পাহাড় দখলের সহযোগী পিডিবি!

ঝুঁকিপূর্ণ খুঁটিতে মিটার দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ১৫ জুন, ২০২১ at ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

নগরীর আকবর শাহ থানাধীন রেল হাউজিং সোসাইটির উত্তর পশ্চিম অংশে একটি বিদ্যুতের খুঁটি মধুমাস জ্যৈষ্ঠকে মনে করিয়ে দেয়। এখানকার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সরবরাহ লাইনের খুঁটিটি দেখলে মনে হবে একটি জ্যান্ত কাঁঠাল গাছ। যেটিতে কাঁঠাল ধরেছে মাটির সাথে লেপ্টে। মূলত সরকারি বেসরকারি পাহাড়ে গড়ে উঠা বৈধ অবৈধ বসতিতে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতেই পিডিবির এই আয়োজন।
ঝুঁকিপূর্ণভাবে নিচু স্থানে মিটারে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার পাশাপাশি এ ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই চট্টগ্রাম মহানগরীতে অবৈধভাবে পাহাড় দখলের সহযোগী হয়েছে পিডিবি। অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মাঠ পর্যায়ের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এসব বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে পিডিবির দাবি, বিদ্যুৎ চুরি রোধ করতেই একইস্থানে মিটারগুলো স্থাপন করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর আকবর শাহ থানা এলাকার রেল হাউজিং সোসাইটির শেষ প্রান্তের পিডিবির একটি বিদ্যুৎ খুঁটিতে ঝুলে রয়েছে অসংখ্য বিদ্যুৎ মিটার। ভূমি থেকে মাত্র দুই ফুট উঁচুতেও ঝুলে আছে মিটার। স্টিলের একটি বাঙে ৮টি মিটার থাকলেও অন্যগুলো আলাদা আলাদাভাবে উপর-নীচে ঝুলে আছে। প্রায় সবগুলোই প্রি-পেইড মিটার। এসব মিটার থেকে সংযোগগুলো চারিদিকের বিভিন্ন বসতিতে গিয়েছে। অগ্রণী হাউজিং সোসাইটির সাথে লাগোয়া উত্তর-পশ্চিম কোনায় আফসার স্টোরের সাথেই সিসি ঢালাই রাস্তার উপর খুঁটিটির অবস্থান। ওই খুঁটির আশেপাশের বসতিগুলোতে রয়েছে ছোট ছোট অনেক শিশু। এসব শিশুরা ওই সড়কেই খেলাধুলা করে।
স্থানীয়রা বলছেন, এখানে মিটারগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তবে কেউ নিজেদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। আফসার স্টোরে চা-পানরত কয়েকজন বলেন, ‘এখানের বসতিগুলো প্রভাবশালীরা নির্মাণ করেছে। কম আয়ের মানুষজন ভাড়ায় থাকেন। মিটারগুলো কয়েকবছর থেকে এভাবে ঝুলে আছে। এখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে। দুই বছরের বাচ্চা শিশুও মাটি থেকে হাত দিয়ে মিটারগুলো ছুঁতে পারবে। এতে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।’ এসময় এক যুবক বলেন, ‘এসব মিটার আনতে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। ২০-২৫ হাজার টাকাও লেগেছে একেকটি মিটারে। একটি মিটার থেকে অসংখ্য বাসায় বিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে। এসব মিটার থেকে পাহাড়ের পাদদেশে নির্মিত বসতিগুলোতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক প্রভাবশালী অবৈধভাবে দখল করে, অনেকে লিজ নিয়ে পাহাড়ের নিচে বসতি তৈরি করেছে। বিদ্যুৎ না থাকলে কেউ এসব বাসায় ভাড়ায় থাকবে না।’
এদিকে ওই খুঁটিতে ঝুলে থাকা মিটারগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটির নম্বর সংগ্রহ করা গেছে। তন্মধ্যে ১০১১০০৪১৬৭৩, ১০১১০১৭৮৪৩৭, ১০১১০১০২৮২৯, ১০১১০২৪৪৭৭৮, ১০১১০১৫৯৯৭৫, ১০১১০০০৭৫৩৮, ১০১১০৩৪৯০৯৪, ১০১১১০১১৬৬৭, ১০১১১০৩২২৬৫, ১০১১০০৭৬০০৭, ১০১১০২৪৪৭৭৫, ১০১১০১৫৯৯৭২, ১০১১০০২১৯৫৪, ১০১১০০৩৯৫১১, ১০১১০০১৭১১৫, ১০১১০০০৬৭৭৭, ১০১১০১৩৯৫১৯, ১০১১০০০৮৫৭৩, ১০১১০০৪১৭৭৫, ১০১১০০১৬১২৬, ১০১১০১০২৮৩৯, ১০১১০১৭৮৪৩৭, ১০১১০০৪১৬৭৩, ১০১১০০১৬১২৮, ১০১১০০৩৮৯৬৩, ১০১১০০১৪৯১০, ১০১১০০৩৩৭৫৪, ১০১১০০৩৮৪৭০, ১০১১০১৯০০১৬ সহ আরও কয়েকটি মিটার রয়েছে।
পিডিবি দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার দেওয়ান সামিনা বানু সোমবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ চুরি রোধ করতে মিটারগুলোকে একই স্থানে স্থাপন করা হয়েছে। সরকার শতভাগ বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। ছোট বড় সবাই বিদ্যুৎ সুবিধা পাওয়া দাবি রাখে।’ বিদ্যুৎ আইন না মেনে এভাবে সংযোগ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মূলত আকবরশাহর ওই এলাকাগুলোকে বস্তি ঘিঞ্জি এলাকা। চুরি রোধসহ ঝুঁকি এড়াতে এভাবে করা হয়েছে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বিধি ও রুলস মাফিক হলে একবিংশ শতাব্দীতে একটি খুঁটিতে এতোগুলো মিটার সংযোগ দেওয়ার কথা নয়। এখানে অস্থায়ী কিংবা মেলার সংযোগ নয়। স্থায়ী সংযোগের ক্ষেত্রে পিডিবি নিশ্চয়ই দুর্নীতির উদ্দেশ্যে এসব সংযোগ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতার জন্য পিডিবিও দায়ী। কারণ পাহাড় কেটে অবৈধ বসতি নির্মাণের ফলে চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। পাহাড়ে অবৈধ বসতি স্থাপনের ক্ষেত্রে যেমন ভূমিদস্যুরা যুক্ত আছেন। তেমনি আমাদের ওয়াসা ও পিডিবিও জড়িত। পিডিবি বিদ্যুৎ সংযোগ না দিলেতো পাহাড়ে অবৈধ বসতিগুলো অনেক কমে যেতো।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিষয়টি ইতিবাচক দাবি করেন খুলশী বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহরেওয়াজ মিয়া। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘পাহাড়ি ওইসব এলাকাগুলো দুর্গম। আগে বিদ্যুৎ চুরি হতো। এক লাইন থেকে বাইপাস করে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতো। এতে পিডিবির আর্থিক ক্ষতি হতো। আবার এলাকাগুলো ঘিঞ্জি। একটি চুলা থেকে যেমন কয়েকটি পরিবার রান্নাবান্না করে, সেইভাবে একটি মিটার থেকে ৪-৫টি পরিবার বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। মিটারগুলো একইস্থানে থাকাতে এখন আর চুরি হচ্ছে না। বিদ্যুতের মূল্য সঠিকভাবে আদায় হচ্ছে। অথচ আগে বিদ্যুৎ যারা চুরি করতেন, তাদের অনেকবার ধরা হয়েছে, মামলা হয়েছে। এখানে আমাদের (পিডিবি) জনবলও কম। মিটারগুলো এক জায়গায় থাকার কারণে এখন কারো সাথে চোর-পুলিশ খেলতে হচ্ছে না।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধঝুঁকি না নিয়ে স্থানীয়ভাবে লকডাউনের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
পরবর্তী নিবন্ধপাহাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু