পঞ্চাশে সোলস : ফিরে দেখা

ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন | বৃহস্পতিবার , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৮:০৩ পূর্বাহ্ণ

সত্তর দশকের শেষের দিকের কথা। পঞ্চপান্ডব বলে পরিচিত আজম খান, ফেরদৗস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর ও পিলু মমতাজ তখন বাংলা ও ফোক গানগুলো ইলেকট্রিক গীটার, ডা্রম, কীবোর্ডের মত পাশ্চাত্য যন্ত্রানুষঙ্গে গেয়ে দেশ মাতাচ্ছিলেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ টিলিভিশনে লাকী আখন্দের কন্ঠে “এই নীল মনিহার” গানটি আমার মতো অগনিত তরুণ ও যুব সমাজের হৃদয়ে রীতিমত ঝড় তুলল। পুরো দেশ যখন লাকী ভাই ও পঞ্চপান্ডবের গানের সুরে বুদ হয়ে আছে তখন চট্টগ্রামে সোলস নামের একটি অখ্যাত ব্যান্ডের হাত ধরে গানের ভূবনে ঘটছিল নিরব বিপ্লব। তখন কেউ কি জানতো, সোলসএর গান আধুনিক ও ব্যান্ড সঙ্গীতের মোড় ঘুরিয়ে দেবে? সোলসই হবে বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘায়ূ ব্যান্ড?

সাজেদ উল আলম ও মমতাজুল হক লুলুর হাতে ধরে ১৯৭২ সালে চট্টগ্রামে যাত্রা শুরু করে “সুরেলা” নামের একটি অর্কেস্ট্রা দল। এই দু’জনের সাথে যোগ দেন আরেকজন সঙ্গীতপিপাসু তরুণ সুব্রত বড়ুয়া রনি। ১৯৭৩ সালে “সুরেলা” নাম বদলে গঠিত হয় “সোলস” ব্যান্ড। তখন চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ পাড়ার অনুষ্ঠানে আধুনিক বাংলা, লালন, ভাওয়াইয়া, প্রচলিত ফোক ও হিন্দি গান পরিবেশন করে প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করে সোলস। তবে হোটেল বা ক্লাবে অনুষ্ঠান করার সময় ইংরেজী গানও পরিবেশন করত সোলস।

সাজেদ, লুলু ও রনির প্রচেষ্টায় মূলত সোলস প্রতিষ্ঠিত হলেও ব্যান্ড লীডার/ম্যানেজার ছিলেন সাজেদ উল আলম। ব্যান্ডের মূল সিদ্ধান্তগুলো তিনিই নিতেন। একজন বহুমুখী, ও অত্যন্ত প্রতিভাধর শিল্পী ছিলেন সাজেদ। হারমোনিয়াম, তবলা, ব্যাঞ্জো ও গীটার সহ এমন কোনো বাদ্য ছিলনা যা তিনি বাজাতে পারতেন না। সোলসকে বাংলাদেশের সেরা ব্যান্ড হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার তিনি স্বপ্ন দেখতেন। তিনি শক্ত হাতে ব্যান্ডের হাল ধরে সোলকে সে পথেই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৮০ সালে তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেলেই, লক্ষ্যচ্যুত হয়নি সোলস। অটুট বিশ্বাস নিয়ে কাংখিত লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হয় সোলস।

প্রতিষ্ঠালগ্নে সোলসের লাইনআপ ছিল এরকম সাজেদউলআলম: রিদম গিটার, একোর্ডিয়ান; সুব্রত বড়ুয়া রনি ড্রাম, মমতাজুল হক লুলু লিড গিটার/বেনজু, তপন চৌধুরী বাংলা গায়ক, রুডি বেস গিটার ও ইংরেজি গায়ক, লরেঞ্জো রিদম ও ইংরেজি গায়ক। পরবর্তীতে যোগ দেন নকীব খান, নাসিম আলী খান, আহমেদ নেওয়াজ, আইয়ুব বাচ্চু, পিলু খান ও, মোহাম্মদ আলী সহ আরো অনেকে। নাসিম প্রথমদিকে মূলত ইংরেজী গান গাইতেন। তাঁর গাওয়া More than I can Say গানটি আলোড়ন তুলেছিল।

যতদূর জানি, তপন চৌধুরী, রুডি, লরেঞ্জা ও আইয়ুব বাচ্চুর মত শিল্পীদের সুব্রত বড়ুয়া রনিই সোলসে টেনে আনেন। রনি দা একজন উচ্ছল ও প্রানবন্ত মানুষ ছিলেন। মনে পড়ে, ২০১৬ সালে চট্টগ্রামে আমার অডিও অ্যালবাম প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালে অসুস্থতা নিয়েও তিনি ছুটে আসেন। সাথে নিয়ে আসেন বন্ধু মো: আলী ও নেওয়াজ ভাইকে।

সত্যি বলতে কি, তপন চৌধুরী ছিল সোলসের প্রানভ্রোমরা। তপনকে বাদ দিয়ে সোলসের কথাই ভাবা যায়না। তপন চৌধুরীর গাওয়া গানগুলো সব ধরণের স্রোতাদের হৃদয়ে খুব সহজেই জায়গা করে নিয়েছিল। বন্ধু তপনের ভিন্ন মাত্রার গায়কী ও কন্ঠের যাদু পরবর্তীতে সোলসের সাফল্যের অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করি।

১৯৭৪ সালে কীবোর্ডিষ্ট হিসাবে নকীব খান যোগ দেয়ার পর সোলসএর গতিপথ বদলে যায়। নকীব খানের সুরে সোলস নিজস্ব মৌলিক গান তৈরী করতে শুরু করে। আর “সোলস” ব্যান্ড হিসাবে আত্মপরিচিতি খুঁজে পায়। গানের কথা ও মেলোডিকে গুরুত্ব দিয়ে হামিংয়ের ব্যবহার করে ব্যাতিক্রমী সুর করতেন নকীব খান। যা “সোলস”এর গানে দিয়েছে বৈচিত্র, স্রোতারা পেয়েছে নতুনত্বের স্বাদ। ফলে জয় করেছে সবার মন। গানের গুরুত্বপূর্ণ অংশে হামিংএর ব্যবহারে নকীবের সমকক্ষ আজও কেউ আছে বলে আমার জানা নেই

ব্যান্ড দলগুলোর একটি প্রতিযোগীতায় জয়ী হয়েই জাতীয় পর্যায়ে প্রথম খ্যাতির স্বাদ পায় “সোলস”। ১৯৭৭ সালে ঢাকার কেন্টনমেন্ট শাহীন স্কুলের অডিটোরিয়ামে Mod Friendship Link এবং Youth Organisation যৌথ উদ্যোগে একটি ব্যান্ড প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়। এতে ঋষিজ, স্পন্দন সহ তৎকালীন বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যান্ডগুলো অংশগ্রহন করে। প্রতিযোগীতার বিচারক ছিলেন সত্য সাহা, দেবু ভট্টাচার্য ও গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মত কিংবদন্তি সঙ্গীতজ্ঞ ও গীতিকার। প্রতিযোগীতায় সেরা কিবোর্ড বাদক হিসাবে নকীব খান এবং তাজুল ইমাম সেরা কন্ঠ শিল্পীর পুরস্কার পান। সর্বোপরি সোলস সেরা ব্যান্ড দলের শিরোপা অর্জন করে। এভাবে সোলস ঢাকায় একটি শীর্ষ ব্যান্ড হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। সোলসের আরেকটি মাইলস্টোন হচ্ছে ১৯৮১ সালে হিজবুল বাহার জাহাজে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাসফরের সময় মনোরঞ্জনের জন্য আয়োজিত সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহন। এই অনুষ্ঠানে শেফালী ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব সহ বহু জাতীয় পর্যায়ের শিল্পী অংশগ্রহন করেন।

গীতিকার, সুরকার এবং কন্ঠশিল্পী, এই তিন জনের সৃজনশীল কাজের জন্যই একটি গান সফল বা জনপ্রিয় হয়। এখানে কারো অবদান ছোটো করে দেখার মত নয়। অথচ একটি গান যখন হিট হয় তখন আমার কেবল কন্ঠশিল্পীর নামই মনে রাখি। গানের যারা মূল কারিগর অর্থাৎ সুরকার ও গীতিকার পর্দার অন্তরালেই থেকে যান। তাই সত্তর ও আশি দশকে সোলসএর উত্থানের জন্য অবদান রেখেছেন এমন কয়েকজন গীতিকার ও সুরকারের কথা এখন লিখব। এটা অনস্বীকার্য, অনেকের সন্মিলিত অবদান ও প্রচেষ্টার জন্যই সোলস আজকের এই অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, গানের ভূবনে এখনো নক্ষত্র হয়ে জ্বল জ্বল করছে। আমার লেখায়, যাদের সাথে আমার নিবিড় যোগাযোগ ছিল শুধুু তাঁদের কথাই উঠে এসেছে। তাই অনেকের নাম হয়তো বাদ পড়ে গেছে। তবে এটা স্বেচ্ছাকৃত বা কাউকে খাটো করার জন্য নয়।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে থেকে প্রকাশিত প্রথম দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ও একুশে পদক বিজয়ী জনাব আব্দুল মালেক সোলসের একজন অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর কন্যা ফাহমিদা মালেক কোহিনূর সোলসে এক সময় গান করত।

তাজুল ইমাম ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাথে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর আগ পর্যন্ত কন্ঠ শিল্পী হিসাবে সোলসএর সাথে গান পরিবেশন করেন। তিনি সোলসেএর বেশ কিছু জনপ্রিয় গানের সুরকার ও রচয়িতা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ু খুঁজিস যাহারে, এই কীর্তিনাশার তীরে, ফুটবল, কান্দিস কেনে মন পাগলারে ও শিমুল ফুটেছে, পলাশ ফুটেছে। শিমুল ফুটেছে গানটি মূলত সোলসএর জন্য করা হলেও পরে তপন চোধুরীর প্রথম সলো অ্যালবামে স্থান পায় ও তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাজুল ইমামের “পঞ্চ গায়েন” নামের একটি বাউল দল ছিল। তিনি বাউল কালা শাহ থেকে “রসিক আমার মন বান্ধিয়া”র মত বেশ কিছু বাউল গান সংগ্রহ করে সোলসএর গানের সংগ্রহকে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্রপূর্ণ করেছেন।

নকীব খানের বড় ভাই জিলু খান চট্টগ্রাম বেতারের একজন প্রখ্যাত সুরকার ও গায়ক ছিলেন। বালার্ক নামে তাঁর একটি ব্যান্ড ছিল যার সদস্য ছিল নকীব খান ও পিলু খান। জিলু ভাইয়ের সুর করা সোলসএর বিখ্যাত গানের মধ্যে রয়েছে মন শুধু মন ছুঁয়েছে, মনে কর এখন অনেক রাত, সুখ পাখী আইলো উড়িয়া ইত্যাদি। কিন্তু দীর্ঘদিন গানের জগত থেকে দূরে সরে থাকায় জিলু ভাইয়ের কথা অনেকেরই অজানা। জিলু ভাইয়ের বন্ধু কবি হেনা ইসলাম সোলসএর জন্য “কলেজের করিডোরে একদিন”, ফরেষ্ট হিলে এক দুপুরে, মনে কর এখন অনেক রাত, সুখ পাখী আইলো উড়িয়ার মত কিছু দুরন্ত গান রচনা করেছেন।

এছাড়া সোলসএর জন্য গান লিখেছেন স্বনামধন্য গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। যিনি প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্ত, ভালোবাসি সবুজ মেলা, চায়ের কাপে পরিচয় ও বাচ্চুর সুরে “একদিন ঘুম ভাঙ্গা শহরে“এর মত বেশ কিছু জনপ্রিয় গান লিখেছেন। “একদিন ঘুম ভাঙ্গা শহরে” গানটি সোলসএর হয়ে বিটিভিতে পারফর্ম করেছিল বাচ্চু। কিন্তু সোলস ছেড়ে যাবার সময় সবার অনুমতি নিয়ে গানটি বাচ্চু নিজের রক ব্যান্ড ‘এলআরবি’র জন্য নিয়ে যায়। এটি ছিল এলআরবি ব্যান্ডের প্রথম গান যা পরবর্তীতে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।

