পৃথিবীর উৎকৃষ্টতম প্রাকৃতিক মৎস্যধার ‘হালদা’ এখন মুমূর্ষু রোগী

ঋত্বিক নয়ন | বৃহস্পতিবার , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৮:০৩ পূর্বাহ্ণ

খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের পাহাড়ী গ্রাম সালদা। সালদার পাহাড়ী ঝর্ণা থেকে নেমে আসা ছড়া সালদা থেকে হালদা নামকরণ হয়। পাহাড়ি ছড়া থেকে উৎসারিত হয়ে উত্তরপূর্ব কোণ দিয়ে ফটিকছড়ি উপজেলায় প্রবেশ করেছে নদীটি। নদীর দুটি ধারাই খরস্রোতা হওয়ায় উজানের পানি দ্রুতই নেমে আসতো ভাটিতে। এ কারণে নদীর পানির সমস্যা দেখা দেয়। এই নদীর সাথে এসে পড়েছে ১৯টি বড় খাল এবং ১৭ পাহাড়ি ছড়া।

প্রায় শতবছর আগে সর্পিল হালদা পূর্ব মাদার্শা গ্রামকে ঘিরে ৮ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বাঁক নিয়ে বয়ে চলছিলো। কিন্তু ভারি বৃষ্টি হলেই নদীর এই বাঁকের কারণে পানি নামতো মন্থর গতিতে, আর এতেই তলিয়ে যেতো নদীর ভাঁটি অঞ্চলসহ দুই তীরের বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। এছাড়া তৎকালীন সময়ে যাতায়াতের একমাত্র নদীপথেও পাড়ি দিতে হতো অতিরিক্ত ৮ কিলোমিটার পথ। যদিও আড়াআড়িভাবে এই পথের দূরত্ব মাত্র আধা কিলোমিটার। ১৯৪৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর; দুর্ভোগ থেকে নিজেদের বাঁচাতে গ্রামবাসী বাড়িঘোনা বাঁকটি কেটে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তাদের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন স্থানীয় জমিদার রামকৃষ্ণ মহাজন। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকেও বৈজ্ঞানিক কারণ দেখিয়ে বাঁক কাটার বিরোধিতা করা হয়। কিন্তু নদী প্লাবিত কৃষি জমি পুনরুদ্ধারের স্বপ্নে বিভোর জনগণ এ সিদ্ধান্ত মানল না। গ্রামবাসী বাঁক কেটে দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসলে জমিদারের পক্ষে অবস্থান নেয় পাকিস্তান পুলিশ, পুরো এলাকায় জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। গ্রামবাসী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাঁক কাটতে শুরু করলে গুলি চালায় পুলিশ। স্থানীয়দের হিসেবে ওইদিন পুলিশের গুলিতে নিহত গ্রামবাসীর সংখ্যা অন্তত ৩৮ জন। সরকারি হিসেবে এ সংখ্যা ১০ জন। বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে কাটা নদীর সেই অংশকে নামকরণ করা হয় ‘শহীদ খাল’।

১৯০৫ সাল থেকে ২০০২ সালের মধ্যে স্থানীয় মানুষ ও জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের সুবিধার জন্য হালদা নদীর ১১টি বাঁক কেটে সোজা করে ফেলেছে। যে কারণে হালদা নদী তার সর্পিল বৈশিষ্ট্য হারিয়ে আর আটদশটা নদীর মত এখন অনেকটা সরলপথে প্রবাহিত হচ্ছে। এই বাঁকগুলো কেটে ফেলার কারণে নদীর দৈর্ঘ্য ২৫.২৫ কি.মি কমে গেছে অর্থাৎ ১২৩ কিলোমিটার থেকে ৯৭ দশমিক ৭৫ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। এইভাবে বাঁক কাটায় চিরদিনের জন্য নিজের গতিপথ পরিবর্তন করে হালদা। এরপর থেকে হালদায় ডিমের পরিমাণ কমতে থাকে। মৎস্য অধিদফতর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৫ সালে হালদা থেকে সংগৃহীত ডিমের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫০০ কেজি, ২০০১ সালে ৪৭,০০০ কেজি, ২০১২ সালে ২১,০০০ কেজি এবং এবার ২০২১ সালে হালদায় ডিম মিলেছে মাত্র ৮,০০০ কেজি! তবে ক্রমান্বয়ে ডিম দেওয়া কমলেও যে বছর প্রচুর বৃষ্টিপাত, অনুকূল তাপমাত্রা এবং লবনপানি কম ছিল সে সময় অনেক ডিম পাওয়ার তথ্য রয়েছে। যেমন ২০০৬ সালে প্রায় ৩৩,০০০ কেজি, ২০১৮ সালে প্রায় ২৩,০০০ কেজি এবং ২০২০ সালে ২৫,৫৩৬ কেজি ডিম পাওয়া গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আঁকাবাঁকা বৈশিষ্টের কারণেই পৃথিবীতে হালদা অনন্য। নদীর এই বাঁক গুলোই কার্পজাতীয় মাছের প্রধান বসতি। এখানেই ডিম দেয় মা মাছ। মানুষ নিজেদের অজান্তে এসব বাঁক সোজা করে ফেলায় মাছের বিচরণক্ষেত্র কমে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে পৃথিবীর উৎকৃষ্টতম প্রাকৃতিক মৎসাধার।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের জন্য মানবসৃষ্ট ১০ টি কারণের অন্যতম হিসেবে গত একশ বছরে ১১টি বাঁক কেটে দেওয়াকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ গবেষণায় ‘ফিশ বায়োলজি এনালাইসিস’ অংশের দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া।

তিনি বলেন, প্রতি বছরের চৈত্র থেকে আষাঢ় মাসের মধ্যে পূর্ণিমাঅমাবস্যার তিথিতে বজ্রসহ বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢল নামে হালদা নদীতে। ডিম ছাড়ার বিশেষ সময়কে স্থানীয়রা ‘জো’ বলে। এই জো এর সময় প্রচন্ড বজ্রপাতসহ বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের ফলে হালদা নদীর বাঁকগুলোতে পানি ঘোলা ও খরস্রোতা হয়ে ফেনাকারে প্রবাহিত হয়। এ সময় নদীর বাঁকে ভৌতরাসায়নিক ফ্যাক্টরগুলো সৃষ্টি হলে ও তাপমাত্রা অনুকূলে ২৫২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলে ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মা মাছ।

কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাড়ছে তাপমাত্রা ও সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির কারনে হালদায় বাড়ছে লবণাক্ততা। লবণ বৃদ্ধি পাওয়ায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে মা মাছের ডিম দেওয়া।

সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীন উন্নয়ন প্রকল্প যেমন রাবার ড্যাম, বালির বস্তা ও ব্লক, বিভিন্ন স্থানে স্লুইস গেইট এই নদীকে ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে গেছে। একই সাথে নদীর তীরে বিভিন্ন শিল্পকারখানা এবং হাটহাজারির ১০০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্ট এই নদী দূষণের জন্য দায়ী।

এদিকে রুই জাতীয় মাছের মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। সরকার এ নদী সংরক্ষণে ১২টি শর্ত আরোপ করেছে। সেগুলোর অন্যতম শর্ত ছিল

হালদা নদী থেকে কোনও প্রকার মাছ ও জলজ প্রাণী ধরা বা শিকার করা যাবে না। কোনও অবস্থাতেই নদীর বাঁক কেটে সোজা করা যাবে না। হালদা নদী এবং এর সংযোগ খালের ওপর নতুন করে কোনও রাবার ড্যাম এবং কংক্রিট ড্যাম নির্মাণ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ তদারকি কমিটির অনুমতি ব্যতিরেকে হালদা নদীতে নতুন পানি শোধনাগার, সেচ প্রকল্প স্থাপনের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করা যাবে না। নদীর ভূমি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয় এমন সব কাজ করা যাবে না। নদীর চারপাশের বসতবাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পয়ঃপ্রণালী সৃষ্ট বর্জ্য ও তরল বর্জ্য নির্গমন করা যাবে না। হালদা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ১৭টি খালে প্রজনন মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই) মৎস্য আহরণ করা যাবে না।

লেখক : সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধপঞ্চাশে সোলস : ফিরে দেখা
পরবর্তী নিবন্ধজৌলুস হারাচ্ছে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