অরণ্যের গান: বাঘের পায়ের ছাপ খেয়ে ফেলবে পুরো বাঘটাকে

সাইদুল ইসলাম | শুক্রবার , ২৪ মে, ২০২৪ at ৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ

আবু নঈম মাহতাব মোর্শেদ এমন একটা সময়ে আমাদের অরণ্যের গান শোনাচ্ছেন যখন আমরা নগর জীবনের যাঁতাকলে পিষ্ট আর মনে মনে বলছি ‘ফিরিয়ে দাও অরণ্য লও হে নগর’। আমাদের মাথার উপর গাছের ছায়া নেই, বাড়ির পাশে নদী নেই। নদীমাঠপাহাড় সব দখল করে সুউচ্চ ভবন বানাচ্ছি আর ঢেকে দিচ্ছি আকাশ। প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার উন্মুক্ত পরিসরটুকুও নেই আমাদের। আমাদের নাগরিক লোভ আর বিলাসিতা দিনে দিনে আমাদের একা করে দিচ্ছে। যেখান থেকে আমাদের কারও মুক্তি নেই। প্রাণপ্রকৃতির উপর নির্বিচারে আমরা যে অত্যাচার করে চলেছি তার শোধও তো সে নেবে। এআমার পাপ এতোমার পাপ। আর আমাদের এই পাপের ফলে আমাদের একটি কালেক্টিভ পানিশম্যান্টের মধ্য দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে হবে। একটা প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে আমাদের মেধায় মননে মগজে প্রকৃতির কোনো সান্নিধ্য নেই, আরেকটা হচ্ছে আমাদের জীবনে নিজস্বতা বা স্বাধীনতা বলে কিছুর আর অস্তিত্ব নেই। সবকিছু গিলে নিয়েছে অর্থের পেছনে আমাদের প্রতিযোগিতামূলক দৌড়। অরণ্যের গান কবিতায় প্রতীকী পাখিটিকে দেখে আসি যে পাখিটিকে আমরা বন্দি করেছি: আমাদের ঝুলবারান্দায় খাঁচার দাঁড়ে বসে/উদাস চোখে চেয়ে থাকত মানিপ্ল্যান্ট লতার দিকে/ক্যাকটাসের দিকে/ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে হয়তো মনে মনে গাইত/দূর বনে ফেলে আসা পাতাদের গান………আমি মুগ্ধ ছিলাম তার বর্ণিল পালকের বিন্যাসে/আমার প্রায়ান্ধ চোখ তার গোপন নীলের পায়নি সন্ধান”। পাখিটির গোপন নীলের সন্ধান আমরা কখনোই পাব না। গোপন নীলের প্রতীকে কবি পাখিটির যে স্বাধীনতার কথা বলেছেন সে স্বাধীনতার খোঁজ আমরা কখনোই পাব না। সবকিছু বন্দি করে প্রকারান্তরে আমরা নিজেদেরই বন্দি করে ফেলি।

আমরা যেমন প্রাণভরে শ্বাস নেয়ার উন্মুক্ত পরিসর হারিয়ে ফেলেছি, তেমনি প্রাণভরে শ্বাস নেয়ার অবসরটুকুও কি আছে আমাদের? আমাদের হাতে কোনও অবসর মুহূর্ত নেই যে সময়টুকুতে আমরা নিজেদের বেঁচে থাকাটাকে উদযাপন করতে পারি। জীবিকা নামক দৈত্য আমাদের সকল স্বাধীনতা গিলে ফেলেছে। নীলমাছির আড়ালে আমাদের স্বাধীনতার রূপটি দেখে আসতে পারি আমি আর নীলমাছি কবিতায়: “আটটাপাঁচটার দৈত্যটাকে আমি খুন করেছি কিছুক্ষণ আগে/এই আনন্দে আকাশটাকে শ্বাসে শ্বাসে টেনে নিলাম ফুসফুসে……..এরপর মেথরপট্টিতে ঢুকে পড়লাম আমি আর একটি নীলমাছি…..ভরসন্ধ্যা থেকে মাঝরাত অব্দি পান করলাম, গল্প করলাম,/হাসাহাসি করলাম/এর বেশি আর কিছু মনে নেই…….সকালে ঘুম ভাঙলে আবিষ্কার করলাম/আমার পিঠের নীচে মাছিটির মৃতদেহ”। আটটাপাঁচটার দৈত্যএই শব্দবন্ধের ভেতর অসাধারণ শক্তিময়তার সাথে মাহতাব যেমন আমাদের সময়টাকে ধরার চেষ্টা করেছেন তেমনি মাছিটির মৃতদেহ আবিষ্কারের মাধ্যমে এক করুণ সুরের আবহ তৈরি করেছেন। এই স্বাধীনতার গল্প আমরা এন.জি. শট ১ কবিতায়ও শুনে আসতে পারি: “আমার মন নামনাজানা এক পাখির ডানায় লুকোতে চায়, অথচ পাখিটা উড়ে গেছে তার পালকগুলো আমাকে দিয়ে।/ আমি কাঁচের টুকরোগুলো জড়ো করি শহরের রাস্তায় হেঁটে হেঁটে।/ প্রতিটি টুকরো একএকটা আকাশ।…..তখন বাঘের পায়ের ছাপ খেয়ে ফেলবে পুরো বাঘটাকে।/ এভাবে রাত হলে আমরা ঘুমোব কাঁচগুলোর তারা হবার গল্প শুনতে শুনতে”। এই কবিতার শিরোনামে কবি ইঙ্গিতময়তার সাথে চলচ্চিত্রের পরিভাষা ব্যবহার করে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন। এন. জি. শট (নট গুড শট) যেমন পরিচালক তার ছবিতে ব্যবহার করেন না বা ফেলে দেন, তেমনি আমাদের জীবনের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাও যেন আমাদের জীবনে ব্যর্থতা বা শুধু কল্পনারই এক গল্প। মিছে কল্পনার বা আকাঙ্ক্ষার ছবি শিল্পসুষমায় অসাধারণ চিত্রকল্পে “তখন বাঘের পায়ের ছাপ খেয়ে ফেলবে পুরো বাঘটাকে” চিত্রিত করেছেন কবি যা সাম্প্রতিক কাব্যপাঠে আমাদের কাছে বিরল ঠেকেছে। ছেঁড়াপালক কবিতায়ও এই একই বিষয়বোধের সন্ধান মেলে যদিও কাব্যভাষায় সে খুবই মলিন।

নিজের শৈশব এবং সন্তানের শৈশব অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ একটা পরিসর নিয়ে এসেছে এ কাব্যগ্রন্থে। সংসারে পিতামাতার অক্ষমতা যখন কবি শিশু ছিলেন যেমন দেখেছেন তেমনি আজ তিনি নিজে পিতার অবস্থানে থেকে তা উপলব্ধি করছেন। শৈশব, বয়স, আত্মজার প্রতি কবিতাগুলোতে যে অসমর্থতার গল্প রয়েছে, কিংবা সড়ক দুর্ঘটনার পর কবিতায় শিশুদের যে করুণ বিয়োগান্তর পরিণতি দেখিতাঁর এসব উপলব্ধি আমাদের স্পর্শ করে কিংবা বলা যায় এসব যেন আমাদেরই রোজকার গল্প। এসব কবিতায় অনুভূতিতে এবং কাব্যভাষায় উজ্জ্বল কিছু চিত্রকল্প আমরা দেখে আসি:

আকাশ পলেস্তরাখসা দালানের মতন গুমোট হয়ে আছে।

………

জামাগুলো কেমন মেঘ হয়ে যেত।

কাশফুলের মতন নেচে যেত ঘুমের ভেতর।

(শৈশব)

বাচ্চাগুলো বড় হচ্ছে

খরচের খাতায় আরামসে ঘুমোচ্ছে আলু পটল

(বয়স)

তুই এখন যেখানে আছিস, এই আমার অসমর্থ দুটি হাতের ভাঁজে, চারপাশ পরিজনে ঘেরাএটাই আমাদের দুনিয়া। তোকে ঘিরে ভোঁ উড়বে যেনীলমাছি, ভয় পাস নে, ওর মাথাভর্তি চোখ! হাসিস না, ওরাও এখানে থাকে, আমাদের ঘিরে।

(আত্মজার প্রতি)

ভূগোল বইয়ের পাশে রক্তমাখা ধর্মশিক্ষা/ একপাশে পড়ে আছে ছেঁড়া পাতা।/ সেখানে তেপান্তরের মাঠ পার হয়ে/ ডালিম কুমার ছুটছে সাত সমুদ্র পেরিয়ে। (সড়ক দুর্ঘটনার পর)

এমনি আমাদের আরেকটি রোজকার গল্প যৌথজীবন কবিতা যেখানে প্রাত্যহিকতার চাপে আমরা আমাদের প্রিয়জনদের সান্নিধ্যমাধুর্য বুঝতে পারি না, তার হঠাৎ অনুপস্থিতিতেই কেবল তা হৃদয়াঙ্গম করতে পারি: “আমার প্রায় সবকিছুতেই তোমার অপছন্দ আছে। হাসাহাসি আছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। রক্ত আছে মাংস আছে। শুধু যখন তুমি বাপের বাড়ি যাও, কয়েকদিনের জন্য, তখন আমাদের ঘর আমার উপর চেপে বসে। খালি বিছানার দিকে তাকালে আমার ভয় লাগে”।

মান্টোর এপিটাফে আমরা মানুষের যে লোভ, যুদ্ধ আর উদ্বাস্তু জীবনের ইঙ্গিত পাই যেখান থেকে জন্ম হয় মান্টোর; আবার আমাদের মানুষজীবনের ডামাঢোলের আড়ালে আমাদের অগোচরে থেকে যায় ক্ষুদ্র প্রাণের জীবন যা মনে করিয়ে দেয় পিঁপড়ের কোনো এপিটাফ নেই কবিতা। ক্ষমতালিপ্সু বা দখলদারি মানুষের ক্রমপ্রসারমাণ ঘৃণা আর বিদ্বেষের পরিণতি দেখে আসতে পারি গ্যুন্টার গ্রাসকে কবিতায়: “গ্যুন্টার গ্রাস, যখন তুমি তোমার পাইপে আগুন জ্বালছ/আমার শরীরে তখন একবিন্দু মাংসও অবশিষ্ট নাই/আমি সকরুণ চেয়ে আছি শূন্য হাত সেবিকার দিকে”। চেঙ্গির জলে কবিতায়ও আমরা এমনি এক বিষাদআবহ পাই যেখানে নীরব পাহাড় ছাড়া আমরা সমতলের মানুষ হয়তো আদিবাসী মানুষের জাতিগত যন্ত্রণা অনুভব করতে পারি না: “আদিবাসী মেয়েরা স্নান করছিল/চেঙ্গির জলে/ঝলমলে রোদ কালো মেঘকে দিয়েছিল ফাঁকি…..গাইছিল তারা হেলেদুলে/অপমানগাথা…..হাসতে থাকা চোখের তারায়/নেমে এসেছিল দূরের পাহাড়/দুঃখী শ্রোতা”। প্রকৃতির এরকম বেদনাবিধুর চিত্র আমরা মর্সিয়া এবং শিরোনামহীন কবিতাদ্বয়েও দেখতে পাই: “মেঘ তো দেয়নি জল/তবুও বৃক্ষ বেড়েছে নিজের স্বভাবে/পাখির গানকে ভেবো না বৃক্ষের উচ্ছ্বাস/বরং তা মর্সিয়াগীত/মিশে থাকে পাতার শরীরে” (মর্সিয়া) কিংবা “তুমি পাখিগুলোকে মারনি/তাদের ছুঁয়েও দেখনি/তুমি শুধু চেয়েছিলে নিজের একটা ঘর/তাতেই কাটা পড়েছিল সব ক’টা গাছ” (শিরোনামহীন)

মজার কবিতামেজাজের দিক থেকে এটি মনে হতে পারে এবইয়ের একটি দলছুট কবিতা। একবিতায় যে তীর্যক পরিহাস আছে তা আমাদের বাস্তবতাকেই ইঙ্গিত করে কেননা আমাদের জীবনে মজার কিছু নেই, মজার কিছু খুঁজতে গেলেও দুর্দশাই উঠে আসে। কবিও মজার কবিতা লিখতে গিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত সময়ের কথাই শোনান আমাদের: মেদহীন ঝরঝরে হাসিমুখ যে মানুষটা ঘর থেকে/ বের হয়ে হাওয়া হয়ে গেল, …বনসাইটা এখন চোখে পড়ছে বসবার ঘরে/কবিতা হয় নাকি এসব নিয়ে?/…ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে আমি তো চাইছি/ একটা মজার কবিতা লিখতে।

