নারীর পারিশ্রমিক বৈষম্য এবং ক্লডিয়া গোল্ডিনের নোবেল

রিতু পারভী | শনিবার , ১৪ অক্টোবর, ২০২৩ at ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ

দৃশ্য ১

জিনিয়া এবং রাসেল একই গার্মেন্টস হাউজে কাজ করেন, একই পদে এবং সমান সময় ধরে কিন্তু তাদের বেতন ভিন্ন। জিনিয়া রাসেলের চেয়ে কম বেতন পান শুধুমাত্র তিনি একজন নারীকর্মী বলে।

দৃশ্য ২

সমান যোগ্যতা সম্পন্ন শম্পা এবং জাহিদ একটি ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন কিন্তু জাহিদের বেতন শম্পার চেয়ে বেশি শুধুমাত্র একজন পুরুষ হওয়ার কারণে।

লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার নারীর উপার্জনের এই যে পার্থক্য তার ইতিহাস অনেক পুরনো। নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ এবং উপার্জনের শত শত বছরের ইতিহাস নিয়ে বিস্তৃত কাজ করে এবার নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন অর্থনীতিবিদ ক্লডিয়া গোল্ডিন। এবারে অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী হিসেবে ক্লডিয়ার নাম ঘোষণা করে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস বলেন গোল্ডিন শ্রমবাজারে নারীর উপার্জন বৈষম্যের মূল কারণ গুলো বিশদভাবে উন্মোচিত করেছেন।

একজন নৃতত্ত্ববিদ হতে চেয়ে অর্থনৈতিক ইতিহাসে পিএইচডি করা ক্লডিয়া গোল্ডিন নিউইয়র্কের এক ইহুদি পরিবারে ১৯৪৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা লিওন গোল্ডিন একজন তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থাপক এবং মা লিসাইল রোজানস্কি ছিলেন একজন প্রিন্সিপাল। শৈশবে চেয়েছিলেন হতে একজন নৃতত্ত্ববিদ। অনুজীব বিজ্ঞানী পল ডি ক্রুফের ‘দ্য মাইক্রব হান্টার’ তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে এবং ক্লডিয়া গোল্ডিন নৃতত্ত্বের পরিবর্তে ব্যাকটেরিয়া নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং অণুজীব বিজ্ঞানে শুরু করেন পড়াশোনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে আলফ্রেড কানের সাথে এক ক্লাসে অর্থনীতিকে ব্যবহার করে এর ভেতর লুকানো সত্যকে উন্মোচন করার একটা বিষয় পড়াতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বছরে ক্লডিয়া অর্থনীতি নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেন ঠিক যেভাবে পল ডি ক্রুফের গল্পগুলো মাইক্রোবায়োলজির ক্ষেত্রে ঘটিয়েছিল।

তিনি প্রবলভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেন ব্যবস্থাপনা এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান নিয়ে। তিনি তাঁর উঁচু ক্লাশে গবেষণাপত্র লিখেন যোগাযোগের স্যাটেলাইট ব্যবস্থাপনা নিয়ে। অর্থনীতিতে স্নাতক করার পর তিনি পিএইচডি করার জন্য শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হোন কিন্তু তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল শিল্প প্রতিষ্ঠান নিয়ে পড়াশোনা করা। এই বিষয়ে পড়া শুরু করলেও পরবর্তীতে অর্থনৈতিক ইতিহাসের সাথেও যুক্ত হন। তিনি তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং অর্থনৈতিক ইতিহাসে অর্জন করেন ১৯৭২ সালে।

ক্লডিয়া গোল্ডিনের গবেষণা শত বছর ধরে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ এবং উপার্জনের বিশদ আলোচনা উপস্থাপন করে।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নারীর উপার্জন এবং শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ সম্পর্কে প্রথমবারের মতো বিস্তৃত গবেষণা করেছেন তিনি। অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমেরিকার শত বছরের ইতিহাসে নারীরা কীভাবে শ্রমবাজারে কাজ করেছেন এবং একই সাথে পরিবারে কাজ করেছেন, সাথে কীভাবে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তার বিস্তারিত দিক সামনে নিয়ে আসেন।

পেশা এবং পরিবার : সমতার পথে নারীদের শতাব্দী বিস্তৃত যাত্রা” ক্লডিয়া গোল্ডিনের সর্বশেষ গ্রন্থ যা ২০২১এ প্রকাশিত হয়। নারীর কাজ এবং শ্রম বাজার নিয়ে তাঁর গবেষণা থেকে বের হয়ে আসে এর প্রভাব, অর্থনীতিতে এবং অর্থনৈতিক ইতিহাসে। এই গ্রন্থ হলো অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের ভূমিকা নিয়ে তাঁর স্টাডি। শত বছর আগে কর্মজীবন কিংবা পরিবার এই দুইটির মধ্যে একটিকে বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া হতো কলেজ পাশ করা একজন নারীকে। অবস্থার পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে অসংখ্য নারী পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করছে মোটামুটি বাধাহীনভাবে এবং একই সাথে পরিবারের দায়িত্ব সামলে। কিন্তু এখনও কাজের জায়গায় এবং পরিবারে মুখোমুখি হতে হচ্ছে অসংখ্য বাধার। গোল্ডিনের “পেশা এবং পরিবার : সমতার পথে নারীদের শতাব্দী বিস্তৃত যাত্রা” শতাব্দী ব্যাপী বিভিন্ন প্রজন্মের নারীরা পেশা এবং পরিবারকে সামাল দিয়ে কীভাবে অবস্থার পরিবর্তন করেছে এবং এখন পর্যন্ত করে যাচ্ছে তা বিস্তৃত করেছে। সাথে সত্যকার শ্রমসমতার জন্য যে সমুদয় বাধা তা উন্মোচিত করেছে।

গোল্ডিন শ্রমবাজারে

দুইশ বছরের বেশি সময়কালের তথ্য বিশ্লেষণ করে ক্লডিয়া গোল্ডিন দেখান যে বেশিরভাগ জেন্ডার পে গ্যাপ বা লিঙ্গ ভিত্তিক পারিশ্রমিক বৈষম্য, শিক্ষা এবং পেশার মধ্যে যে বৈষম্য তা দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব এবং ইতিহাস তাই বলে। যাই হোক, তিনি এটা দেখিয়েছেন যে একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করা নারী এবং পুরুষের মধ্যে পারিশ্রমিকের এই বিশাল ফারাক বেড়ে যায় নারীর প্রথম সন্তান জন্মের পর।

ক্লডিয়া গোল্ডিন, তাঁর এই গ্রাউন্ডব্রেকিং গবেষণার মাধ্যমে শ্রমবাজারে নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে সামনে এনেছেন এবং লিঙ্গ ভিত্তিক পারিশ্রমিক বৈষম্যের পেছনে যে লুক্কায়িত কারণ তার বিস্তারিত, ইতিহাসভিত্তিক উপস্থাপন ভবিষ্যতে এর সমাধানের পথ খুলে দিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅন্ধকার ভেদ করে জ্বলে উঠুক বহ্নিশিখা
পরবর্তী নিবন্ধইকো ফাউন্ডেশনের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি