পাইয়োনিয়ার রীফার

| সোমবার , ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৭:৩৬ পূর্বাহ্ণ

রেফায়েত ইবনে আমিন

দুইদিন হলো সমুদ্রেঘেরা অপূর্ব সুন্দর পানামা সিটিতে হোটেলে আছি। সময়টা, ১৯৯১এর নভেম্বর মাস। নিরক্ষরেখার কাছাকাছি, গ্রীষ্মপ্রধান দেশ পানামা, তাই শীতকালেও এখানে ঠান্ডার কোনো নামগন্ধই নাই। যদিও আমরা মেরিনাররা আমাদের স্যুটকেসে সবসময়ই বিশ্বের সবদেশের আবহাওয়ার উপযুক্ত পোশাক রাখি। জাহাজ হয়তো মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকার অতি গরম দেশ থেকে উত্তর ইউরোপ বা কানাডার শীতপ্রধান দেশে যেতে পারে। অথবা উত্তর গোলার্ধের গ্রীষ্মকালে যাত্রা শুরু করে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশে যাবে, তখন সেখানে শীতকাল। আগে থেকে কিছুই জানি না, তাই প্রস্তুত থাকাই ভালো।

যাই হোক, এখানে আমি হোটেলে খাইদাই, আর আশেপাশে ঘুরে বেড়াই। নানান দেশের প্রচুর ট্যুরিস্ট এখানে। বিশেষ করে অ্যামেরিকাকানাডার অনেকেই শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে, এখানে সারা শীতকালের জন্যে চলে আসে (এদেরকে snowbird বলে)। অন্যদিকে আমি মাত্র মাসখানেক আগে দেশে বিয়ের এন্‌গজমেন্ট অনুষ্ঠান করে, এখন আবারো জাহাজে জয়েন করতে চলে এসেছি। এখানের শান্তপরিপাটি পরিবেশের রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াই, আর মনে মনে চিন্তা করি, বছর দুয়েক আগেই এখানে একটা বড়সড় ঘটনা ঘটে গিয়েছিলো। অ্যামেরিকা সৈন্যসামন্ত পাঠিয়ে সেখানের ডিফ্যাক্টো লিডার, ম্যানুয়েল নরিয়েগাকে বন্দী করে নিয়ে যায়। অথচ এককালে সেই নরিয়েগাই ছিলো অ্যামেরিকার বিশ্বস্ত বন্ধু, সিআইএর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ দোসর ও দক্ষিণ অ্যামেরিকায় মার্কিনীদের অনেক কুকীর্তির হোতা। ইংল্যান্ডে টিভিতে লাইভ দেখেছিলাম, কীভাবে তাকে নিজ দেশেই অ্যামেরিকার আর্মি ধরে মায়ামি নিয়ে গেলো, পরে তার বিচার করলো এবং জেল হলো! অথচ এখন পানামায় কী শান্তিপূর্ণ অবস্থা। আমেরিকা, নিজের স্বার্থে সেটা করেছিলো; যদিও ড্রাগট্রাফিকিং, দুর্নীতি ইত্যাদি কারণ দেখিয়েছে বা বলেছে; কিন্তু পানামা ক্যানেলের মালিকানা দাবীও ছিলো একটা অন্তর্নিহিত কারণ। ক্যানালটার প্রধান সুবিধাভোগীই তো হলো আমেরিকা।

দুইদিন পরে কোম্পানির লোকাল এজেন্ট এসে আমাকে তার গাড়িতে তুলে নিলো। সেটায় ভারতীয় চীফইঞ্জিনিয়ারও ছিলো, সে এইমাত্র এয়ারপোর্টে পৌঁছেছে। আমরা প্রায় ঘন্টাখানেক চালিয়ে বাল্বোয়া পোর্টে গিয়ে জাহাজে উঠলাম, আর জাহাজও রওনা হয়ে গেলো পানামা থেকে জাপানের উদ্দেশ্যে।

আমরা তো সকলেই জানি পানামা ক্যানাল দিয়ে আটলান্টিক ও প্যাসিফিক দুই মহাসাগর যুক্ত হয়েছে। এই ক্যানালের আটলান্টিকের পাশে রয়েছে কোলোন (Colon); আর প্যাসিফিকের পাশে রয়েছে পানামা সিটি ও সেইসঙ্গে এই বাল্বোয়া পোর্ট। স্প্যানিশে ‘কোলোন’ হচ্ছে ক্রিস্টোবাল কোলোনযাকে আমরা সকলেই চিনি ক্রিস্টোফার কলম্বাস নামে। আর বাল্বোয়াও (Vasco Nunez de Baldoa) কলম্বাসের মতই আরেক পাইয়োনিয়ার নাবিক, যে ১৫১৩ সালে প্রথম ইউরোপিয়ান প্যাসিফিক আবিষ্কার করেছিলো। এককালে এরা সকলেই হিরো অভিযাত্রী, এক্সপ্লোরার হিসাবে সম্মানিত হয়েছিলো; এখন কিন্তু জনমত পাল্টাচ্ছে। বিশেষ করে তাদের নিষ্ঠুর নির্মম অত্যাচার ও নিপীড়নের কাহিনী ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। সে ব্যাপারে আরেকদিন লিখবো।

এখন আবার আমার জাহাজে ফিরে আসি। এটার নাম পাইয়োনিয়ার রীফার। জাহাজটা হংকংএর ওয়ালেম শিপ ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি চালালেও, প্রকৃত মালিক কে সেটা জানা দুরূহ; তবে জাহাজটা পানামায় রেজিস্টার্ড। জাহাজের অধিকাংশ অফিসার আর ক্রুই হচ্ছে ইন্ডিয়ান; আমি এবং অল্পকয়েক অফিসার অন্যদেশেরপাকিস্তান ও ফিলিপিনের। জাহাজের রেজিস্ট্রেশানের ব্যাপারে “ওপেন রেজিস্ট্রি” বা “ফ্ল্যাগ অফ কনভিনিয়েন্স” কথাটা বুঝতে হবে। জাহাজের মালিক যে কোনো দেশ বা প্রাইভেট কোম্পানি বা ব্যক্তি হতে পারে। তাই বলে যে সেই জাহাজটা মালিকের দেশেই রেজিস্টার্ড হতে হবে এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নাই। কড়া আইনকানুনকে পাশ কাটানোর জন্যে, এবং ট্যাক্সের ফায়দা লাভের জন্যে এরকম নানান কারণেই নিজের দেশে অনেকেই রেজিস্ট্রি করাতে চায় না। এজন্যে অন্য বেশকিছু দেশ আগ্রহভরে সেই জাহাজকে রেজিস্ট্রি করে দিবেদেশটার লাভ রেজিস্ট্রেশানের পয়সা, আর মালিকের লাভ শিথিল আইনকানুন। অন্য আরো কয়েকটা দেশের সঙ্গে, পানামাও হলো এরকম একটা ওপেন রেজিস্ট্রির দেশ। আমাদের বর্তমান জাহাজটা সেখানেই রেজিস্টার্ড।

আর, জাহাজটার নামে রীফার আছে দেখে বুঝতেই পারছেন, এটা রেফ্রিজেরাটেড জাহাজ মানে সমুদ্রে ভাসমান একটা কোল্ডস্টোরেজ বা ডিপফ্রিজ। এর কার্গো হলো ডিপফ্রোজেন মাছমাংস। আর্জেন্টিনা আর চিলি থেকে লোড করে জাপান যাচ্ছে; মাঝপথে পানামার বাল্বোয়ায় আমরা উঠলাম। বছর তিনচারেক আগে এই একই ধরনের ফ্রোজেন কার্গো নিয়ে আমি মিস্ট্রাল নামের এক জাহাজে করে ব্রাজিল থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যেতাম দক্ষিণ আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে। এখন উল্টাদিকে চলেছি, প্যাসিফিক পাড়ি দিয়ে জাপান যাবো।

দশদিন ধরে প্যাসিফিক পাড়ি দিয়ে, হাওয়াইকে পাশ কাটিয়ে আমরা জাপানে পৌঁছে গেলাম। সমুদ্রে থাকতেই শীতের প্রকোপ বাড়তে থাকলো; আর জাপানে আসার পরে হাঁড়েহাঁড়ে টের পেলাম সেখানকার উইন্টার। এটা অবশ্য আমার জন্যে নতুন কিছু না আমার জীবনের প্রথম জাহাজে করেও চট্টগ্রাম থেকে অন্যকিছু দেশ ঘুরে জাপানেই এসেছিলাম, এবং তখনো ছিলো শীতকাল। আর প্রথম জাহাজে মেরিনারদের ট্র্যাডিশান উপলক্ষে, তখন আমার মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়েছিলো। ঠান্ডায় মগজ সব জমে গিয়েছিলো সেইবার। এরপরে হেগি থ্রি নামের আরেক জাহাজেও এখানে এসেছি, সেটাও জানুয়ারিতে, ভীষণ ঠান্ডার মাঝে।

জাপানের অনেক পোর্টে ঘুরেফিরে, শেষে আবারো প্যাসিফিক পাড়ি দিয়ে আমরা আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আয়ের্স্‌, পুয়ের্তো লাপ্লাতা, সান্তাক্রুজ এবং চিলির স্যানএন্টোনিও, ভাল্পারাইসো, ভিনাদেলমার, কার্তাহেনা বন্দরে গেলাম। সেগুলোতেই বেশ কিছুদিন চলাফেরা করলাম। খুব বেশী স্মরণীয় কিছুই ঘটে নাই সেগুলোতে। সাদামাটা নাবিকদের রেগুলার পোর্টে শোরলীভে যাওয়া, শপিংমল দোকানপাটে ঘুরে বেড়ানো আর কিছু কেনাকাটা। জাহাজের একঘেয়ে খাওয়ার বদলে, বাইরের রেস্টুরেন্টে বসে একটু খাওয়াসেগুলোতেই সময় পার করে দিলাম। আসলে আমার মনে হতো, বেশ কিছুদিন একনাগাড়ে সমুদ্রে ভয়েজ করে এসে পোর্টে থামলে, সেখানের যেকোনো মানুষকে দেখলেই ভালো লাগতো। জাহাজের বিশবাইশজন অফিসারক্রুর চেহারা প্রতিদিন দেখতে দেখতেই বোরড্‌ হয়ে যেতাম হয়তো; তাই বন্দরের নেড়ি কুকুরও ভালো, ট্যাক্সিড্রাইভারও অতি আপন বন্ধু। Chileকে আমরা বাংলায় সবসময়ই চিলি বলেই জানতাম; কিন্তু, অনেককেই চিলে উচ্চারণ করতে শুনি। সেখানের পোর্ট Cartagena কিন্তু কার্টাগেনা নয়; সেটা হলো কার্তাহেনা।

চিলিতে থাকা অবস্থায় অফিস থেকে নির্দেশ এলো জাহাজ যাবে ইংল্যান্ডের কেন্ট বন্দরে। মানে, এবারে পানামা ক্যানাল পার হয়ে প্যাসিফিকের থেকে আটলান্টিকে যেতে হবে। আমার জন্যে প্রথমবার। পরের সংখ্যায় সম্পূর্ণভাবে লিখবো পানামা ক্যানাল পাড়ি দেওয়া নিয়ে। ইংল্যান্ড যাবে শুনে তো আমি আনন্দে আটখানা। সঙ্গে সঙ্গে অফিসে জানিয়ে দিলাম, আমি সেখান থেকে সাইনঅফ করে দেশে ফিরে যাবো; কিন্তু যাওয়ার আগে সেখানে সপ্তাহখানেক থাকবো। তখন, বার্মিংহ্যামে আমার ভাই, ডাঃ ইকবাল ইব্‌নে আমিন ও ভাবী ডাঃ নাফিসা ইকবাল ভাইপো জেহিন সহ থাকে। বছর দুয়েক আগে আমিও ইংল্যান্ডে সাউথশীল্ড্‌সে পড়ালেখা করার সময়ে ওনাদের বাসায় প্রায়ই যেতাম। এখন আবারো সুযোগ পেয়ে আর হাতছাড়া করি নাই। চিলি থেকে উত্তরদিকে রওনা দিয়ে, পাঁচছয়দিনের মাথায় পানামা ক্যানাল পৌঁছলাম। ক্যানাল পার হতে যদিও দশবারো ঘন্টা লাগে, তারপরেও অপেক্ষা করা সহ প্রায় দেড়দিনের মত ব্যয় হলো। এরপরে প্রায় দুই সপ্তাহে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ইংল্যান্ডে।

ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের ট্রেনসিস্টেম বেশ ভালো। আমি এখন বুঝি, আমেরিকার থেকেও তাদের সিস্টেম অনেক ভালো। যদিও জাপানচায়না এখন আরো উন্নত বুলেট ট্রেনে এগিয়ে গেছে। যাই হোক, আমি জাহাজ থেকে কেন্টে নেমে ট্রেনে চেপে লন্ডন। তারপরে বার্মিংহ্যামে ভাইয়ের বাসায় হাজির। তারাও খুব খুশী। দুই তিনদিন সেখানে থেকে, আমি আর ভাবী মিলে আমার বিয়ের বাকি কিছু শপিং করলাম। গত জাহাজ এস্পেরাঞ্জা থেকে আমেরিকার পুয়ের্তো রিকোতে নেমে কিছু শপিং নিজে নিজে করেছিলাম। এবারে ভাবীকে পাওয়ায় সুবিধাই হলো। তারপরে সকলে মিলে আমরা লন্ডনে এসে দুদিন থেকে, আমি বাংলাদেশের ফ্লাইট ধরে চলে এলাম।

মরিনো ভ্যালি, ক্যালিফোর্নিয়া ২০২৪

refayet@yahoo.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধখাগড়াছড়িতে অটোচালক হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার ১
পরবর্তী নিবন্ধবিমামার সাধারণ সভা