নতুন করে উত্তাপ ছড়াচ্ছে গৃহকর ইস্যু

বুধবার নগর ভবন ঘেরাও করবে করদাতা সুরক্ষা পরিষদ

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ১৩ মার্চ, ২০২৩ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

প্রস্তাবিত পৌরকরের (হোল্ডিং ট্যাক্স ও রেইট) বিরুদ্ধে করদাতাদের দায়েরকৃত আপিলের শুনানি অব্যাহত রেখেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। প্রতি সপ্তাহে একটি করে শুনানিতে অংশ নিচ্ছেন স্বয়ং সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তার দাবি, আপিলে ছাড় পেয়ে সন্তুষ্ট করদাতারা।

এদিকে প্রস্তাবিত পৌরকর বাতিল ও আয়তনের উপর গৃহকর নেয়ার দাবিতে নগর ভবন ঘেরাওয়ের আয়োজন করছে চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ নামে একটি সংগঠন। আগামী বুধবার অনুষ্ঠেয় এ কর্মসূচিকে ঘিরে প্রতিদিন প্রচারপ্রচারণা চালাচ্ছে সংগঠনটি। এ অবস্থায় করদাতা ও করগ্রহীতার (চসিক) বিপরীত অবস্থানে নগরে নতুন করে উত্তাপ ছড়াচ্ছে গৃহকর ইস্যু।

এ বিষয়ে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি, মানুষের উপর যাতে জুলুম না হয় এবং মানুষ যাতে চাপে না পড়ে সেজন্য রিভিউ বোর্ডে শুনানির মাধ্যমে সহনীয় পর্যায়ে গৃহকর নির্ধারণ করে দেব। সে আলোকে করদাতাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী গৃহকর নির্ধারণ করে দিচ্ছি। এতে করদাতারা সন্তুষ্টচিত্তে বাসায় ফিরে যাচ্ছেন। এর মধ্যেও তারা কেন নগর ভবন ঘেরাও করবে বুঝতে পারছি না। আসলে একটি কুচক্রী মহল চায় না চট্টগ্রামের উন্নয়ন হোক। তারা চায় চট্টগ্রামের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হোক। যদিও তাদের এসব কর্মকাণ্ডের উপর নগরবাসীর কোনো সমর্থন নেই।

তিনি বলেন, আমি নগরবাসীর সঙ্গে যে কমিটমেন্ট করেছি সেটা বাস্তবায়ন করব। অ্যাসেসমেন্ট যেটা তা বলবৎ থাকবে। করদাতারা তার বিরুদ্ধে আপিল করবেন। শুনানিতে তা সহনীয় করে দেব। তিনি বলেন, প্রকাশ্যে সরকারের ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা আইনগতভাবে দণ্ডনীয় অপরাধ। আইন ও বিধি না জেনে আন্দোলন করা উচিত না।

জানা গেছে, মেয়রের প্রস্তাবে মন্ত্রণালয় স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করায় ২০১৭ সালের পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়নের (রিঅ্যাসেসমেন্ট) আলোকে ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে কর আদায়ে কার্যক্রম শুরু করে চসিক। যার প্রতিবাদ জানিয়ে একই বছরের ২৩ আগস্ট থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ। পরে আন্দোলন জোরালো হলে ১৪ ডিসেম্বর থেকে প্রতি সপ্তাহে রিভিউ বোর্ডের শুনানিতে অংশ নেন মেয়র। সর্বশেষ গতকাল রাজস্ব সার্কেল৪ এর আওতাধীন ওয়ার্ডগুলোর ৩০০টি আপিল নিষপত্তি করে মেয়রের উপস্থিতিতে আপিল বোর্ড। যথারীতি এবারও করদাতারা সন্তুষ্ট হয়েছে বলে জানান মেয়র।

এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, করদাতারা ‘সন্তুষ্ট’ হওয়ার পরও আন্দোলন কেন? অবশ্য ২০১৭ সালে প্রস্তাবিত গৃহকর স্থগিত হওয়ার পূর্বে তিন হাজার ৯৭৮টি আপিল নিষ্পত্তি করেছিল চসিক। এর মধ্যে তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন নিজে উপস্থিত থেকেও অনেকগুলো আপিল নিষ্পত্তি করেন। তখন তিনি ‘সর্বোচ্চ ছাড় পেয়ে করদাতারা সন্তুষ্ট হচ্ছেন’ বলেও দাবি করেছিলেন। এরপরও ওই সময় আন্দোলন থামেনি। বর্তমানেও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

করদাতারা ‘সন্তুষ্ট’ হওয়ার পরও আন্দোলন কেন? জানতে চাইলে সাবেক কাউন্সিলর এবং চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদের সহসাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদৌস পপি আজাদীকে বলেন, করদাতারা সন্তুষ্ট হচ্ছেনএ দাবি মেয়র করবেন সেটাই স্বাভাবিক। আসলে তিনি বাস্তবতার বাইরে গিয়ে কথা বলছেন। বাস্তবতা হচ্ছে ট্যাঙ আদায় করতে হয় কালেক্টরদের। সেখানে মানুষ সাড়া না দেয়ায় মেয়র নিজেই মাঠে নেমে গেছেন। সেখানেও তো সবাই সাড়া দিচ্ছে না। এখান থেকেই তো বাস্তবতা বোঝা যায়। তাছাড়া আমাদের মূল দাবি হচ্ছে বাড়িভাড়ার পরিবর্তে আয়তনের উপর গৃহকর ধার্য করতে হবে।

তিনি বলেন, গৃহকর আদায় করা হয় রাজস্ব সার্কেল অফিসে। অতিরিক্ত করের কারণে যখন লোকজন সেখানে যাচ্ছে না তখন মেয়র ঘোষণা দিলেন ৪১ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অফিসে ট্যাঙ নেয়া হবে। সেখানেও লোকজন যায়নি। এরপর মেয়র প্রতি সপ্তাহে বা দুই সপ্তাহে একবার করে কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করে শুনানি করছেন। সেখানে হয়তো অল্প কিছু মানুষকে কমিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু এখানে লক্ষণীয়, সামগ্রিকভাবে যেভাবে ট্যাঙ আদায় করার কথা সেভাবে ট্যাঙ আদায় হচ্ছিল না। এর কারণ অতিরিক্ত করের বোঝা। তাছাড়া মেয়র কতটুকু মওকুফ করতে পারবেন সেটারও নির্দিষ্ট আইনি ক্ষমতা আছে।

সাবেক এ কাউন্সিলর বলেন, প্রত্যেক করদাতাকেই আপিল করতে হচ্ছে। যদি শতভাগ করদাতাকে আপিল করতে হয় তাহলে বোঝাই যাচ্ছে ওই গৃহকর নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় ঝামেলা আছে। শহরে দুই লাখের বেশি করদাতা আছেন। এখন মেয়র কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করে সপ্তাহে শদুয়েক মানুষকে ছাড় দিচ্ছেন। দুই লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছা কি তার পক্ষে সম্ভব?

নগর ভবন ঘেরাও কর্মসূচি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৪১ ওয়ার্ডে আমরা সভা করেছি। লিফলেট বিতরণ করেছি। স্থানীয় লোকজনই আমাদের বলছেন নগর ভবন ঘেরাও করতে। তারা আমাদের সঙ্গে থাকবেন। আশা করছি বুধবার সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিবেন।

জানা গেছে, চসিকের পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়ন শেষে ২০১৭২০১৮ অর্থবছরে নগরের সরকারিবেসরকারি এক লক্ষ ৮৫ হাজার ২৪৮টি হোল্ডিংয়ের বিপরীতে ৮৫১ কোটি ৩০ লাখ ৬৪ হাজার ৫৫৯ টাকা পৌরকর আদায়ের প্রস্তাব করা হয়, যা পূর্বে ছিল ১৩১ কোটি ৯১ লাখ ৮৭ হাজার ৪১ টাকা। অর্থাৎ এক লাফে ৫৪৫ দশমিক ৩২ শতাংশ গৃহকর বৃদ্ধি পায়।

করদাতারা বলছেন, পূর্বে ভবনের মূল্যায়ন করা হতো বর্গফুটের ভিত্তিতে। কিন্তু ২০১৭২০১৮ অর্থবছরে রিঅ্যাসেসমেন্ট করা হয় ভবনের ভাড়া বা আয়ের বিপরীতে। এতে এক লাফে কর বহু গুণে বেড়ে গিয়েছিল। ওই সময় করদাতা সুরক্ষা পরিষদের আন্দোলন ও নগরবাসীর আপত্তির পর মন্ত্রণালয় স্থগিতাদেশ দেয়ায় ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর থেকে ‘বর্ধিত’ সেই গৃহকর আদায় করেনি চসিক।

পরে ২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর চসিকের তৎকালীন প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে স্থগিত হওয়া রিঅ্যাসেসমেন্টের আলোকে পৌরকর আদায়ের প্রস্তাব দেন। এর প্রেক্ষিতে একই বছরের ২৫ অক্টোবর সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় মন্ত্রণালয়।

বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পর ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রস্তাব দেয় চসিক। পরদিন সিটি মেয়রের নির্দেশে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করে চসিকের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ শহীদুল আলম এ বিষয়ে সহযোগিতা চান। এর প্রেক্ষিতে একই বছরের ১৮ জানুয়ারি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এরপর ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত চসিকের বর্তমান পর্ষদের ১৪তম সাধারণ সভায় ২০১৭২০১৮ অর্থবছরের স্থগিতকৃত গৃহকর মূল্যায়নের আলোকে ২০২২২০২৩ অর্থবছর থেকে কর আদায়ের সিদ্ধান্ত হয়। বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেয়ার চার মাসের মাথায় ২০২০ সালের ৩ জুন স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার চেয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল চসিক।

উল্লেখ্য, চসিকের নিজস্ব আয়ের মূল উৎস পৌরকর। সিটি কর্পোরেশন অ্যাক্ট ২০০৯ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই চসিক মোট ১৭ শতাংশ পৌরকর আদায় করে থাকে। তার মধ্যে ৭ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাঙ (গৃহকর), ৩ শতাংশ বিদ্যুতায়ন রেইট এবং ৭ শতাংশ আবর্জনা অপসারণ রেইট রয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসারা দেশে প্রথম রাফসান থাকেন হালিশহরে
পরবর্তী নিবন্ধছাড় পেয়ে খুশি ভবন মালিক