নারীর সমান অধিকার ও নারী দিবস

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ১৬ মার্চ, ২০২৪ at ৫:১৮ পূর্বাহ্ণ

ন্যায় ও ন্যায্যতায় বিশ্বাসী পুরুষেরা কখনও নারীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে না! সুস্থ সুন্দর পারিবারিক বন্ধনে বেড়ে উঠা পুরুষেরা নারীকে কখনও লাঞ্ছিত করে না, অসম্মান করে না। তবে দুর্ভাগ্য হচ্ছে এদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। যেপুরুষ পরিবারে লৈঙ্গিক বৈষম্যের সুযোগ পেয়ে বড় হয় তারাই সমাজকে বিষিয়ে তোলে। নারীরও একটা ভূমিকা রয়েছে পুরুষকে অসীম ক্ষমতাবান করে তোলার পেছনে। কারণ তারা পুরুষের দৃষ্টিতেই সমাজকে দেখেন। ক্ষমতার উৎস হিসেবে পুরুষকেই মানেন। প্রচলিত অভ্যাসবশত মা নারীরাই নিজের অজান্তে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বৈষম্যের দেয়াল তুলে দিয়ে বিষবৃক্ষ রোপণ করে দেয়। আমাদের নারীদের আগে বিষয়টা ভাবতে হবে। জেন্ডার সমতাভিত্তিক একটা সমাজ পাওয়া এতটা সহজ কথা নয়। আমাদের অনেক প্রস্তুতির প্রয়োজন। নারীপুরুষ নির্বিশেষে দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। নারী দিবস মানে পুরুষদের প্রতি বিষোদ্‌গার নয়। অসুস্থ প্রতিযোগিতা নয়। এটা একটি ভয়াবহ সামাজিক ও মানসিক সমস্যা। প্রতিটি সচেতন নারীপুরুষের মিলিত উদ্যোগের সমাধান সম্ভব। নারীর সমাধিকারের ব্যাপারটা শুধু কি নারীদের প্রয়োজন নাকি একটা সুস্থ সমাজ ব্যবস্থার জন্য, একটা উন্নত দেশের জন্য প্রয়োজন সেটা আগে ভাবতে হবে। সেটা আমাদের এই প্রচলিত ধ্যানধারণা দিয়ে কখনো সম্ভব নয়। অনেকে হয়তো বলবেন নারীর অগ্রগতির সূচক বেড়েছে। নিঃসন্দেহে বেড়েছে। তবে সেটা নিশ্চয়ই আমাদের সন্তুষ্টির জায়গায় নেই! ডমেস্টিক ভায়োলেন্স, ইভ টিজিং, নারীপাচার, বাল্যবিবাহের পরিসংখ্যান একেবারে স্বস্তিদায়ক নয়। সম্পত্তিতে নারীর অধিকারের ব্যাপারটা রাষ্ট্র কতটা নিশ্চিত করতে পেরেছে সেখানেও প্রশ্ন রয়ে গেছে। এসব সমস্যাগুলো শুধু নারীর নয়। এটা একটা সুস্থ সমাজ ব্যবস্থার ও সমস্যা। সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীরা বাবার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নয়। কিন্তু মুসলমান নারীরা পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হলেও সামাজিকভাবে এমন এক ব্যবস্থা, এমন এক ধারণা প্রচলন করা হয়েছে যাতে নারীরা এই সম্পত্তির মালিকানা দাবি না করে। এমনও শুনেছি পিতার সম্পত্তির ভাগ গ্রহণ করলে নাকি স্বামীর অকল্যাণ হয়। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা এই সম্পত্তির মালিকানা দাবী করেনা। নারীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার একটা পাকাপোক্ত ব্যবস্থা অনেক কাল থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। এই জায়গাগুলোতে নারীর ন্যায্যতায় রাষ্ট্রের করণীয় আছে অনেক। যেহেতু আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান একজন নারী এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নারীরা আছেন বিশ্বাস করতে চাই এসব সমস্যাগুলোর যৌক্তিক সমাধান একদিন নিশ্চয়ই হবে। সরকারের মুখটাই কেবল নারীর হলে সন্তুষ্টির কিছু নেই। এর পেছনে প্রবল পুরুষতন্ত্রের দাপট যদি থাকে তাহলে সেখানে কতটা কাজ হবে, কতটা সময় নেবে সেটা ও ভাববার বিষয়। বর্তমান সরকার নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। নারীর পক্ষে অনেক আইন হলেও এর প্রয়োগ নেই। তাছাড়া নারীরা তথ্য প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকার কারণে বৈষম্য ও সহিংসতা দুটোই বেড়েছে। সহিংসতার ক্ষেত্রে নতুন নতুন ধরন যুক্ত হচ্ছে। সাইবার ক্রাইম আ্যয়ারনেস ফাউন্ডেশন প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাইবার ফৌজদারি আদালতে এসব অভিযোগের বিচার হয়েছে। কাজেই এসব অপরাধের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যায়নি। ৮০ শতাংশ ভুক্তভোগী আইনের আশ্রয় নেন না। সাইবার বুলিং সহ নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে নানা আইন থাকলে ও সেসব আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই, ফলে নারীর অগ্রগতির প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েই আছে। বিশ্ব ব্যাংকের সমীক্ষা যদি দেখি, কৃষিতে নারীর অবদান গড়ে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ এর পরে ও তাদের জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। দরিদ্র ও ভূমিহীন হওয়ার কারণে নারী সামান্য মজুরির বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের ঋণ পাওয়ার, উন্নত প্রযুক্তির সেবা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড.বিনায়ক সেন বলেন, সম্পত্তির অধিকার এলে নারীর এমপাওয়ারমেন্ট বাড়বে। যেসব নারীর সম্পত্তির অধিকার আছে তাদের ইকোনমিক এমপাওয়ারমেন্ট অনেক বেশি। যারা কোনো না কোনোভাবে সম্পত্তির অধিকার পেয়েছে তাদের দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক গতিশীলতা ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হয়েছে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে ইউএন ওমেনের পক্ষ থেকে সমাজে সবার ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করতে নারীদের জন্য বিনিয়োগের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যের মাত্রা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব পর্যন্ত বিশ্ব অনেক সংকটের মুখোমুখি। এসব চ্যালেঞ্জ শুধু নারীদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমেই মোকাবিলা করা যেতে পারে। তাই নারীদের জন্য বিনিয়োগ করে পরিবর্তনের সূচনা করা যেতে পারে। এবং সবার জন্য একটা স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ বিশ্বমুখী রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করা যায়। নারীদের চাহিদা ও এবং অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে লিঙ্গ সমতা অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং সামাজিক সুরক্ষার জন্য সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। শুধু ৮ মার্চের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আনুষ্ঠানিকতা নয় প্রতিনিয়ত আমাদের কাজ করে যেতে হবে এই অসম সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। সেটা হবে নারী পুরুষের মিলিত সংগ্রামে।

নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হলে একদিকে যেমন নারীর জ্ঞান দক্ষতা অর্জনের সুযোগ ও অন্যদিকে দায়দায়িত্বও দিতে হবে। নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই, রাজনৈতিক সহিংসতা ও সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইকে অভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে হবে। একটা সুন্দর, সুষম, ন্যায় ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার জন্য আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকুক। আমাদের দেশে নারীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন, নারী অধিকার রক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতা সৃষ্টির জন্য নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবার ভূমিকা রাখতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘শিল্প এবং সন্তান উভয়ের জন্য সত্য হতে পারছি না’
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে কাল মহানগর আ. লীগের আলোচনা সভা