নারী আন্দোলনে নিম্নবর্গীয় নারীদের অংশগ্রহণ ও প্রাসঙ্গিকতা

বিপাশা আইরিন | শনিবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৮:৫২ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ, শ্রেণি শোষণ, নারী নিপীড়নকারী আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন করে নারী ও পুরুষের সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নারী আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয় নিয়ে অনেক নারীবাদী চিন্তক লেখালেখি করছেন। সরব আছেন বিভিন্ন মাধ্যমে, নানা অঙ্গনে। কিন্তু এই ধারার পক্ষে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন পাওয়া যায় না বললেই চলে। বুর্জোয়া দলসমূহ প্রায়শই প্রচলিত ধ্যান ধারণার সঙ্গে সমঝোতা করে উদারনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করে থাকে। সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী দলসমূহ মনে করে শ্রেণি উৎখাতের মধ্য দিয়ে বিপ্লব সংঘটিত হলে নারী শোষণেরও অবসান হবে। প্রকৃত পক্ষে শ্রেণি শোষণ বন্ধ হলেও পুরুষতান্ত্রিকতা যদি বহাল থাকে তাহলে প্রকৃত নারী মুক্তি অধরাই রয়ে যাবে।

এ-বিষয়ে একটি প্রাসঙ্গিক আলাপ আমরা করতেই পারি। যেমন একটি প্রশ্ন হতে পারে যে নারী আন্দোলন এবং নারীবাদী আন্দোলন, এই দুইয়ে কোনো পার্থক্য আছে কী-না? তাত্ত্বিক আলোচনায় এই দুটির ব্যাখ্যায় ভিন্নতা থাকতে পারে। সরলীকরণ করে কেউ বলতে পারেন যে নারীবাদী আন্দোলনে সাধারণ নারীদের চেয়ে সমাজের উচ্চবর্গীয় নারীদেরই অংশগ্রহণ বেশি। কেউ ছক কেটে দেখিয়ে দিতে পারেন যে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনে নিম্নবর্গের নারীদের অংশগ্রহণই বেশি। ঠিক এখান থেকেই আমরা পরবর্তী আলোচনাটি শুরু করতে চাই যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিম্নবর্গের নারী আন্দোলনের অবকাশ আছে কী-না?

বাংলাদেশের নারী আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করলে, আমরা অধিকাংশ সময় আধিপত্যশীল জাতি ও শ্রেণীর নারী আন্দোলনই দেখব। কারণ প্রচলিত ধারণা এই যে নিম্নবর্গের নারী গৃহে অন্তরীণ। অথচ বাংলাদেশে নিম্নবর্গের নারীরা অনেক সময় স্বত:স্ফূর্তভাবে পুরুষতান্ত্রিক ও শ্রেণিভিত্তিক ক্ষমতা কাঠামোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। প্রচলিত ইতিহাস এই সকল আন্দোলনকে অপ্রাতিষ্ঠানিক, আঞ্চলিক, অসম্পূর্ণ ও অসংলগ্ন হিসাবে সঙ্গায়িত করেছে। অথচ নারী আন্দোলনের ধারায় নিম্নবর্গের ও আঞ্চলিক প্রতিবাদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ঔপনিবেশিক শাসনামলের শেষভাগে উত্তরবঙ্গ জুড়ে যে তেভাগা কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে তাতে কৃষক নারীদের সংগ্রামী শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। তেভাগা আন্দোলনে নারীদের মারমুখী ভূমিকা ছিল পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও বৈষম্যমূলক ভূমি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। আশির দশকে চট্টগ্রামে বহুজাতিক কোম্পানির রপ্তানী প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকায় নারী শ্রমিকগণ পুরুষতান্ত্রিকতার আদলে গড়ে উঠা শিল্প প্রতিষ্ঠান ও নারীদের সস্তা শ্রম শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। শিল্পক্ষেত্রে নানাবিধ অনিয়ম ও নির্যাতন এবং নারী হিসেবে নিপীড়নের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী নারীগণ এক পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষেও লিপ্ত হন। তারা বহুজাতিক কোম্পানীর শোষণ বন্ধ করার লক্ষ্যে নারী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের দাবী দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরেন।
আমরা যদি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের
দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো সেখানকার চা বাগানগুলোতে নানা বৈষম্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় কণ্ঠে আওয়াজ তুলছেন সেখানকার নারী শ্রমিকরাই। ফলে নারীবাদী আন্দোলনে নিম্নবর্গের নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টি প্রয়োজনীয় কী-না সেটি নারীবাদী আন্দোলনের ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে বলেই মনে করি।
প্রাসঙ্গিকভাবেই যুক্ত করি যে, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি জাতীয় আন্দোলনে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখে। একসময় ছাত্র রাজনীতিতে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। আর এখনও যারা যুক্ত আছেন বলাবাহুল্য তারা সমাজতান্ত্রিক দলগুলোরই সদস্য এবং দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলে যেসকল নারী যুক্ত আছেন তারা কেবল নামেই নারী সদস্য হিসেবে যুক্ত আছেন। আথচ আজও ছাত্র রাজনীতিতে নারী এজেন্ডা অন্তর্ভুক্ত হয় নাই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক নির্যাতনমূলক অবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয় নারী ধর্ষণের ঘটনা। বাংলাদেশে সকল কর্মক্ষেত্রে নারীরা যৌন হয়রানীর শিকার হন। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানী বন্ধ করার জন্য কার্যকর উপায় আজও গ্রহণ করা হয় নাই।
বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা থেকে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে নারী সমাজের লড়াই সংগ্রামে মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে তাদের চেতনা। অত্যাচার, নিপীড়ন, লাঞ্ছনা, প্রবঞ্চনা, সন্ত্রাস ও শোষণের বিরুদ্ধে আঘাত হানার চেতনা সর্বদাই নারীদের মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল এবং আছে। কিন্তু নারীর লড়াইয়ের চেতনাকে এক ও অভিন্ন লক্ষ্যে পরিচালিত করার জন্য প্রয়োজন মতাদর্শ। গণমানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে সেই লক্ষ্য অর্জনের পথে বেগবান করার জন্য যে মতাদর্শিক নির্মাণ প্রয়োজন তা আজো নির্মিত হয় নাই। নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলোর কার্যক্রম নারীর বস্তুগত অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে আগ্রহী। কিন্তু লিঙ্গীয় অসমতা ও বৈষম্য সৃষ্টিকারী পরিবার ও সমাজ কাঠামো বদলে বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলোর ভূমিকা কতোটা কার্যকর সেটাও ভাবার বিষয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅক্টোবর সেবা মাসের কর্মকাণ্ডে লায়ন সদস্যদের ব্যাপকভাবে যুক্ত হতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধআফগান নারী-২