বাইরের পৃথিবীর প্রতিঘাত থেকে যে বিক্ষুব্ধতা জন্ম নিয়েছে মনে সেখানেই মাহতাবের বিদ্রুপবাণে আত্মপরিচয় উন্মোচনের চেষ্টা। মুখোমুখি, অপরিচয়, আয়নাঘরকবিতাত্রয়ের আত্মধিক্কার আর উন্মাদনা আমাদের পরিচয়সংকটের দিকেও কি আঙুল তোলে না? যেমন:

এক রাতে আয়নায় তাকাতেই দেখি

একটা ক্লান্ত শুয়োর চেয়ে আছে আমার দিকে।

(মুখোমুখি)

হাত বুলাই না নিজের গলায়,

একটা বেল্ট বাঁধা থাকতেও পারে।

(অপরিচয়)

আমি আবার ছুটতে থাকি অন্য দরজায়

বাইরে কাজলদিঘির সাথে খুনসুটি করে লাল শাপলা

(আয়নাঘর)

যেই গাছ পাখিদের গান শোনে কবির মনের সেই গাছটিকে আমরাও আমাদের উঠানে দেখতে চাই। একটা সাধারণ দৃশ্যও কী অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে বৃষ্টিস্নান শেষে কবিতা তারই একটি নমুনা। প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত করাএ তো আত্মপ্রবঞ্চনারই নামান্তর। প্রকৃতির আশ্রয়ে বেঁচে থাকাও যেন আজ আমাদের জীবনে বিভ্রমে পর্যবসিত হয়েছে। একবিতায় এই বিভ্রম সৃষ্টির কারণেই এক সকরুণ আবেদন জন্ম নিয়েছে: দেখো গাছটাকে, মাঠের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে, শান্ত,/বৃষ্টিস্নান শেষে পাখিদের গান শুনছে।/ তুমি কি তাকে তোমাদের উঠানে দেখতে পেলে?/আমি দেখেছি। জানি আরো একজন দেখেছে তার ছায়া/যার সাথে আমার দেখা হয়নি কখনো।/না, না, আমি দেখিনি। গাছটি কোথাও কখনো ছিল না।”

অরণ্যের গানএ মাহতাব মোর্শেদ তাঁর জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাকে কাব্যভাষায় সরল বয়ানে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তাঁর এই জীবনযাপন বয়ানে কোনো কৃত্রিমতা নেই। তাঁর এই সরলকথনই আমাদের মনে আবেদন সৃষ্টি করে। এই সরল ভাষাভঙ্গিবিন্যাসই তাঁর বড় শক্তি। তাঁর এই আবেদনের কারণেই প্রথম কাব্যগ্রন্থেই তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

অন্যদিকে, এই সরল প্রবণতায় আমরা তাঁর দুর্বলতাও খুঁজে পাব। যেকারণে এই গ্রন্থে তাঁর বেশ কিছু কবিতা ভাষা, চিত্রকল্প ও পর্যবেক্ষণের দিক থেকে আমাদের কাছে অতি সরল বা ক্লিশে মনে হতে পারে, যেমন: এন.জি. শট ২, কেন, ছাই, ভাবনা, নিমজ্জন, দুঃসময়, কালবেলা, সড়ক শিরোনামের কবিতাগুলো।

এই বইয়ের প্রচ্ছদ চোখে ও মনে শান্তি দেয়। স্নিগ্ধ এই প্রচ্ছদটি করেছেন শিল্পী রাজীব দত্ত। বইটির আকার এবং মুদ্রণ দৃষ্টি আকর্ষণ করবে বলে বিশ্বাস। বইটির প্রকাশক ২০২ কবি বুদ্ধদেব বসুর বাসার ঠিকানা, কবিতাভবন আর কবিতা পত্রিকার কথা মনে করিয়ে দেবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরুণ ক্যাসিনো
পরবর্তী নিবন্ধকবি মিনার মনসুর