কবিতার বই যা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল ।

চাটুকারিতা ও লেজুড়বৃত্তি করে তার আশেপাশের অনেককেই দেখেছি প্রতিষ্ঠার সিড়ি বেয়ে তরতর করে উপরে উঠে যেতে । কিন্তু প্রচারবিমুখ, নির্লোভ এই কবি যোগ্যতার মানদন্ডে অনেককে ছাড়িয়ে গেলেও মেধার স্বীকৃতি পাননি দীর্ঘদিন। অবশেষে দেরিতে হলেও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে তিনি নিয়োগ পান । জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র্রের পরিচালক পদে মিনারের নিয়োগ যেন প্রকৃতিরই খেলা। এর আগে তিনি দৈনিক “সংবাদ”এর সহকারী সম্পাদক এবং পরে বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী সম্পাদক হিসেবে “দৈনিক ইত্তেফাক”এ কর্মরত ছিলেন। ইদানিং সোস্যাল মিডিয়ার দৌরাত্ম্যে বেসরকারি লাইব্র্রেরিগুলো যখন মিউজিয়ামের ভেতর গিয়ে লুকোচ্ছে, পাঠকদের বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে আবারো যুদ্ধে নেমেছেন মিনার । দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠাগার দিচ্ছেন। বইয়ের ফেরিওয়ালা হয়ে সমাজের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন জ্ঞানের আলো।

মিনার মনসুর কবিতা লিখছেন চার দশকেরও অধিককাল ধরে। মিনার প্রণীত গ্রন্থের মোট সংখ্যা হচ্ছে প্রায় চল্লিশটি। এর মধ্যে কাব্যগ্রন্থ রয়েছে ১৫টি। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছ– “এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে”, “জলের অতিথি”, “মা এখন থেমে যাওয়া নদী”, “আমার আজব ঘোড়া” । ছড়াগ্রন্থ্থ “চিরকালের নেতা।” অতি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আগের লেখাগুলো থেকে ভিন্নস্বাদের নিরীক্ষামূলক কাব্যগ্রন্থ্থ “ব্রাসেলসের সন্ধ্যাটি ছিল মনোরম”। রয়েছে গবেষণাগ্রন্থও।

রাজনীতিসচেতন, বিনয়ী, নিভৃতচারী এই মানুষটি হৃদয়ে ধারণ করেন বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে মিনার মনসুরের মতো একজন প্রতিবাদী ও অসাম্প্র্রদায়িক ভাবদর্শী কবির খুবই প্রয়োজন, যিনি কাব্যের অন্তর্গত শক্তি দিয়ে আলো ও আঁধারের পার্থক্য বুঝিয়ে দেবেন। মানুষকে মহৎ সৃষ্টির জন্য দীর্ঘ নীরবতা শুভকর নয়। আমাদের বিনীত প্রত্যাশা, নতুন কাব্যসম্ভার নিয়ে পাঠকের মাঝে খুব সহসা ফিরবেন কবি মিনার মনসুর।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅরণ্যের গান: বাঘের পায়ের ছাপ খেয়ে ফেলবে পুরো বাঘটাকে
পরবর্তী নিবন্ধসিআইইউর ১৯তম বোর্ড অব ট্রাস্টির সভা