১৯৮০ সালে লীড গিটারিষ্ট সাজেদ বিদেশে চলে গেলে সোলসেএ গিটারিষ্ট হিসাবে আসে আইয়ুব বাচ্চু। আইয়ুব বাচ্চু ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত সোলসের সাথে ছিলেন। লীড গীটার বাজানোর পাশাপাশি সোলসএর জন্য কলেজের করিডোরে, ফরেষ্ট হিলের মত অনেক গানের তিনি তিনি সুর করেন।

এই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে পার্থ বড়ুয়া সোলসএ যোগ দেয়। নকীব খান ও আইয়ুব বাচ্চুর মত কিংবদন্তি সুরকারদের যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে একের পর এক জননন্দিত গান তৈরী করে সোলসএর জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছে পার্থ বড়ুয়া। সোলসে এখনো আছে আমাদের সময়কার নাসিম আলী খান। যিনি এখনো পরম মমতায় নতুন সদস্যদের নিয়ে সোলসকে আগলে রেখেছেন। সোলসএর বর্তমান লাইনাপ হচ্ছেনাসীম আলী খান: কন্ঠ, পার্থ বড়ুয়া: গীটার ও কন্ঠ, আহাসানুর রহমান আশিক: ড্রামস, মীর মাসুম: কিবোর্ড ও মারুফ হাসান: বেজ গীটার।

সোলসএর প্রায় সব সদস্যদের সাথে সখ্য থাকলেও শৈশবের বন্ধু হবার সুবাদে নকীব খানের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল একটু বেশী। নকীব খানের বাবা শ্রদ্ধেয় আইয়ুূব খান চট্টগ্রাম কাজেম আলী হাই স্কুলের আমৃত্যু প্রধান শিক্ষক ছিলেন। স্কুলের সাথেই ছিল নকীবের বাসা। ওর বাড়ীতেও আমার নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল।

৭৬/৭৭ সালের কথা। আমরা তখন চট্টগ্রাম কলেজে পড়ছি। স্কুলে পাঠ শেষ করে ভর্র্তি হলাম চট্টগ্রাম কলেজে। নকীবও আসলো একই কলেজে, জায়গা পেলাম একই সেকশানে। সোলসের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নকীবের বাড়ীতে রিহার্সাল হত। সেই সুবাদে প্রায় ওর বাসায় ব্যান্ডের অন্য সদস্যদের সাথে গানের আড্ডা জমতো। কলেজের প্রায় ২০০ মিটার দূরেই ছিল নকীবের বাড়ী। দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকে প্রায় ওর বাসায় গিয়ে আড্ডা দিতাম। নতুন কোনো গান সুর করলেই নকীব আমাকে গেয়ে শোনাতো

আমার পরিবারে লেখালেখি, সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক চর্চার একটা আবহ ছিল। সেই পারিবারিক ঐতিহ্যকে লালন করেই ছোটোবেলা থেকে কবিতা ও সঙ্গীত চর্চার দিকে ঝুঁকে পড়ি। ওই যুগে ছিলনা ফেসবুক কিংবা ম্যাসেঞ্জার চ্যাট গ্রুপ। কবিতা ও শিল্প চর্চা কিংবা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে ও খেলা ধূলো করেই সময় কাটতো। কিন্তু আমি যে ব্যান্ডের জন্য গান লিখবো সে কথা কখনো ভাবনি।

ক্লাসে দুষ্টুমি ও খুনসুটি করার যাতে সুযোগ হয় সেজন্য বসতাম গ্যালারীর সবচেয়ে পেছনের সারিতে। একবার চট্টগ্রাম কলেজের সায়েন্স গ্যালারীর শেষ মাথায় বসে আছি দ’ুজন। ক্লাসের একজন বান্ধবীকে ক্লাসরুমের সামনের দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখেই “তোরে পুতুলের মতো সাজিয়ে” গানটির ভাবনা মাথায় আসে। গানটি নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু শব্দমালা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। একটি চিরকুটে লিখে ফেললাম গানের প্রথম অন্তরা। চিরকুটটি নিয়ে বাড়ী গিয়েই গানের সুর করে ফেলে নকীব। প্রথমে গানটির প্রথম লাইনে “হৃদয়ের সোকেসে রাখবো” লিখা হয়। কিন্তু পরে বন্ধু তপন চৌধুরীর পরামর্শে সোকেসএর পরিবর্তে একটুু সহজতর “কোঠরে” শব্দটি ব্যবহার করা হয়। তোরে পুতুলের করে সাজিয়ে ছিল আমার লেখা প্রথম গান। এরপর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ফেলে আসা শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে “মুখরিত জীবন” ও কৈশোরের একটি বিয়োগান্তক ঘটনা নিয়ে লিখি “ভুলে গেছো তুমি” সহ আরো বেশ কিছুু গান। সত্তর দশকে আমরা চট্টগ্রামের দেওয়ান বাজার এলাকায় কাজেম আলী বাইলেনের শেষ মাথায় অবস্থিত “খান বিল্ডিং”এ থাকতাম। ওই বিল্ডিংএর ছাদে বসে স্মৃতিকাতর এক দুপুরে “মুখরিত জীবন” গানটি লিখি।

সোলসের চলার পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিলনা। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় সোলসের প্রথম অডিও ক্যাসেট অ্যালবাম ‘সুপার সোলস’। তবে এই অ্যালবামটি বের করতে সোলসকে অনেক কাটখড় পোড়াতে হয়েছে। ঢাকায় অনেকের দুয়ারে ধর্ণা দিয়েও প্রথমে অ্যালবামটি কিনতে কেউ আগ্রহ দেখায়নি। অবশেষে দেবু ভট্টাচার্য অ্যালবামটি প্রযোজনা করতে রাজী হন। কাকরাইলের মোড়ে ইপসা স্টুডিওতে অ্যালবামের রেকর্ডিং হয়। স্টুডিওর মালিক এবং রেকর্ডিষ্ট ছিলেন জিংগা শিল্পী গোষ্ঠির শাফায়াত আলী। অ্যালবাম করতে খচর হয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা তবে প্রযোজক সোলসকে ১৭ হাজার টাকা দিতে সন্মত হয়। ক্যাসেটটি বের হবার পর দেশজুড়ে রীতিমত শোরগোল পড়ে যায়। এটি ছিল দেশের ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসে অন্যতম সফল ও জনপ্রিয় অ্যালবাম। এরপর সোলসকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

সোলসের এই যুগান্তকারী অ্যালবামে ছিল আমার লিখা তিনটি গান তোরে পুতুলের মতো করে, মুখরিত জীবন ও ভুলে গেছো তুমি। “তোরে পুতুলে মতো করে” গানটি মূলত সোলসেএর হলেও অ্যালবাম প্রকাশনার আগেই কুমার বিশ্বজিত বাংলাদেশ টেলিভিশনে পরিবশেন করে। যা রাতারাতি বাংলাদেশের একটি অন্যতম জনপ্রিয় গান হিসাবে খ্যাতি পায়। অন্যদিকে আমার লেখা “মুখরিত জীবন” গানটির জনপ্রিয়তায় এখনো যেনো এক পরদ ধূলোও পড়েনি। হিট হবে, এজন্য কখনো গান লিখিনি। চট্টগ্রাম কলেজের সায়েন্স গ্যালারীতে বসে লেখা কিছু অসংলগ্ন পদ্য যে কালজয়ী গান হয়ে যাবে, পাঁচ দশক পর আজ একুশ শতকের প্রান্তে এসেও মানুষের মুখে মুখে ফিরবে সে কখনো ভাবিনি।

ইদানিং গান হিট হলো কিনা তা নির্ধারণ করা হয় গানটির ইউটিউবে ভিউয়ারের সংখ্যার উপর। এজন্য ব্যবহার করা হচ্ছে প্রযুক্তি। ফেসবুক, গুগুল, ইউটিউব, ও টিকটকের মত বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে দেয়া হচ্ছে অ্যাড। পত্রপত্রিকা, ও অনলাইন মিডিয়ার জন্য তৈরা হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের কনটেন্ট। এগুলো সস্তায় আসেনা। এজন্য ব্যায় করতে হয় অনেক অর্থ। বহু গীতিকবি ও কন্ঠশিল্পীরা গানকে জনপ্রিয় করার জন্য এ পথেই এগুচ্ছেন।

তবে লক্ষ লক্ষ ভিউয়ার হলেই কি একটি গানকে হিট বলা যাবে? কখখনো নয়। একটি গানের সত্যিকারের জনপ্রিয়তার বিচার করতে হয় সময়ের মাপে, ভিউয়ারের সংখ্যা দিয়ে নয়। এজন্য অপেক্ষা করতে হবে হয়তো এক যুগ কিংবা তারও বেশী। এমন অনেক গানের কথা আমরা জানি যেগুলো এক সময় ঝড় তুললেও, সময়ের ঘুর্নিপাকে কিছুদিনের মধ্যে স্রোতাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে। তাই ২০/৩০ বছর পরও একটি গান যদি মানুষের মুখে মুখে সুর তোলে তাহলেই বুঝতে হবে গানটি আসলেই হিট হয়েছে। সেই বিচারে সোলস, তাদের প্রায় প্রতিটি এলবামেই কিছু হিট গান উপহার দিয়েছে। পঞ্চাশ বছর পরও সোলসেএর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। এটা যেকোনো ব্যান্ডের জন্যই এক অনন্য প্রাপ্তি। আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান যে সোলসএর জন্য আমার লেখা গানগুলো সেই সত্তর দশক থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজন্মের স্রোতারা এখনো মনে রেখেছে। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে?

সোলসএর জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। ঢাকা দেশের রাজধানী হলেও ব্যান্ড সঙ্গীতের সুতিকাগার হল চট্টগ্রাম। এলআরবি, রেনেসাঁ, জেমসের নগর বাউল, ফিলিংস ও স্পাইডারের মত ব্যান্ডের উত্থান এই চট্টগ্রাম থেকেই।

সত্তর দশকে ব্যান্ড সঙ্গীত নিয়ে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা ছিল। মানুষ ভাবতো ব্যান্ড সঙ্গীতের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজে অনুপ্রেবশ করছে। অথচ ব্যান্ড সঙ্গীত হলেও সোলসএর গান তরুণ, যুবক, এমনকি আমাদের আগের প্রজন্মের প্রবীণরাও শুনতেন এবং উপভোগ করতেন। এটাই হচ্ছে সোলসের কৃতিত্ব।

এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে” চলতে চলতে আমাদের তারুণ্যের ব্যান্ড সোলস এখন পঞ্চাশে পা দিলেও সোলস এখনো জিইয়ে রেখেছে নিজস্ব ব্রান্ডের সুরের ধারা। বিভিন্ন্ন সময়ে কিংবদন্তি মিউজিশিয়ানরা ব্যান্ড চেড়ে চলে গেলেও পার্থ বড়ুুয়া ও নাসিম আলীর নেতৃত্বে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ধারণ করে সোলস এগিয়ে চলেছে আপন গতিতে। এদের পর হয়তো গিটার হাতে নিয়ে সোলসএর হাল ধরবে আরো এক ঝাঁক স্বপ্নবাজ তরুণ। ওদের হাত ধরে এভাবেই বেঁচে থাকবে সোলস যুগের পর যুগ।

লেখক : প্রাবন্ধিক, প্রকৌশলী

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন : আগামী পরিকল্পনা ও লক্ষ্য
পরবর্তী নিবন্ধপৃথিবীর উৎকৃষ্টতম প্রাকৃতিক মৎস্যধার ‘হালদা’ এখন মুমূর্ষু রোগী