নতুন আলো ছড়িয়ে দিল মঙ্গল বারতা

চট্টগ্রামে পহেলা বৈশাখে প্রাণের জোয়ার

ঋত্বিক নয়ন | মঙ্গলবার , ১৬ এপ্রিল, ২০২৪ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

বাঙালির জীবনে প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। আবহমান কাল থেকেই আমাদের সত্তায়, চেতনায় ও অনুভবে গভীরতর মধুর সম্পর্ক নিয়ে বিরাজ করছে পহেলা বৈশাখ। নগরীর সিআরবির শিরীষতলা, ডিসি হিল, শিল্পকলা একাডেমি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্নস্থানে নানা আয়োজনে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া হয়েছে। রোববার (১৪ এপ্রিল) সকাল থেকে সামাজিকসাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানে বরণ করে নেন বাংলা নববর্ষকে।

বাঙালির উৎসব আতিশয্যের দিন পহেলা বৈশাখ। ঈদের আমেজ না কাটতেই পহেলা বৈশাখের আগমন এ বছর বাঙালির উৎসবে যোগ করেছে বাড়তি মাত্রা। প্রতি বছরই প্রাণের টানে আমজনতা ছুটে যায় সিআরবির শিরিষতলায় কিংবা ডিসি হিলের শ্যামল ছায়ায়। মঙ্গল শোভাযাত্রার ধ্বনি পৌঁছে যায় নগরীর ঘরে ঘরে। তাপদাহ আর প্রখর রোদ উপেক্ষা করে প্রাণের সম্মিলন ঘটে পহেলা বৈশাখের উৎসবে।

সিআরবির শিরীষতলায় বর্ষবরণ : নাচেগানে জমজমাট পুরো এলাকা। অনেক দিন পর প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে ছুটে এসেছেন সবাই। বাঙালি নারীর ঐতিহ্য শাড়ি, পুরুষরা পাঞ্জাবি পড়ে এসেছিলেন অনুষ্ঠানস্থলে। শিশুরা মুখে বা হাতে রংতুলি দিয়ে আঁকিয়ে নেয় ‘শুভ নববর্ষ’। নগরীর সিআরবির শিরিষতলায় এবার পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ষোড়শ আয়োজন শুরু হয় রোববার সকাল ৭টায় ভায়োলিনিস্ট চিটাগংয়ের বেহালা বাদনের মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠানে সিআরবি রক্ষা আন্দোলনে অনন্য ভূমিকার জন্য নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান ড. অনুপম সেনের হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হয়। এসময় তিনি বলেন, সিআরবি প্রাকৃতিক সম্পদ। এটা শুধু চট্টগ্রামবাসীর নয়, সারা দেশের সম্পদ। অনুষ্ঠানে দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেককে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।

দিনব্যাপী বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে সমবেত সংগীত পরিবেশন করে সংগীত ভবন, সুর সাধনা সংগীতালয়, সুরাঙ্গন, সৃজামি, স্বরলিপি, কুসুম ললিতকলা একাডেমি, বাংলাদেশ রেলওয়ে, ছন্দানন্দ, অদিতি সংগীত

একাডেমি, সুন্দরম, উদীচী, আওয়ামী শিল্পী গোষ্ঠী, রাগেশ্রী, শিল্পাঙ্কন, সুরধ্বনি, আরকে মিউজিক। আবৃত্তি পরিবেশন করে বোধন, উচ্চারক, প্রমা, শব্দনোঙর, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, নির্মাণ। নৃত্য পরিবেশন করেনটরাজ, সুরাঙ্গন, গুরুকুল, ওরিয়েন্টাল ডান্স সেন্টার, নৃত্য নিকেতন, ঘুঙুর, নিক্বণ, নৃত্যরূপ, চারুতা, সঞ্চারী, ওড়িশি অ্যান্ড টেগোর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টার। শেষে নববর্ষ উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের নেতৃত্বে সকলে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করে।

ডিসি হিলে বর্ষবরণ : রোববার সূর্যোদয়ের সময় ‘পহেলা বৈশাখ বাঙালির উৎসব সবার যোগে জয়যুক্ত হোক’ স্লোগানে শুরু হয় বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢল নামে মানুষের। বর্ণিল সাজে সব বয়সী মানুষ ছুটে আসে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। এবারের বর্ষবরণে দিনব্যাপী আয়োজনে সংগীতে অংশ নেয়সংগীত ভবন, ছন্দানন্দ, সুরসাধনা, জয়ন্তী, রাগেশ্রী, সৃজামি, উদীচী, গীতধ্বনি, শান্তঞ্জলি, শাস্ত্রীয় সংগীত নিকেতন, ফতেয়াবাদ সংগীত নিকেতন, মিতালি, খেলাঘর মহানগর, ইমন কল্যাণ সংগীত বিদ্যাপীঠ, আরকে মিউজিক, শহীদ মিলন সংগীত বিদ্যালয়, বংশী শিল্পকলা একাডেমি, কুসুম ললিতকলা একাডেমি, অনন্যা ও সুন্দরম। নৃত্যে অংশ নেয় কায়া আশ্রম, নটরাজ, স্কুল অব ওরিয়েন্টাল ডান্স, ওডিসি অ্যান্ড টেগোর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টার, ঘুঙুর, সঞ্চারী, সুরাঙ্গন, দি স্কুল অব ক্লাসিক অ্যান্ড ফোক ডান্স, নৃত্যানন্দন, নৃত্য নিকেতন, অঙ্গনা, ধ্রুপদ, সৃষ্টি, নৃত্যরূপ, কৃত্তিকা ও নিপ্পন। আবৃত্তি পরিবেশন করেবোধন, উচ্চারক, নরেন, শৈশব, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, স্বরনন্দন, প্রমিত বাংলা চর্চা, প্রমা। এছাড়া জাদু প্রদর্শন করেন রাজীব বসাক।

চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা : নববর্ষে মঙ্গলবার্তা নিয়ে বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। প্রতিবারের মতো এবারও মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে চবি চারুকলা ইনস্টিটিউট। ‘এই বৈশাখে বৈশ্বিক বৈভবে’ স্লোগানে রোববার সকাল সাড়ে নয়টার চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রাটি নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে শেষ হয়।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন : গ্রামবাংলার প্রাচীন লোকজ ঐতিহ্যের নানা উপকরণপালকি, পুতুল, রঙিন প্ল্যাকার্ড নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। রোববার সকাল ৯টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমির সামনে বেলুন উড়িয়ে পহেলা বৈশাখের বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম। এর পর ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ শ্লোগানে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রাটি প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের সভাপতিত্বে ও সিনিয়র সহকারী কমিশনার রাজীব হোসাইনের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি নুরে আলম মিনা, জেলা পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মহানগর ইউনিট কমান্ডার মোজাফফর আহমদ, সংসদের চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট কমান্ডার (ভারপ্রাপ্ত) এ কে এম সরোয়ার কামাল। অনুষ্ঠানে চিত্রাংকনসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী চট্টগ্রাম জেলা শিশু একাডেমির শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন প্রধান অতিথিবৃন্দ। শেষে অনুষ্ঠান মঞ্চে দলীয় সংগীত ও দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন চট্টগ্রাম জেলা শিশু একাডেমি ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির শিক্ষার্থীরা। জেলা শিল্পকলা একাডেমি সংগীত দল, শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেয়।

জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, চট্টগ্রাম : বাংলা নববর্ষ বরণ উপলক্ষে ‘আলপনার রঙে নববর্ষ আবাহন’ শীর্ষক বর্ণিল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, চট্টগ্রাম। ‘যাবার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও’ গানের সঙ্গে ঢোলের বাদ্যে শিল্পীরা যখন গানে মেতেছেন, তখন সড়কে রঙ তুলিতে আলপনা সাজিয়ে তুলছিলেন চিত্রশিল্পীরা। ডিসি হিলের মূল ফটক থেকে বৌদ্ধ মন্দির মোড় পর্যন্ত ৫০ জন চিত্রশিল্পী রঙ তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলেন আলপনা। উদ্বোধনী পর্বে ডা. একিউএম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শিল্পী কে এম এ কাইয়ূম, অধ্যাপক সৌমেন দাশ, চিত্রশিল্পী স্বপন আচার্য, পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শ্রেয়সী রায় বক্তব্য দেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শিল্পী জাহেদ আলী চৌধুরী, প্রদ্যুৎ মজুমদার, সুকান্ত চৌধুরী, বিশ্বজিৎ তলাপাত্র। এদিকে, রোববার সকাল ৮টা থেকে এনায়েত বাজারের মহিলা কলেজ, চট্টগ্রাম মাঠে বর্ষবরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়। সম্মিলন পরিষদের বাংলা বর্ষবরণের সাংস্কৃতিক আয়োজনে পরিষদের সদস্যরা পরিবেশন করেন স্বদেশ পর্যায়ের গান। কথামালায় অংশ নেন ড. অনুপম সেন, অধ্যাপক এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক রীতা দত্ত, সাহিত্যিক ফেরদৌস আরা আলীম, ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী প্রমুখ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিশুর মৃত্যু, পিটিয়ে চিকিৎসককে আইসিইউতে পাঠালেন স্বজনরা
পরবর্তী নিবন্ধপবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপিত