নারীবাদী পুরুষ

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ১৫ অক্টোবর, ২০২২ at ৮:৪২ পূর্বাহ্ণ

লাওসে এসে স্পাইসি রোডের কাজের গতি খুব কমে গেল। প্রথমত সেখানকার নারীদের নিয়ে যে সংস্থাগুলো কাজ করে তাদের সাথে কথা বলার, তাদের সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ খুব কম ছিল নানাবিধ অনুমোদন, অনুমতির জটিলতার কারণে। আবার শরণার্থী নিয়ে সেখানে খুব একটা কেউ কাজ করে না, যেহেতু লাওস এই অঞ্চলের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থাও লাওস ও কম্বোডিয়ায় তাদের কাজ পরিচালনা করে থাইল্যান্ড অফিস থেকে। অন্যদিকে দলের সদস্যরা একেকজন একেক দিকে চলে যাবে লাওসের রাজধানী ভিয়েন্টাইন থেকে। শেষদিনে আমরা সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এর মধ্যে কেউ কেউ টানা প্রায় দেড় বছর সেই জার্মানি থেকে হিচহাইকিং করে লাওস পর্যন্ত এসেছে। ভালোমন্দে অনিশ্চিত পথে কেটেছে একত্রে কেটেছে সবার সময়। এ এক আবেগঘন মুহূর্ত। এর মাঝে আবার দলের মধ্যে উঠেছে ভাঙনের সুর। এই পর্যায়ের ভ্রমণের পর, পরবর্তী পরিকল্পনা কতখানি বাস্তবায়ন করা যাবে এ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। নীনা, এলিনা, ইয়া এবং আমি, আমাদের চারজন মেয়ের সাথে আর ছিল ইয়ান্নিক। মেয়েরা নারীবাদ নিয়ে কথা বলবে, কাজ করবে এটাই সাধারণভাবে আমাদের মাথায় আসে। কিন্তু, একজন ছেলে হয়েও ইয়ান্নিক কেন এই নারীবাদ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির উদ্যোগের সাথে যুক্ত হয়েছে? কেবল তো ইয়ান্নিক না, আরও অনেক দেশের অনেক ছেলেই এই উদ্যোগের বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত হয়েছিল। কৌতূহল দমন করতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম ইয়ান্নিককে। ইয়ান্নিকের সহজ উত্তর, সে যেসব অধিকার উপভোগ করে, সেগুলো যেন তার মা-বোন-বান্ধবীও উপভোগ করতে পারে। এতে করে পুরুষ হিসেবে অনৈতিকভাবে বেশি সুবিধাভোগী বলে নিজের ভেতরে তৈরি হওয়া অপরাধবোধ থেকে কিঞ্চিৎ হলেও মুক্ত হতে পারবে, নিজের বিবেকের কাছে সে পরিষ্কার থাকবে যে সে তার সাধ্যের ভেতর বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের চেষ্টা অন্তত করেছে।
আমার এক প্রাক্তন সহকর্মী একবার তার নারীবাদী হবার গল্প বলছিলেন। কিশোর বয়সে তিনি প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন এক মেয়ের। উত্তরবঙ্গে জন্ম নেয়া আমার সেই সহকর্মী গ্রামের আম বাগানে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকতেন সেই মেয়েকে দেখতে। সামাজিক নির্মম প্রথায় সেই কিশোরীর তখন নাকি বিয়ের পিঁড়িতে বসার বয়স হয়ে গিয়েছিল। আমার সেই সহকর্মী জেনে গিয়েছিলাম, তার প্রথম প্রেমকে আর তার পাওয়া হবে না এই জীবনে। তখন থেকেই তার মনে প্রশ্নের উদয় হল, একই বয়সী হবার পরেও কেন মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? কেন তাকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হচ্ছে? কেন তাকে ওই বয়সে সংসারের বিশাল বোঝা কাঁধে নিতে হচ্ছে? সেই কিশোর বয়সের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি দেখলেন সর্বক্ষেত্রে নারীরা কীভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, কীভাবে তারা পেছনে পড়ে থাকছে।
২০১৬ তে আমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘পিংক’ নামে ভারতীয় একটি সিনেমা নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিল। সিনেমার মূল বিষয় ছিল, ভারতীয় সমাজের প্রেক্ষাপটে একটা মেয়ে যদি স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়, যদি মদ-সিগেরেট খায়, তাহলে সমাজ খুব সহজেই তাকে ‘খারাপ মেয়ে মানুষ’ এর তকমা এঁটে দেয়। অথচ, একটি ছেলে যদি স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়, মদ-সিগেরেট খায়, তাহলে সেটা খুব স্বাভাবিক। আর এই সিনেমার প্রচারের সময়ই অমিতাভ বচ্চন নিজেকে একজন নারীবাদী হিসেবে পরিচয় দেন। এই সিনেমা ভারতের গ্লামার জগতে বেশ প্রভাব ফেলেছিল। সেই বছরই ভারতীয় আরেক অভিনেতা, ফারহান আকতার তার কিশোরী মেয়ের কাছে ‘যৌন হয়রানী এবং ধর্ষণ’ নিয়ে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন। তার মেয়ে তাকে ক্রমাগত প্রশ্ন করত ভারতীয় সিনেমায় নারীর যে নেতিবাচক উপস্থাপন কিংবা বাণিজ্যিকীকরণ, সেগুলো নিয়ে। চিঠির এক জায়গায় অভিনেতা লিখেন, পিতা হিসেবে তিনি বালুতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে পারেন না। ভারতীয় সমাজে সকল পর্যায়ের নারীরা অনিরাপদ এবং মূলত অসমতার মধ্যে বাস করে। তিনিও তখন প্রকাশ্যে নিজেকে নারীবাদী হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করেন। শাহরুখ খান হলেন প্রথম অভিনেতা যিনি সিনেমার নাম প্রদর্শনের সময়, তার নিজের নামের আগে সহ-অভিনেত্রীর নাম বসিয়েছেন। আবার হলিউডের ‘জেমস বন্ড’ খ্যাত অভিনেতা ড্যেনিয়েল ক্রেগও নারীবাদী হিসেবে গর্ভবোধ করেন। অভিনেতাদের কথা এই জন্যই বললাম, কেননা তাদের প্রতি তো সকলের আকর্ষণ বেশি। আমাদের দেশে নারী অধিকার সমর্থন করলেও, নারীবাদী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয়া বিখ্যাত মানুষের সংখ্যা শূন্যের আগে দশমিকের ঘরে হয়ত পাওয়া যেতে পারে।
সদ্য ইউনিভার্সিটি থেকে বের হওয়া রাঙামাটির এক জুনিয়রকে প্রশ্ন করেছিলাম, সে কি নিজেকে নারীবাদী মনে করে কিনা। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আমার ফিরিয়ে প্রশ্ন করেছিল, সকল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে নারীবাদী না হওয়ার কোনো বিকল্প আছে কিনা। সে বৈষম্যহীন সমাজ চায়, আর সকলের সমান অধিকার ছাড়া বৈষম্যহীন সমাজ সম্ভব নয়।
কেন একজন পুরুষ নারীবাদী হতে হবে? এই প্রশ্নের জবাবে প্রিন্স হ্যারির উত্তর হল, জীবনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি মেয়ের যা যা প্রয়োজন, সেগুলো পাওয়া খুব সহজ নয়, যেটি একজন ছেলের জন্য কোনো সমস্যা না। মেয়েদের আর ছেলেদের ভেতরকার এই বিভেদ দূর করার জন্য অনেক সংস্থা কাজ করছে। কিন্তু, তাদের পাশাপাশি সমাজের প্রতিষ্ঠিত, সম্মানিত পুরুষদেরও এগিয়ে আসতে হবে। নারীর সম অধিকারের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা সব জায়গায় প্রকাশ্যে বলতে হবে। তবেই অন্যেরা উৎসাহিত হবে, এবং এ সংক্রান্ত ভুল ধারণা ভাঙবে।
নারীবাদ মানে, ব্রা পুড়িয়ে উন্মুক্ত বক্ষের স্বাধীনতা নয়, নারীবাদ মানে পুরুষের অধিকারের বিরুদ্ধচারণ নয়, নারীবাদ হল, নারীকে পিছিয়ে পড়া থেকে এগিয়ে নিয়ে আসা। বেগম রোকেয়া লিখেছিলেন, পুরুষ যদি গাড়ির সামনের চাকা হয়, তাহলে নারী যদি হয় পেছনের চাকা, তবে পেছনের চাকায় হাওয়া না থাকলে কেবল সামনের চাকা দিয়ে তো গাড়ি চলতে পারে না। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সব পর্যায়ের উন্নতির জন্য এই বিষয়টি বিবেচনা করেই জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থা শুরু করেছে ‘ হি ফর শী’ কার্যক্রম, যার মূল লক্ষ্য নারীর অধিকার আদায়ে পুরুষের অন্তর্ভুক্তকরণ।

নোট: স্পাইসি রোড একটি হিচহাইকিং এর মাধ্যমে জার্মানি থেকে ভিয়েতনাম ভ্রমণের উদ্যোগ, যেটির উদ্দেশ্য ছিল শরণার্থীর অধিকার এবং নারীবাদ বিষয়ে এর সদস্যদের জানার পরিধি বাড়ানো এবং ভ্রমণসঙ্গীদের সাথে অর্জিত জ্ঞান ভাগ করে নেয়া। লেখক তাদের সাথে ২০১৭ সালের কিছু সময় ভ্রমণ করেছিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফটিকছড়িতে ডায়াবেটিস ও দাতব্য চিকিৎসালয়ের যাত্রা শুরু
পরবর্তী নিবন্ধনিজের জীবন-গল্প নিয়ে একজন আনো এরনো