পহেলা বৈশাখ : বাঙালি সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত সর্বজনীন উৎসব

| বৃহস্পতিবার , ১৪ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ

আজ পহেলা বৈশাখ। ১৪২৮ সনকে বিদায় জানিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে আজ যুক্ত হচ্ছে নতুন একটি বছর ১৪২৯। বর্তমানে দেশে পবিত্র রমজান চলছে বলে বড় কোনো উচ্ছ্বাস, আনন্দ ও উদ্দীপনা না থাকলেও জাতীয় জীবনে নববর্ষের গুরুত্ব অত্যধিক। মনকে রাঙিয়ে দিতে পারে নতুন দিনের নতুন স্বপ্ন। এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে আমাদের প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাকে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের প্রথম স্বপ্ন হলো অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে ওঠা নতুন বিশ্ব- সোনার বাংলাদেশ। বাঙালি সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত এক সর্বজনীন প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। সামাজিক ও লোক উৎসবের এই দিনটি বর্তমানে একটি সাংস্কৃতিক দিবসে রূপ নিয়েছে।
আমাদের আরো উৎসব আছে। এর মধ্যে কিছু ধর্মীয় উৎসব আর কিছু ঋতু উৎসব। কিন্তু বাংলা নববর্ষ উৎসব বাংলাদেশের সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের মহান উৎসব। সর্বজনীন উৎসব। বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আমাদের জাতীয় উৎসব।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন গণনার শুরু মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে। হিজরি চন্দ্র সন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন। ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে। পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। পূর্ব বাংলায় আধুনিক ধারার নববর্ষ চালু হয়েছে ১৯৫০-এর দশকের প্রথম দিকে। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার আমলে পূর্ববাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করেন। সেই সময় থেকে ঢাকাসহ পূর্ববাংলার বিভিন্ন শহরে নববর্ষ উৎসব চালু হয়। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকের কাছে এটি রোষাণলে পড়ে। তখন পয়লা বৈশাখ উদযাপন নিষিদ্ধ করা হয়। সরকারি ছুটি বাতিল করা হয়। বাঙালির অমিত শক্তির সামনে সেই অবদমন ধোপে টেকেনি। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন তার অমিত শক্তির বিশেষ দিক। এই দিক বাঙালির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সীমান্ত অতিক্রম করেছে। বৃহত্তর সামাজিক পাটাতনের পরিসর বাড়িয়েছে। সৃষ্টি করেছে উদ্যম ও ব্যাপ্তিতে জাতিসত্তার বলয়।
দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। স্বাধীনতার পর আমাদের জনজীবনে বাংলা নববর্ষ নবতর জাতীয় চেতনার সঞ্চার করে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার মধ্যেও বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষ। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নববর্ষ উদযাপন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সর্বজনীন উৎসবে।
পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান উৎসব। প্রয়াত লোকসাহিত্য বিজ্ঞানী অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের মতে, ‘বাংলা নববর্ষে মহামিলনের আনন্দ উৎসব থেকেই বাঙালি ধর্মান্ধ অপশক্তির কূট ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করবার আর কুসংস্কার ও কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে লড়াই করবার অনুপ্রেরণা পায় এবং জাতি হয় ঐক্যবদ্ধ।’ নববর্ষ উৎসব মানুষে মানুষে মিলনের এক মহা সম্মিলন। এ উৎসবের মাধ্যমে ভাবনার আদান প্রদান হয়, সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আমাদের যা কিছু অসুন্দর, যা কিছু অশুভ, যা কিছু অকল্যাণ-সব দূর হোক আমাদের জীবন থেকে। আমাদের জাতীয় জীবনে নেমে আসুক প্রশান্তি। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের মতো আমরাও এদিনে প্রার্থনা করতে পারি, অগ্নিস্নানে শুচি হোক বাংলাদেশ। আমরা সব জনগোষ্ঠীর মানুষ এক হয়ে ফসল উৎপাদন করি, বনভূমি রক্ষা করি, নদী রক্ষা করি, সৃষ্টির যা কিছু মহৎ সুন্দর তাকে আহ্‌বান করে মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের সমন্বয়ে প্রিয় স্বদেশের ভূখণ্ডকে সুন্দর করি। আবারও সেই আহ্‌বান, এসো, এসো হে বৈশাখ। তোমার নতুন প্রাণের উজ্জীবিত শক্তিতে আমরা পাহাড়প্রমাণ সমস্যাকে দূর করব।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বাঙালির নববর্ষ ভিন্নমাত্রা লাভ করেছে। এর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও অসামপ্রদায়িক চেতনা মানুষকে আকৃষ্ট করে। বাঙালির প্রাণের এই উৎসব মূলত বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার প্রতীকী উপস্থাপনা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে