পৌনঃপুনিক

জোনায়েদ রশিদ | শুক্রবার , ২২ জুলাই, ২০২২ at ৬:৪৩ পূর্বাহ্ণ

কুকুরটাকে কীযে বদখত লাগছে! কেমন অসভ্যের মত জিভ বের করে কুতকুত করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রাশেদ বিনা কারণেই কুকুরটির পাছায় জোরসে লাথি কষিয়ে দিল। ছোটবেলায় বিস্মিত কিংবা অনমনা থাকলে অজান্তেই মুখ হা হয়ে জিভ বের হয়ে পড়ত রাশেদের- মায়ের চোখে পড়লে থাপ্পড় লাগিয়ে দিত পূর্বাভাষ ছাড়াই। গজগজ করে বলত পোলা পাইছে কুকুরের খাসলত। অবচেতনে এই স্মৃতি তাকে লাথি দিতে উদ্ভুদ্ধ করলো কীনা কে জানে! কুত্তাটা, নেড়ি কুত্তাই হবে হয়তো, ঘেউ ঘেউ করে খেঁকিয়ে উঠল, তাকে গালি দিল কি? রাশেদের স্পষ্টই মনে হল কুকুরটা যেন খানকির পোলা বলেছে। কিন্তু কুকুর কি খানকির পোলা বলতে পারে? কিংবা খানকি বিষয়ক কোন ধারণা কি আদৌ কুকুর সমাজে আছে? যদি থাকে তো বিবাহ কিংবা যৌনতা সম্পর্কিত নৈতিক ধারণাও কুকুর সমাজে থেকে থাকবে নিশ্চয়। সে যে রাস্তাঘাটে দেখে কুকুরের অবাধ যৌনাচার- তবে কি ওরা পরস্পরের বাগদত্তা? ভাবনাটা নিয়ে এভাবেই গড়াতে গড়াতে সিগারেট ধরাল রাশেদ। এইটা একটা ভালো খেলা- একটা ভাবনাকে চুইংগামের মত টানতে টানতে দীর্ঘ করা, যে কোনও এক জায়গা থেকে শুরু করলেই হল। শেষ কোথায় আপনি জানেন না, আপনার কাজ হল কেবল প্রশ্ন করা কিংবা উসকে দেয়া- দীর্ঘ, অনিশ্চিত পথে তা গড়াতেই থাকবে যতক্ষণ না বাধা পায়। এতে সময়টা চমৎকার কেটে যায়, অস্থিরতাও। রাশেদের মনে পড়ে ছোটবেলায় তারা একবার পাহাড়ে গিয়েছিল, স্কুল থেকে পিকনিকে। পাহাড়টা অনেক উঁচা ছিল। তো তারা লাফিয়ে লাফিয়ে মেঘ ধরার চেষ্টা করছিল, কোনও একফাঁকে তার পা হড়কে যায়, সে গড়িয়ে পড়তে থাকে, গড়াতেই থাকে; অবশ্য তারা পাহাড়ে আদৌ গিয়েছিল নাকি পুরো ব্যপারটা কোন সিনেমায় দেখেছে এই বিষয়ে নিশ্চিত হতে না পেরে এক কাপ চায়ের অর্ডার দেয় সেলিমের টং-এর দোকানে।

চা’ মুখে দিয়েই খেঁকিয়ে ওঠে রাশেদ- কী ঘোড়ার মুত বানাইছ মিয়া? বাস্তবিকই সবটাই এখন বিস্বাদ লাগে তার কাছে, ঘোড়ার মুতের মতই। বিস্বাদ ভাবটা পানিতে গুলানো লবণের মতই ছড়িয়ে পড়তে থাকে রক্তে। নোনতা রক্ত তার শিরা-উপশিরায় দাপাদাপি করে ইঁদুরের মতো। সে বসে পড়ে সামনের বেঞ্চটার উপর। এখান থেকে এনজে গ্রুপের প্রত্যেকটা ফ্লোর পষ্ট দেখা যায়। ঐযে চারতলার জানালার পাশে একজন চেয়ারে হেলান দিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন তিনি আরাফাত সাহেব, তার ডানপাশেরটা জসিম সাহেবের রুম- উনি এজিএম; তার মাথার ঠিক উপরের রুমটাতে বসেন ননী গোপাল সেন, এই গ্রুপের চেয়ারম্যান। গত ১৫ দিনে চেয়ারম্যান থেকে জুনিয়র অফিসার- এ ডেস্ক থেকে ও ডেস্কে রাশেদ ঘুরেছে ফুটবলের মতো অথচ একটাও ইন্সুরেন্স জোগাড় করতে পারেনি, প্রত্যেকে এক-একজন গ্যারিঞ্চা যেন নিপুণভাবে পাস দেয় পাশের ডেস্কে। মানুষের কি সঞ্চয় করার মত ইনকাম নাই নাকি দিন দিন সঞ্চয়ের প্রতি অনীহ হয়ে উঠছে? সঞ্চয়ের গুরুত্ব সে বোঝে ভালোই, অন্যকে বোঝায়ও চমৎকার। চাকরিতে যোগ দেয়ার পর তাদের ৭ দিনের একটা ট্রেনিং হয়েছিল, এরপর একটা মূল্যায়ন পরীক্ষা- তাতে রাশেদ জীবনে প্রথমবারের মত কোন ধরণের পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছিল। তখন তাদের এক বড় স্যার বলেছিলেন মনোযোগ দিলে তুমি অনেক দূর যেতে পারবে। মনোযোগের ঘাটতি তার কখনোই ছিল না, আহা কত স্বপ্ন দেখেছিল তখন- অনেক টাকা জমলে… কিন্তু এই ধরণের ভাবনাকে সে বেশিদূর প্রশ্রয় দিতে পারে না, ভেসে আসে করিম সাহেবের মুখ। এইরকম গাড়ল জীব রাশেদ জীবনে কমই দেখেছে, আপনি তাকে ঘৃণা করবেন প্রতিনিয়ত কিন্তু তাকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না কোনোমতেই- সে আপনার সামনে হাজির হবে একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে। এইবেলা রাশেদের একবার অফিসে যাওয়া দরকার কিন্তু করিম সাহেবের মুখ মনে পড়তেই বিবমিষায় পেয়ে বসল। গত দুই মাসে এক টাকাও ব্যাবসা দিতে পারেনি রাশেদ, এই অবস্থায় করিম সাহেবের সামনে পড়লে হয়তো তিনি কিছুই বলবেন না, কিন্তু তার দৃষ্টি আপনাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে। আপনার ব্যর্থতা দৈত্যের মত তার চোখের তারায় নাচতে থাকবে, আপনার মনে হবে ঐ দানোটা মুহূর্তেই চোখের তারা থেকে লাফিয়ে এসে প্রকান্ড হা করে গিলে খাবে। আপনি দ্রুত পালাতে গিয়ে হয়তো ক্লায়েন্টের বসার জন্য রাখা সারি সারি চেয়ারের কোন একটিতে উষ্টা খেয়ে বিতিকিচ্ছিরি কান্ড বাধিয়ে বসবেন।

না, অফিসে আজ যাবে না রাশেদ, বরং আর একটি সিগারেট জ্বালানো যাক। সিগারেটে কড়া একটা টান দিয়ে ছাড়তেই ভুস ভুস করে ফাতেমা এসে হাজির হয় ধোঁয়ার কুন্ডুলির ভেতর। সে দ্রুত সাইলেন্ট করে রাখা মোবাইল বের করে দেখে ফাতেমা ফোন করেছিল কীনা! না, তাকে খোঁজেনি কেউ। রাশেদ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে করার চেষ্টা করে শেষ কবে ফাতেমা তাকে ফোন করেছিল, আদতে তাকে কখনো ফোন করেছিল কীনা! ফাতেমার বিষয়টা সে নানাভাবে ভেবেছে কিন্তু কোন কুল-কিনারা পায়নি। ফাতেমার সাথে তার পরিচয় একটা অফিসে ইন্স্যুরেন্স বেচতে গিয়ে। ঐ অফিসে রিসেপসনিস্ট হিসেবে কাজ করে সে। রাশেদ তাকে অন্য অনেকের মতোই সঞ্চয়ের প্রয়োজনীয়তা এবং তাদের কোম্পানির স্কিম সম্পর্কে যখন বোঝাচ্ছিল ফাতেমা ফিক করে হেসে বলল- না জমালে কী হয় জনাব। ফাতেমার চেহারা আহামরি নয় মোটেই- কাঁচা বাজারে গেলে এরকম অনেককেই দেখেন আপনার পাশে দাঁড়িয়ে আলু, পটল কিনছে কিন্তু আপনি লক্ষ্যই করেন না! ‘না জমালে কী হয় জনাব’ যেন ছ্যাৎ করে একটা বর্শা বিদ্ধ করে দেয় রাশেদের হৃদয়ে। তোলপাড় শুরু হয় তার বুকে, এই মেয়েকে সঞ্চয়ের গুরুত্ব বোঝাতেই হবে- একটা মোলায়েম জেদ দইয়ের মতো তার মাথায় ঘন হতে থাকে। এরপর তারা কতবার এই বিষয়ে আলোচনা করেছে! হঠাৎ একদিন ফাতেমা বলেছিল সঞ্চয় ব্যাপারটা নিয়ে সে মোটেও আগ্রহবোধ করছে না, যদি কখনো করে তো জানাবে। ঠিক এই কথাটায় হয়তো বলেনি- আমি যদি না-ই থাকি কী হবে সঞ্চয় বলে আর আগ্রহ দেখায়নি কিংবা হয়তো গম্ভীর হয়ে বলেছিল না জমালে কী হয় জনাব- এরকমই কিছু হবে হয়ত এখন আর পষ্ট মনে পড়ে না রাশেদের। কেবল সিগারেটের ধোঁয়ায় সৃষ্ট কুন্ডুলির মধ্যে একটা আবছা অবয়ব ভেসে ওঠে। ঐ ধোঁয়ার কুন্ডুলির মধ্য দিয়ে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে সে নদীর পাড়ে এসে পৌঁছে।

নদীর তীর ঘেঁষে মেরিন ড্রাইভ রোডটি নতুন হয়েছে। রাশেদের খুব পছন্দের একটি স্থান এটি। নদীতে এবরো-থেবরোভাবে অসংখ্যা জাহাজ নোঙর করা, বেশীরভাগই লাইট জাহাজ- অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচল করে। তেল, চাল, চিনি, সিমেন্ট নানা ধরণের পণ্য সদাই করে। মেরিন ড্রাইভ রোডটি এখনো চালু হয়নি, কাজ চলছে। আজকাল অনেকে বিকেলের দিকে এই জায়গায় আসে হাওয়া খেতে, তখন বেশ জমে উঠে জায়গাটা। রাশেদ রাস্তার ধারে নদীর দিকে মুখ করে বসে এক মজার খেলায় মেতে উঠে প্রায়শ। বামে তাকালে ঐ দূরে কর্ণফুলি ব্রীজ, আর ডানে নদীটি বেঁকে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দেখা যায় তারপর হঠাৎ করেই যেন নদীটি হারিয়ে যায় উঁচা উঁচা সব বিল্ডিং আর ক্রেনের পেটে। প্রথমে বাম থেকে ডান পর্যন্ত তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে নোঙর করা জাহাজ গুনতে শুরু করে । খানিক্ষণ বিরতি দিয়ে এবার ডান থেকে বামে খুব মনোযোগ দিয়ে জাহাজ গুনে সে। প্রতিবারই তাজ্জব হয়ে দেখে দু’বারের গণনায় জাহাজের সংখ্যা কখনো এক হয় না। এটা সৃষ্টির একটা অনির্ণেয় ধাঁধাঁ মনে হয় তার কাছে, ফাতেমার মতই। তাকে যেমন দু’বারের দেখায় কখনোই মেলাতে পারত না রাশেদ, ফলে একটা অস্বস্তি ক্রমেই দানা বাঁধতে থাকত। ফাতেমার হারিয়ে যাওয়া ওই দানা বাঁধা অস্বস্তিরই বিস্ফোরণ হয়তো। এসবই মাথার মধ্যে ডাঙায় তোলা কৈ মাছের মত তড়পাতে থাকলে রাশেদের জেদ আরও চেপে যায়- সে তখন পুনরায় বাম থেকে ডানে এলোপাথারি নোঙর করা জাহাজ গুনতে শুরু করে। ঐ মুহুর্তে ফোনের রিং বেজে উঠলে সে এই অর্থহীন এবং অপব্যয়ী খেলায় ক্ষান্ত দেয়। স্ক্রিনের দিকে তাকতেই ঘোড়ার মুতের মত নোনতা বিস্বাদ ফিরে আসে- তার মা ফোন করেছে। এই ফোন রিসিভ করার কোন মানেই হয় না এখন। সেই ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি, এই কথোপকথোন যেন প্রাগৈতিহাসিক- বাবার প্রেসার বাড়তে আছে, নতুন যোগ হয়েছে ডায়াবেটিক, সুনামির জোয়ারের মতোই রাতে বাতের ব্যথা কঁকিয়ে উঠে ময়ের শরীরে, সারের খরচ না দিলে জমিতে হাল দেবে না বর্গাচাষীরা, তার ছোটভাই জমিরের টিউশন ফি বাকি পড়ে আছে সৃষ্টির অনাদিকাল থেকে ইত্যাদি ইত্যাদি। তার মা কখনোই কিছু চায় না, কেবল ধান মাড়াইয়ের কলের মতো একঘেয়ে ঘড়ঘড় শব্দে কতগুলো তথ্য দেয়, তখন তার নিজেকে মাড়াইয়ের পর পড়ে থাকা খড়ের মতই তুচ্ছ এবং অকিঞ্চিৎকর মনে হতে থাকে।

স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রাশেদ ফজলুর কথা ভাবে। এখন কি ফজলুকে একটা ফোন করবে? এই নির্বান্ধব শহরে ফজলুকেই তার একমাত্র বান্ধব মনে হয়। ফজলুর সাথে তার পরিচয়ের পর্বটা ইন্টারেস্টিং। একদিন রাতে, প্রায় নয়টা হবে হয়তো- সে নদীর পাড়ের ঠিক এই জায়গাটাতেই বসে সিগারেট ফুঁকছিল। ঐ সময় ফজলু এসে তার পাশে বসে বলে- ভাই থাকলে একটা সিগারেট দাও তো, একটাও ফেরিওয়ালা দেখছি না শালা! কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই, একেবারে সরাসরি তুমি সম্বোধন। খুব অবাক হয়েছিল রাশেদ, খানিকটা বিরক্তও। কিন্তু ঐ একবারই, এরপর থেকে ফজলুকে যত দেখে ততই বিস্মিত হয়, আনন্দিতও- ফজলু একটা চলন্ত নিউজ পোর্টাল যাতে তাবৎ দুনিয়ার বিচিত্র সব সংবাদ মুদ্রিত। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই এতদিন পরেও রাশেদ জানে না ফজলু কী করে, তার ঠিকুজি, বিষয়আশয়, খতিয়ান ইত্যাদি, তার কখনো জানতে ইচ্ছেও করেনি। রাশেদ যেমন ফজলুকে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি তার সম্পর্কে তেমনি ফজলুও কখনো জানতে চায়নি কিছুই। ঐ যে সামনে নোঙর করা অজস্র জাহাজ, ওগুলো তো একই স্রোতে ভেসে চলে- তারা কি জানে পরস্পর সম্পর্কে? মাঝে মাঝে অর্থহীনভাবে বসে থাকলে এই ধরণের খেলো প্রশ্ন খেলা করে তার মাথায়। তখন সে মনোযোগ দিয়ে ভাবতে শুরু করে এই সমস্যা নিয়ে, সময়টা বেশ কাটে এতে। যখন সে প্রায় সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায় যে জাহাজদের মধ্যেও সম্পর্ক থাকা খুব সম্ভব মানুষের মতোই তখন ফজলু হয়তো হঠাৎ হাজির হয় শরতের বৃষ্টির মতো। ফজলু তাকে বলতে থাকে একজন নাবিকের গল্প, যে দীর্ঘ, অন্তহীন সমুদ্র নিঃসঙ্গ অবস্থায় পাড়ি দেয়ার কালে একরাতে জাহাজের ডেকে দাড়িয়ে কাঁদছিল। হঠাৎ সে দেখে সমুদ্র থেকে বিশাল একটা বাইলা মাছ ফাল দিয়ে উঠে পড়ে জাহাজের ডেকে। নাবিকটি কাছে যেতেই বাইলা মাছটি রূপান্তরিত হয় অনিন্দ্যসুন্দরী এক রাজকন্যায়। সে রাজকন্যা গভীর মমতায় নাবিকের চোখের জল মুছে দেয়। কিংবা বলে কোথাকার কোন দেশে নাকি কোন এক মায়ের পেটে এক শিশুর জন্ম হয়েছে যে দেখতে শুয়োরের মত। ঐ শিশু নাকি জন্মের পর থেকেই ঘোঁৎ ঘোঁৎ করছে এবং যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই ঢুঁস মারছে। এইসব গল্প বিশ্বাস হতে চায় না রাশেদের কিন্তু ফজলু এমনভাবে বলে যেন প্রত্যেকটা ঘটনার সাক্ষাৎ সাক্ষী ছিল সে; ফলত রাশেদ বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকে জাহাজগুলোর মতই। অবশ্য তাদের বস করিম সাহেবের কথা শুনলেও এই ধরণের দুলুনি হয় রাশেদের শরীরে। এইরকম অতৃপ্ত আত্মা খুব কমই দেখেছে সে। তার সন্তুষ্টি বাইলা মাছের রাজকন্যায় পরিণত হওয়া থেকেও বিরল বলে রাশেদ ফজলুর গল্পগুলো একেবারে উড়িয়েও দিতে পারে না।

ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সন্ধ্যা হলে সবাই ঘরে ফেরে, পাখিসব এবং করিম সাহেব। কিন্তু নোঙর করা জাহাজ সকল দুলতে থাকে। এদের কি কোনও ঘর আছে নাকি নোঙর মানেই ফেরা? ধরা যাক কোনও কারণে নোঙর ছিঁড়ে গেল, তবে ঐ জাহাজ কোথায় যায়? এই সমস্ত এলোমেলো ভাবনা রাশেদের নিউরনে ছড়িয়ে পড়ে। রাশেদ উঠে হাঁটতে আরম্ভ করে এবং টলতে টলতে নিজেকে আবিষ্কার করে মেথর পট্টিতে। এখান থেকে বাংলা মদের একটা পাইট কিনে নিয়ে ঘরে ফেরে। বিষয়টা তার কাছেই অব্যাখ্যায় আর অদ্ভুত ঠেকে! মদ খাওয়া সে উপভোগ করে না মোটেও। তার পুরো শরীর গুলিয়ে আসতে চায়। এত কষ্ট করে অতি অখাদ্য এই বস্তুটি গেলার কোনও মানেই খুঁজে পায় না রাশেদ, তবুও মাঝেমধ্যে সে নাকমুখ চেপে মদ গেলে যেমন এখন গিলতে বসেছে। দু’পেগ পেটে পড়তেই তার করিম সাহেবের মুখ মনে পড়ে- এসময় ৪০ওয়াটের ক্ষীণ আলোয় সে দেখে প্লাস্টার ছড়ে যাওয়া ঝাপসা স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল বেয়ে একটা বিছু ধীরে ধীরে উপরে উঠছে। সে তার চটি জুতো দিয়ে একটা বাড়ি দেয় বিছুটিকে। বিছুটি মেঝেতে পড়ে একটুআধটু নড়াচড়া করে, হয়ত ব্যথায় গোঙাতে থাকে। ওই গোঙানোর শব্দ হাতুড়ির আঘাতের মতো তীব্র হয়ে তার নিউরনে আঘাত করতে থাকে। রাশেদ ওই শব্দ হতে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যই হয়তো প্রচন্ড আক্রোশে বিছুটিকে পিষে মিশিয়ে দেয় মেঝের সিমেন্টের সাথে। তারপর মদে আরেকবার চুমুক দিতেই ফাতেমার মুখ ভেসে আসে, ফাতেমা কি সেই বাইলা মাছ যে রাজকন্যা হয়ে গ্যাছে? এই প্রশ্নটা তার মাথায় পৌষ মাসের ফজরের কুয়াশার মত ঘনীভূত হতে থাকে। তখন সে এই রহস্যের মিমাংসা করার জন্যই পরপর আরো ক’টা চুমুক দেয়। ততক্ষণে তার শরীরের প্রতিটি কোষে নাচন লেগেছে। তার পেটের মধ্যে অসংখ্য বাইলা মাছ ফালাতে আরম্ভ করেছে। ওগুলো এক একটা রাজকন্যা হতে চায় হয়তো। সে কোনমতে টেনে হিঁচড়ে নিজেকে টয়লেটে নিয়ে যায়। তখন রাশেদের তার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে- যেবার বর্ষায় তাদের বাড়ির পাশের ছোট্ট একহাড়া গড়নের নদীটির পাড় ভেঙে গিয়েছিল। বাবার হাত ধরে রাশেদ দেখছিল যে নদীর জলে তারা প্রতিদিন দাপাদাপি করত। সে নিরীহ জল কী প্রমত্ত হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে বাবলা গাছ, দুমড়ানো পাটঝাড়, তাদের গোয়াল ঘরের বেড়া। এখন যেমন তেমন প্রমত্ত তোড়ে তার পেট থেকে অজুত লক্ষ বাইলা মাছ গড়াতে থাকে টয়লেটের মেঝেতে। সেসব দেখে রাশেদ আবারও গড়িয়ে পড়তে থাকে পাহাড় থেকে- গড়াতে গড়াতে একটা প্রকান্ড পাথরে বাধা পেয়ে সে থামে। পড়ে যাওয়ার আতঙ্ক এবং গড়ানো ক্লান্তিতে ভোঁ ভোঁ করে ওঠে তার মাথা। চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ জিরানোর পর চোখ মেলে দেখে সেই বিশাল পাথরের পাশেই ছিপছিপে একটা ঝর্ণা হতে মৃদু বেগে বয়ে চলেছে শীতল ধারা, খুব খাড়া করে কান পাতলে জলের বয়ে চলার একটি মৃদু ধ্বনি টের পাওয়া যায়- পাথরেরও যেন ঘুম না ভাঙ্গে এতটাই মৃদু। শরীরের প্রত্যেকটা কোষে-কোষে ঐ জলের ডাক শুনতে পায় রাশেদ- জানে তা উপেক্ষা করার ক্ষমতা তার নেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদক্ষ জনসম্পদ অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার
পরবর্তী নিবন্ধআমাদের মুহূর্তগুলো