পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা এবং অভিজ্ঞতা

সাদিয়া মেহজাবিন | সোমবার , ৬ জুন, ২০২২ at ১০:৪১ পূর্বাহ্ণ

লেখার ক্ষেত্রে একাডেমিক শিক্ষা মূলত সম্পাদকের হাতে। প্রথম দিকে লিখতে গিয়ে নানান কিছু শিখেছি। প্রথমে প্রচুর বানান ভুল করতাম, প্রয়োজনীয় স্পেস না দেওয়া, দাঁড়ি কমাসহ নানান সমস্যা। একটি সুন্দর সার্থক বাক্য এসব কারণে অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠতো। কিন্তু সম্পাদকের তুমুল সহায়তায় ধীরে ধীরে ভুলের মাত্রা কমতে থাকে। তবে একদম ভুল করছি না বা আর শেখার কিছু নেই বিষয়টা মোটেও এমন ছিলো না।

প্রতিনিয়ত চারপাশে কিছু না কিছু বদলাচ্ছে। আমাদের ভাবনা হোক বা ভাবনার প্রকাশ। অনেক সময় আমরা খুব সুন্দর ভাবনাগুলোর সঠিক প্রকাশ করতে পারি না। যেকোনো নতুন কিছু শেখার আনন্দ এতেই যে আপনি ভুল করছেন। তবে যেকোনো কিছুর মূল ভাবনাটা যদি সঠিকভাবে জানা যায়, তাকে যেকোনো উপায়ে ভেঙে নতুন কিছু তৈরি করা যায়।

প্রিয়জনেরা সবসময়ে ভালো কিছু দিয়ে উৎসাহ দেয়, তা বই হোক অথবা ভাল কোনো কর্মশালার খোঁজ। তাই পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা বিষয়ক ৩৮তম কর্মশালার সাথে যুক্ত হয়েছিলাম বিগত মাসের ২০ মে-তে। লেখালেখির কাজেও একাডেমিক শিক্ষা আমার হয়নি, তাই এ সুযোগ লুফে নেওয়ার মতই ছিলো। ছোটবেলায় ছড়া লিখতে গিয়ে ভুল করলে যেমন মা-বাবারা ঠিক করে দিতেন অথবা হাতে-কলমে সঠিক উপায়ে ‘আ’ শেখাতেন তেমনভাবেই এ কর্মশালা। হাতে-কলমে শেখার আনন্দ পেতে ছুটে চলা।

বর্তমান সময়ে বই পড়ার আগ্রহ তেমন একটা দেখা যায় না। তার উপরে লেখালেখির আগ্রহ যাদের আছে তারা বাংলাতেই প্রচুর ভুল করেন। নিজেদের ভুলগুলো শুধরে নেওয়া সহ পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা বিষয়ক কর্মশালায় আগ্রহের অন্যতম কারণ সম্পাদনার প্রক্রিয়া জানা, সম্পাদনার সাথে জড়িত বাকি বিষয় সম্পর্কে অবগতি, সুন্দর লেখার ধারণা, প্রকাশনার স্টাইল ও প্রমিত বানান রীতি নিয়ে ধারণা লাভ। বলতে পারেন, লেখাতে যাদের এখনো হাতেখড়ি তাদের সম্পাদনার দিকে ধাবিত হওয়া বামুনের চাঁদ চাওয়ার মতই বেমানান। কিন্তু যতই দূরে হোক ধীর গতিতে সঠিক পথে এগোতে দোষের কিছু নেই। তাছাড়া পাণ্ডুলিপি না হোক, নিজের লেখা প্রত্যেক বাক্যকে, নিজেই সম্পাদনা করা যায়।

৩৮ তম কর্মশালাটি ছিলো সারাদিন ব্যাপী। অতিথি বক্তার উদ্বোধনীর মাধ্যমে মোট ১০ টি অধিবেশনে একদিনের এ কর্মশালাটি অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালাতে বইয়ের কলকব্জাসহ পাণ্ডুলিপি কি এবং কেন এ নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা হয়। সম্পাদনা বিষয়ের সাথে আরো নানান বিষয় জড়িত থাকে। একটি বাক্যের সম্পাদনার বদলে যদি সম্পূর্ণ বই সম্পাদনা হয় সেক্ষেত্রে অবশ্যই বিবিধ জ্ঞান রাখা আবশ্যক। আমরা অনেকে কেবল বইয়ের ভেতরে কি আছে পড়ি, ভূমিকা-ফ্ল্যাপে কি আছে, ব্যাক পেইজে কি কি আছে সেসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। কিন্তু একটি বই সম্পূর্ণ হয়ে উঠে ভালো সম্পাদনার মাধ্যমেই। ধরুন বইয়ের পরিশিষ্টে দেওয়া তথ্যগুলো আপনাকে ভালোভাবে বুঝে পড়তে যেমন সাহায্য করবে তেমন কোন বিষয়গুলো পরিশিষ্টে দিচ্ছেন তা বোঝাও জরুরি। এক্ষেত্রে আদর্শ ম্যানুয়াল হিসেবে ‘শিকাগো ম্যানুয়াল’কে ধরে এ সংক্রান্ত নানান বিষয়ে আমাদেরকে জানানো হয়। অনেক বইতে মূল নামের সাথে ছোট ফ্রন্টে বইয়ের হাফ টাইটেল দেওয়া হয়। এখন বইয়ের শুরুতে সম্পূর্ণ নাম ও হাফ টাইটেল দিয়ে কতটা পেইজ খালি রাখবেন তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। বইয়ের ফ্ল্যাপটি সবসময় ‘র‌্যাক্ট্রো’ তে হবে বা অতিরিক্ত বিশ্লেষণও লেখাকে দুর্বল করে ফেলে এমন নানাবিধ তথ্য। শব্দসংকেত সাধারণত পৃষ্ঠার নিচে দেয় কিন্তু অনেক বেশি শব্দসংকেত দেওয়ার প্রয়োজন পড়লে কীভাবে তা বইয়ের শেষে দিতে পারি তাও জানা প্রয়োজন। তাই হয়তো পাণ্ডুলিপি সম্পাদনাকে কপি এডিটিং, লাইন এডিটিং, ডেভেলপমেন্ট এডিটিংও বলা হয়।

পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা সম্পর্কে এত নিয়ম নীতির কথা বললে মনে হতে পারে এ যেনো সৃজনশীল কোনো কাজ নয়, কেবল রোবটের মতই করে যাওয়া। মূলত পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা সৃজনশীল কাজের অন্যতম অংশ কেননা একজন সম্পাদক চাইলে খুব সহজেই বলে দিতে পারেন এটা কিছু হয়নি। কিন্তু সৃজনশীল সম্পাদনা আপনাকে বিশ্লেষণমূলক মতামত দেবে এবং কোন অংশে কী কী ঠিক করা প্রয়োজন তা ধরিয়ে দেবে। অর্থাৎ খুব সহজেই একে নাকচ করে দেবে না। এটাকে উন্নয়নমূলক সম্পাদনাও বলা যায়। আবার গবেষণামূলক সম্পাদনা কিছুটা ভিন্ন। এতে সুনির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে অবগতি ও অধ্যায়ভিত্তিক বিভাজন সম্পাদক করে থাকবেন। সাথে বানানসহ প্রত্যেক ‘সেগমেন্ট’কে সুনিপুণ হাতে দেখেন।

অনুবাদও সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কেননা অনুবাদ কেবল বিদেশি ভাষা থেকে নিজের ভাষাতে একদম সরাসরি রূপান্তর নয়। একটি ভালো অনুবাদ আপনাকে মূল লেখার কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে, সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদও দিতে পারে। অনেকে আক্ষরিক অনুবাদ পছন্দ করে থাকলেও তাও সম্পূর্ণ আক্ষরিক নয় কেননা আপনি নিশ্চয় ‘আমি ভাত খাই’ এ বাক্যকে ‘আমি খাই ভাত’ লিখবেন না। আক্ষরিক অনুবাদের মূল কারণ শব্দ বা লেখকের মূল ভাব যেন হারিয়ে না যায়। তবে সেক্ষেত্রেও আমাদের স্বজাত শব্দ আমাদেরকে বাক্যের ভাবনার কাছে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে । তাই হয়তো আক্ষরিক অনুবাদের পাশাপাশি আজকাল ভাবানুবাদকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। সম্পাদনার সাথে অনুবাদের যোগসূত্র বড় নিবিড়। ধরুন ঞযব ধহংবিৎ, সু ভৎরবহফ, রং নষড়রিহম রহ ঃযব রিহফ এই বাক্যকে অনুবাদ করে লিখলেন ‘উত্তর হচ্ছে , বাতাসে আঘাত করা বন্ধু’। এটা নিশ্চয় হাস্যকর শোনাচ্ছে কিন্তু যদি এর সম্পাদনা করা হয় এমন‘উত্তরটি বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে বন্ধু মোর/আমার’ তাহলে দেখুন শুনতে ও পড়তে কতটা ভালো লাগছে। মূলত সম্পাদনার কাজটা এখানেই। একটি ভালো সম্পাদনা অনুবাদকে সাহিত্যে রূপ দেয়। ৩৮ তম কর্মশালায় অনুবাদ ও অনুবাদ সম্পাদনায় সতর্কতা বিষয়ক এ অধিবেশন ভালো অনুবাদে যেমন সাহায্য করছে, তেমন ভালো অনুবাদ চিনতেও সাহায্য করেছে।

‘প্রুফ রিডিং’ বইয়ের জন্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। পরীক্ষা দিলেন কিন্তু রি-চেক করলেন না তা হয় না। লেখার শেষে সমস্ত পাণ্ডুলিপির একাডেমিক প্রুফ রিডিং-এর ধারাবাহিক প্রক্রিয়াটি ধৈর্য্যের ব্যাপার। কেননা একবার নয় প্রায় আট দশবার করে প্রত্যেক বাক্যে চোখ ফেলতে হয়। চূড়ান্ত প্রুফ রিডিং-এর পর চেকলিস্ট তৈরি করাও সহজ নয়। প্রত্যেক ধাপে সম্পাদনার যথাযথ হাত রাখা আবশ্যক।

এমন নানান বিষয় নিয়ে সম্পাদনা বিষয়ক ৩৮ তম কর্মশালাটি অর্থবহ হয়ে উঠেছে। কর্মশালায় প্রত্যেকের জন্যে একটি নোটবুক ছিলো। নোটবুকে সারাদিনের অধিবেশনে যা যা শেখানো হয়েছে তার নোট। এছাড়াও শেষপাতায় পুস্তক সম্পাদনা ও আমাদের প্রকাশনা জগত নিয়ে দারুণ এক লেখা রয়েছে। যা পড়ে খানিক মন খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক। আমাদের প্রকাশনা জগতে সম্পাদনার বিষয় নিয়ে প্রকাশকদের তেমন মন নেই, অনেকে জানেন না। আর যারা জানেন তারা চর্চা করছেন না বা অন্যকে ছড়িয়েও দিচ্ছেন না। লেখকের লেখা শেষে সম্পাদনা টেবিল দেখবে বলে জানানো হলেও আদৌ এই সম্পাদকেরা কে তার কোনো হদিস মেলে না। তাই হয়তো অনেক বরেণ্য লেখকও তাদের আশা ব্যক্ত করেন, একটি নির্ভুল বই প্রকাশের।

কর্মশালাটি বর্তমান সময়ে তরুণদের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তরুণদের বইয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যাওয়ার এ সময়ে সম্পাদনা বিষয়ক এমন কর্মশালা আবারো নতুন উদ্যম জাগিয়ে তুলতে পারে। কর্মশালায় অবাক করার মত ব্যাপার হলো সকল বয়সের মানুষই এতে অংশগ্রহণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী , উকিলসহ নানান পেশার মানুষ। তরুণদের উপস্থিতিও কর্মশালাকে প্রাণবন্ত করেছে। তবে চট্টগ্রামে যেখানে এমন উদ্যোগের বড় অভাব সেখানে কর্মশালায় তরুণদের উপস্থিতি আরো বেশি থাকা আবশ্যক। যারা বই পড়তে ভালোবাসেন তাদের জন্যে কর্মশালা হওয়া জরুরি ফলে এমন আরো উদ্যোগ আমাদের প্রয়োজন। তাই পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা বিষয়ক ৩৮ তম কর্মশালা অভিজ্ঞিতার খাতায় নতুন সংযোজন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধউত্তমাশা অন্তরীপের দুলুনী