আফগান নারী-২

রীতু পারভী | শনিবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৮:৫২ পূর্বাহ্ণ

আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক স্থবিরতা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা আর রাজনৈতিক অস্থিরতা নারীর সামগ্রিক অবস্থাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। নারীরা তাদের অবস্থান পাল্টাতে এই খালি জায়গাটাকে কাজে লাগাতে পারে। আফগানিস্তানের বর্তমান যে অবস্থা সে জায়গাটাকে ব্যবহার করে পরিবারে এবং সমাজে নারীরা তাদের ভূমিকা নতুন করে আবিষ্কার করে নিয়ে নিজেদের এবং সাথে সাথে জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের বিরাট সুযোগ তাদের সামনে।

নারীরা জাতি গঠনে আবশ্যিক অংশ এই কথাটা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নেতাদের অবশ্যই জানতে হবে, বিশেষ করে তাদের নিজেদের ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্যই এটা বিশেষভাবে বুঝতে হবে। আধুনিক আফগানিস্তান গড়তে এবং তাদের পিতৃতান্ত্রিক শাসনক্ষমতা ধরে রাখার জন্যই নারীদের ভূমিকা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। আফগানিস্তানের রাজনীতির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে কীভাবে একটা শক্তিশালী জাতি গঠনে বিভিন্ন সময়ে নারীদের ক্ষমতার ব্যাপারে নানাবিধ পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
আফগান নারীদের ভাগ্য বারবার নির্ধারিত হয়েছে শাসক দল, বিরোধী দল, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নেতা এবং এলিটগোষ্ঠী দ্বারা। হাতিয়ার হিসেবে তারা পুনঃ পুনঃ ব্যবহৃত হয়েছে এসব গোষ্ঠীর দ্বারা। আফগান নারীরা আলাদা কোন ইন্সটিটিউশন নয়। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, এর সাথে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক প্রভাব।
দুইটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শাসনকাল এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আফগান নারীদের অবস্থা পরিবর্তনে এই দুই শাসনকাল বিশেষ প্রভাব ফেলে। ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত আমানুল্লাহ শাসন। এই শাসনামলে পরিবারে নারীদের অবস্থান খুব দ্রুততার সাথে পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছিল। এই সংস্কারের বিরুদ্ধে চারদিক থেকে প্রচন্ড প্রতিবাদ এবং প্রতিক্রিয়া হয় যার ফলে আমানুল্লাহ সরকারের পতন ঘটে। এরপর কমিউনিস্ট সমর্থিত পিউপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ আফগানিস্তানের সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে নারী ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টা। যার ফলে দীর্ঘ দশ বছরের গৃহযুদ্ধ এবং মুজাহিদিনদের উত্থান। এই দুই শাসনামলের পরবর্তী সময়কালে দেখা যায় নারীদের অবস্থান পূর্বের চেয়ে আর বেশি করে খারাপের পথে ধাবিত হয়েছিল।
যদিও এই সংস্কারগুলো বিফল গেছে তারা প্রমাণ করেছে যে এই দুই শাসনামল আফগানিস্তানে একটি সমঅধিকার সম্পন্ন সমাজে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছিল। একইসাথে এই ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ আরেকটা জিনিস পরিষ্কার করে সেটা হল, শহরকেন্দ্রিক আফগানিস্তান এবং আঞ্চলিক বা গ্রামীণ আফগানিস্তান দুইটা ভিন্ন ধারণা। ঐতিহাসিকভাবে কাবুল একটি কসমোপলিটন শহর, যাকে কেন্দ্র করে আধুনিক আফগান তৈরির সকল প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। যখন অর্থনৈতিক উন্নয়ন আঞ্চলিক এলাকাসহ হওয়ার কথা ছিল কিন্তু সেটা হয়নি। একেবারে শেকড়ে গিয়ে যে পরিবর্তনটা দরকার ছিল যা নারীর সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারত সেটা কখনো হয়নি। আঞ্চলিক বা গ্রামীণ আফগানিস্তানকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের আবশ্যিক অংশ হিসেবে গণ্য করার মাধ্যমেই কেবল নারীর অবস্থাকে পাল্টানো সম্ভব ছিল।
আফগানিস্তানের ইতিহাস কখনই মসৃণ ছিল না। বিভিন্ন জাতি, উপজাতি, ধর্মীয় ও আঞ্চলিক গ্রুপ দ্বারা এর ইতিহাস বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়েছে। ম্যাগ্নাস-ন্যাবি ১৯৯৮ পরিসংখ্যান মতে আফগানিস্তানে পশতু জাতিসত্তার মানুষ সবচেয়ে বেশি। মোট জনসংখ্যার তারা প্রায় ৪০ শতাংশ আর তাজিকরা ২০ শতাংশ। এরপর আছে হাজারাস, উজবেক আর আয়মাক জাতিগোষ্ঠী। এই স্থানিক এবং জাতিগত গ্রুপগুলো আফগানিস্তানকে কখনই একটা ঐকমত্য এবং সুসংগত সরকার গঠন করতে দেয়নি। এর সাথে আছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রভাব যা আফগানিস্তাকে উপহার দিয়েছে খন্ডিত রাষ্ট্রশাসনব্যবস্থা। বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে উপজাতিগোষ্ঠীগুলোর নেতৃত্ব প্রতিবেশী সীমান্তের যে জাতিগোষ্ঠী তাদের দ্বারা প্রভাবিত। যদিও বিভিন্ন সময়ে এই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু আফগানিস্তান কখনই একটা একক শক্তিশালী রাষ্ট্রের ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি যা এই গোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত করতে পারে। বরং তারা সবসময় সচেষ্ট থেকেছে শক্তি প্রদর্শন করে কাবুল দখল করার এবং এই শক্তি তারা প্রতিবেশী বন্ধুদের কাছ থেকে অর্জন করতো। জাতিগত দ্বন্দ্ব এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন ইসলামিক ব্যাখ্যা যা তৈরি করেছে তা হল ভিন্ন ভিন্ন বিভক্ত সংস্কৃতি। নারীদের উপর এর প্রভাব সঙ্গতভাবেই অত্যন্ত কঠোর যেহেতু নারীর জীবন সবসময়ই জাতিগত ঔজ্জ্বল্যের মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।
লিঙ্গের ভূমিকা নির্ধারণে ইসলামিক এবং সাংবিধানিক আইনের উপরে ক্ষুদ্রজাতি গোষ্ঠীর আইনকানুন এবং তাদের অর্থনৈতিক সাহায্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গ্রামীণ অঞ্চলে এক্ষেত্রে আত্মীয়তার সম্পর্কও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। জাতিগোষ্ঠীগুলো ক্ষমতার লড়াই, মর্যাদার লড়াই আর আভ্যন্তরীণ পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার লড়াই নারীদের ফেলে দেয় এক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। আন্তর্জাতিক বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের প্রথায় নারীদের গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। নারীদের তালাকের অধিকার না দেয়া, স্বামী এবং তার পরিবারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা নারীদের করা হয় চরম নির্যাতন। গৃহে আবদ্ধ রেখে, পর্দায় ঢেকে রেখে, মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে নারীদের বানান হয় ফাঁপা সম্মানের ধারক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারী আন্দোলনে নিম্নবর্গীয় নারীদের অংশগ্রহণ ও প্রাসঙ্গিকতা
পরবর্তী নিবন্ধজোসনা বালা দাশ