জীবন মহাকাব্যের কোণায় কোণায় ছড়ানো রয়েছে গল্প ও উপন্যাসের রসদ। প্রতিটা দিনের দিনলিপিতে ভাঁজ করা থাকে অসংখ্য গল্পের প্লট। নিবিড় পর্যবেক্ষণ, দক্ষতা, রচনা শৈলী, ব্যক্তি অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণকে সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে ফেলে সামাজিক মুখাবয়ব তৈরি করা থেকে গল্প, উপন্যাস ব্যক্তি থেকে সামগ্রিক হয়ে উঠে। ২০২২ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ফরাসি ঔপন্যাসিক আনি এরনো মূলত একজন আত্মজীবনী ভিত্তিক ঔপন্যাসিক। ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা, নিবিড় পর্যবেক্ষণকে সামগ্রিক সমাজবিজ্ঞানের সাথে এক সুতায় বেঁধে এবং বাস্তবতার প্রতি অনমনীয় থেকে সহজ উপস্থাপনের মাধ্যমে আনি তাঁর উপন্যাসকে ব্যক্তির গণ্ডি থেকে সামাজিক এবং সামগ্রিক এক কাঠামোতে উত্তরণ করেছেন। তাই তাঁর উপন্যাসগুলোয় উঠে এসেছে ব্যক্তি জীবনের অন্তর্দ্বন্দ্ব, শ্রেণি বৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্য, ভাষা বৈষম্য যা তিনি তাঁর আপোষহীন কিন্তু সহজ, স্বচ্ছ ভাষায় সকলের সামনে অবমুক্ত করেছেন।
আনো এরনো প্রথম ফরাসি নারী যিনি সাহিত্যে সবচেয়ে সম্মানজনক স্বীকৃতি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। নোবেল কমিটি আনো এরনোর লেখায় ‘ব্যক্তিগত স্মৃতির শেকড়, বিচ্ছেদ, সামষ্টিক বাঁধা উন্মোচন করার যে সাহস এবং ‘ক্লিনিক্যাল একিউটি’তে যে বর্ণনা তার জন্য ২০২২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেন। জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামি, ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক সালমান রুশদি, কেনিয়ার লেখক নগুগি ওয়া থিয়ঙ্গো, নরওয়ের জন ফোসের মতো লেখক ও সাহিত্যিকদের হারিয়ে আনো এই পুরস্কার জিতে নেন। ভাষা, লিঙ্গ এবং শ্রেণি বৈষম্য জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা তিনি ধারাবাহিক ভাবে এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করে তা আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসগুলোতে উপস্থাপন করেছেন এবং এক্ষেত্রে তিনি করেননি কোন আপোষ থেকেছেন নিরাবেগ।
১৯৪০ সালের ১ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সে জন্মগ্রহণকারী আনো এরনো লেখালেখিতে উৎসাহী হন ভার্জিনিয়া উলফের লেখা পড়ে। কৈশোরকাল থেকে দিনলিপি লিখতে অভ্যস্ত আনো নিজের জীবনেই খুঁজে পেয়েছেন তার লেখার প্রয়োজনীয় রসদ। বাবার জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা, সময় ও সমাজের প্রভাবে বাবার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গঠন এবং তার প্রতিফলন তিনি তাঁর উপন্যাসে আবেগহীনভাবে তুলে ধরেছেন, যেমনভাবে তিনি তুলে ধরেছেন নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ভীষণ স্পর্শকাতর ঘটনা ভাবাবেগ বর্জন করে যা তাঁর উপন্যাসকে দিয়েছে ভিন্ন এক মাত্রা। সাহসিকতার সাথে সকল বাহুল্য বর্জন করে সহজ ভাষায় চরিত্রে আরোপ করেন নান্দনিকতা আর তাতেই আত্মজীবনীময় উপন্যাস হয়ে উঠে সামগ্রিক এবং সামষ্টিক।
ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতায় কল্পকাহিনী, সমাজবিদ্যা আর ইতিহাসকে মিশেল করে আনো এরনো তাঁর পিতা মাতার জীবন কাহিনীর সাথে প্রজন্মের গল্পের যে দ্বন্দ্ব, টানাপোড়েন এবং সামাজিক আনুগত্যের পরিবর্তনের যে চিত্র তা চিত্রনের মধ্য দিয়ে ফরাসি সমাজে শ্রেণি বৈষম্য পরোক্ষে ফুটিয়ে তোলেন।
একজন নারীর অবৈধ গর্ভপাতের প্রেক্ষাপটে রচিত লেখা ‘লেভেনমঁ’ বা ‘ঘটনা’ আনো এরনোর সাহিত্য জগতে অন্যতম সৃষ্টি। ক্লিনিক্যাল একিউটি’র সাথে সহজ ভাষাশৈলী ব্যবহার করে একজন ২৩ বছরের তরুণীর গর্ভপাতের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি, যে বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা তা নিয়ে রচিত এই উপন্যাসেও রয়েছে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ছায়া এবং ক্রমশ সামগ্রিক হয়ে উঠার গল্প। ২০২১-এ এই লেখাকে উপজীব্য করে তৈরি হয় চলচ্চিত্র। আনো এরনো নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তি জীবনের ঘটনাকে, অতীত ইতিহাসকে সমাজ বিজ্ঞানের বিশ্লেষণে তাঁর উপন্যাসে উপস্থাপন করে গেছেন।
আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস লেখক আনো এরনোর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস
‘লে জার্মোয়ার ভিদ’ বা ‘শূন্য আলমারিগুলো’। ‘লা প্লাস’ বা ‘এক পুরুষের গল্প’ বাবার জীবনের কাহিনী এবং ‘নাম উন ফাম’ বা ‘এক নারীর গল্প’ মা’য়ের জীবনের গল্পকে উপজীব্য করে লেখা তাঁর দুই উপন্যাস। ‘ল্য জ্যনম’ বা ‘এক যুবকের গল্প’ তাঁর এক রাশিয়ান প্রেমিকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা উপন্যাস। ‘পাসিওঁ সাঁপল’ বা ‘সহজ কামনা’ আনো এরনোর ইংরেজিতে অনুদিত প্রথম উপন্যাস। তাঁর প্রথম সামষ্টিক আত্মজীবনী ‘লেজানে’ বহুল আলোচিত কাজ। এই গ্রন্থটি আনো এরনোকে এনে দেয় আন্তর্জাতিক খ্যাতি। ‘সমাজবৈজ্ঞানিক মহাকাহিনী’ বলে এটাকে অবিহিত করেন জার্মান কবি ডুর্স গ্রুনবাইন এবং এটি কাজ এক নতুন পথ উন্মুক্ত করে সাহিত্য জগতে। ‘দ্য ইয়ারস’ নামে অনূদিত এই বই বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলে নির্বাচকরা এটিকে
সাহিত্যের শ্রেণীর ধারণাটিকে দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়া এক অত্যুৎকৃষ্ট সাহিত্যকর্ম হিসেবে বর্ণনা করেন এবং বলেন এই বইটিতে ‘আত্মজীবনীকে এমন একটি নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে, যা একই সাথে ব্যক্তিনিষ্ঠ ও নৈর্ব্যক্তিক, এবং একই সাথে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক।’