অন্ধকার ভেদ করে জ্বলে উঠুক বহ্নিশিখা

আলী আদনান | শনিবার , ১৪ অক্টোবর, ২০২৩ at ১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ

ধর্মের দোহাই, অন্ধকার ও অজ্ঞতার সুযোগে পৃথিবীর যেসব দেশ নারীকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে প্রতিনিয়ত পিষ্ট করে চলেছে, তাদেরই অন্যতম ইরান। দীর্ঘদিন ধরে পীড়নের নানা স্তর পার হয়েও ইরানের নারীরা দমে যায়নি। মাহশা আমিনীর মৃত্যু, তারও আগে (২০০৭ সালে) জাহরা বানি ইয়াগুবএর মৃত্যু, সাম্প্রতিক ইরানের নারীদের জাগরণযখন সারাবিশ্বের নারীদের নতুনভাবে অনুপ্রাণিত করছে, ঠিক তখনই এই আন্দোলনকর্মীদের একজন নার্গেস মোহাম্মদীর নোবেল জয় প্রমাণ করে দিল, ইরানের নারীদের এই জেগে উঠা মোটেও কোনো একা বা বিচ্ছিন্ন পথ চলা নয়। বরং সারা পৃথিবীর সকল নিষ্পেষিত মানুষের সমর্থন আছে তাদের এই অগ্রযাত্রায়। যদিও নোবেল জয়ী নার্গেস মোহাম্মদী কারান্তরীণ থাকায় সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলোতে সরাসরি অংশ নিতে পারেননি, তথাপি তিনি এ আন্দোলনের বাইরের কেউ নন। এরও আগে (২০০৩ সালে) ইরানে আরেক আন্দোলনকর্মী শিরিন এবাদি ইরানের নারী ও শিশুদের পক্ষে লড়াই করার স্বীকৃতি স্বরূপ নোবেল জয় করেছিলেন।

শিরিন এবাদি, নার্গেস মোহাম্মদী, আতেনা দায়মি, আসিয়ে আমিনি সহ অসংখ্য নারীর লড়াই, জাহরা বানি ইয়াগুব থেকে মাহশা আমিণীর আত্মত্যাগ যেইরানের মাটিতে হচ্ছে সে ইরানের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা পৃথিবীর অন্য অনেক দেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। দীর্ঘদিন ধরে মোরাল পুলিশিং, অনার কিলিং, কুমারীত্ব পরীক্ষা, নারীদের অধিক মৃত্যুদণ্ড, ৭৪ বেত্রাঘাত আইন, হিজাব না পরলে পোশাক খুলতে বাধ্য করা, সামাজিক অবস্থানে বৈষম্য, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বৈষম্য, স্টেডিয়ামে বসে মেয়েদের খেলা দেখতে নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করা সহ বিভিন্ন বর্বরতার শিকার ইরানের নারীরা হলেও, তারাও মুখে কুলুপ দিয়ে বসে থাকেনি এটাই সবচেয়ে বড় আশার বিষয়।

সভ্যতার ইতিহাস আমাদের প্রমাণ দেয় কোনো আন্দোলনের পথই মসৃণ নয়। ইরানের নারীদের জাগরণও এতো সহজে হয়নি। নার্গেস মোহাম্মদী, শিরিন এবাদি বা ইরানের হাজার হাজার নারীকে লড়াই করতে হচ্ছে স্বয়ং রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। শাসক শ্রেণির মুখের সামনে আঙ্গুল তোলা কখনোই বা কারো জন্যই সহজ নয়। আর সেই শাসক শ্রেণি যদি কথায় কথায় মৃত্যুদন্ড বা অঙ্গহানি দেওয়ার বিধান চালু রাখে বা পুলিশের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে যদি আত্মহত্যা করা বা পুলিশের হেফাজতে খুন হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা হয় সেখানে রাজপথে টিকে থাকার জন্য যে সাহস ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রয়োজন, তা ইরানের নারীদের আছে, সেটাই বারবার প্রমাণিত হয়েছে, হচ্ছে।

১৯৭৯ সালে রেজা শাহ পাহলভি সরকারের পতনের পরই মূলত ইরানের নারীদের জীবনে এই দুর্বিষহ অন্ধকার নেমে আসে। আধুনিক ইরানে আয়াতুল্লা রুহুল্লাহ খোমেনি শরীয়াহ আইন চালুর উদ্যোগ নেয়। রাষ্ট্রের অনেক অনেক সমস্যা এড়িয়ে গিয়ে নারীদের বিভিন্ন অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হয়। নারীর সাধারণ চলাফেরা ও গতিবিধিতে জুড়ে দেয়া হয় বিভিন্ন শর্ত। রাষ্ট্রের পছন্দের পোশাক পরিধান করতে বাধ্য করা হতে থাকে ইরানের নারীদের। হিজাব পরতে বাধ্য করা হয়। কেউ হিজাব না পরতে চাইলে বা নিজের পছন্দমতো পোশাক পরিধান না করলে মোরাল পুলিশিংয়ের নামে তাকে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। ১৯৮৩ সালে হিজাব পরিধান না করার শাস্তি হিসেবে ৭৪ বেত্রাঘাতের নীতি ধার্য করা হয়।

বিগত সময়ে অসংখ্য নারী মোরাল পুলিশিংয়ের শিকার হলো তার মধ্যে হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি ঘটনা বিশ্ববাসীর নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। ২০০৭ সালে জাহরা বানি ইয়াগুবকে পুলিশ হিজাব না পরার অপরাধে গ্রেফতার করে এবং পরে জানানো হয় জাহরা আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু পুলিশের বক্তব্যের বিপরীতে জাহরার বাবা মা বরাবরই দাবি করে এসেছে জাহরাকে হত্যা করা হয়েছে।

মোরাল পুলিশিংয়ের শিকার অন্য একজন নারী তেহরান আজাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। ২০১৮ সালে তাকে গ্রেফতারের পর ভ্যানে করে টেনে নিয়ে যাওয়ার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে ইরান প্রশাসনের উপর ঘৃণার উদ্রেক সৃষ্টি করেছিল সারা বিশ্ববাসীর। ২০১৯ সালে তেহরানের ওয়াটার পার্কে পানি দিয়ে খেলার সময় কয়েকজন কিশোর কিশোরীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০২১ সালে পশু ধরার কাজে ব্যবহৃত কাঠ দিয়ে একজন নারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এমন অমানিবকতা ও বর্বরতার তালিকা মোটেও ছোট নয়।

ইরানের এই মোরাল পুলিশিংয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ হয়েছে। গাসত ই এরশাদ বা গাইডেন্স পেট্রোল নামের এই বিশেষ পুলিশ ইউনিট, যা শুধুমাত্র “পোশাক সম্পর্কিত নীতি” সঠিক ভাবে না মানার অপরাধে নারীদেরকে দমন পীড়ন চালায় ও গ্রেফতার করে থাকেতাদেরকে বন্ধের দাবিতে দেশ বিদেশের বিভিন্ন মহল থেকে আওয়াজ উঠেছে। কিন্তু দেশের সকল অপকর্ম ও অপরাধের জন্য নারীর পোশাক দায়ীএমন মনোভাব নিয়ে কঠোর থেকেছে ইরান সরকার।

তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায় মাহশা আমিনীর মৃত্যু। গতবছরের সেপ্টেম্বরে পুলিশের হেফাজতে এই নারীর মৃত্যু ঘটলে যে গণজাগরণের সৃষ্টি হয়তা দেশটির মুক্তিকামী মানুষের মনে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে এক নতুন ইরানের। নার্গেস মোহাম্মদী দশ বছরের কারাদণ্ড ভোগের কারণে সেই আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে না পারলেও একজন আন্দোলনকর্মী হিসেবে তার নোবেল বিজয় বিশ্ববাসীকে একথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, মোরাল পুলিশিং করে সাময়িকভাবে দেশটির নারীদের আটকে রাখা গেলেও, বিজয় হয় কিন্তু মুক্তিকামী মানুষের!

প্রিয় পাঠক, আমরা এবার সুদূর ইরান থেকে বাংলাদেশের দিকে চোখ ফেরাই। স্বাধীন সার্বেেভৗম রাষ্ট্র বাংলাদেশে হিজাববিরোধী আইন নেই। মোরাল পুলিশিং নেই। গাইডেন্স পেট্রোল নেই। কিন্তু সবকিছুর জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করা মানুষের সংখ্যা এদেশে কম নয়। অনলাইনেঅফলাইনে, আউটডোরেইনডোরে, সভাসমাবেশ থেকে বাজারঘাটে, বন্ধুআত্মীয় পরিজন থেকে প্রশাসনে তারাই সক্রিয় যারা মনে করেন সবকিছুর জন্য নারীর পোশাক দায়ী। শুধুমাত্র পোশাকের জন্য নারীর হেনস্তা হওয়ার ঘটনা এদেশে প্রতিনিয়ত কম নয়। কিন্তু আমাদের কোন আওয়াজ নেই, কোন প্রতিবাদ নেই, আমাদের কোন কণ্ঠ নেই। আমাদের কোন সম্মিলিত ঐক্য বা প্রচেষ্টা নেই। আমাদের আছে নীরবে সয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা। এভাবে নীরবে সইতে সইতে সময় কখনো আমাদেরকে ইরানের ১৯৭৯ সালের প্রেক্ষাপটে নিয়ে যায় কিনা সেটাই শঙ্কিত হওয়ার বিষয়!

পূর্ববর্তী নিবন্ধফ্রান্সে নিষেধাজ্ঞার পরও ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ, ছত্রভঙ্গ করল পুলিশ
পরবর্তী নিবন্ধনারীর পারিশ্রমিক বৈষম্য এবং ক্লডিয়া গোল্ডিনের নোবেল