নজরুল : এক অনন্য সত্তা

সোমা ধর | বুধবার , ২৫ মে, ২০২২ at ৬:৫৪ পূর্বাহ্ণ


আমি চিরতরে দূরে চলে যাব / তবু আমারে দেবনা ভুলিতে।
যে কবির কাব্যে আছে মৃত্যুঞ্জয়ী চির যৌবনের জয়ধ্বনি, অগ্নিবীণার সুর ঝংকার, যিনি ধীর স্থির অচঞ্চল বাংলা কাব্যে বয়ে এনেছিলেন দুর্বার কালবৈশাখীর ঝড়, যিনি বাংলা কাব্যের শান্ত সুন্দর পরিবেশে তৃষ্ণাদীর্ণ মর্ত্যমানবের ব্যথা অগ্নিদাহের মধ্যে ফুটিয়েছিলেন ফুলের হাসি, তিনিই আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

আমি কি চিনি নজরুলকে? উত্তরে বলতে হয় আজ অবধি নজরুল সম্পর্কে যতটা জেনেছি, যতটা চিনেছি তা যেন পরিপূর্ণ নয়। আরো কিছু জানার, আরো নতুন করে চেনার অভিপ্রায় জাগে। নজরুল শুধু একজন সাহিত্যিক, একজন বংশীবাদক, একজন শিল্পী, একজন সংগ্রামী, একজন বিদ্রোহী, একজন প্রেমিক এবং একজন স্নেহশীল পিতাই নন, তিনি একজন বাগ্মীও বটে। আজ আলোচনার প্রেক্ষাপটে আমি তাঁর বাগ্মী রূপটুকু এবং শেষ জীবনের কিছু করুণ দৃশ্যের কথা উপস্থাপন করছি।

নজরুলের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান : ‘সওগাত’ পত্রিকার সহযোগিতায় ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার এলবার্ট হলে এক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। বিখ্যাত লোকেরা সেদিন এসেছিলেন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। মানপত্র পাঠ করেন ওয়াজেদ আলী সাহেব। মানপত্র পাঠ শেষ হলে কবিকে সোনার দোয়াত, কলম ও রৌপ্য দিয়ে বাঁধানো মানপত্রটি উপহার দেয়া হয়। এসব উপহার পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে অভিমানী কবি সেদিন যে প্রতিভাষণ দেন তার সামান্য অংশ বিশেষ উল্লেখ করা হলঃ

‘বন্ধুগণ! আপনারা যে সওগাত আজ আমার হাতে তুলে দিলেন, আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনু মন প্রাণ আজ বীণার মত বেজে উঠেছে। তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়েছে, আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম।

এত বনফুল মাথা পেতে নেবার মত হয়ত আমার মাথায় চুলের অভাব নেই, কিন্তু এত হৃদয়ের এত প্রীতি গ্রহণ করি কি দিয়ে? আজ আমার ভাষা শুভ দৃষ্টির বধূর মত লাজ কুণ্ঠিতা এবং অবগুণ্ঠিতা। সে যদি নাচুনে মেয়ে হয় অন্ততঃ আজকের দিনে তাকে নাচতে বলবেন না।

আমি নেপথ্যের সেই বড় বন্ধুদের কথা বলছি যারা হয়ত একটু বেশি করেই আমার কথা স্মরণ করেছেন, ফুল ফোটানোর চেয়ে হুল ফোটাতেই যাঁদের বেশি আনন্দ।
বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কূলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব, আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি।

কেউ বলেন আমি কাফের, আমার বাণী যবন, আমি বলি, ও দুটোর কিছুই নয়। আমি হিন্দু মুসলমানকে এক জায়গায় এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি। গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি’।

নজরুলের জীবনের শেষ ভাষণঃ
১৯৪০ সালে নজরুল যুক্ত হন অল ইন্ডিয়া রেডিও কলকাতা শাখার সঙ্গীত বিভাগের সাথে। ১৯৪১ সালে ৫ ও ৬ এপ্রিল কলকাতা মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজত জুবলী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে নজরুলকে সভাপতি করা হয়। সেদিনের সেই সভাপতির ভাষণই ছিল নজরুলের জীবনের শেষ অভিভাষণ। ‘যদি আর বাঁশী না বাজে’ শিরোনামে অভিভাষণটি গ্রন্থিত করা হয়েছে। ভাষণের উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ নিম্নে তুলে ধরা হলঃ

‘আমি কবি বলে বলছিনে-আমি আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছিলাম, সেই অধিকারে বলছি-আমায় ক্ষমা করবেন-আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি-আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম-সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম’।

শেষের জীবনে নজরুল : দেশ মাতার পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে নজরুল আমৃত্যু ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু ভাগ্যের এত নির্মম পরিহাস যে তিনি উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে অচৈতন্য, অথর্ব হয়েছিলেন। নজরুলের তৃতীয় পুত্র কাজী সব্যসাচী ইসলাম বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। ১৯৫০ সালের ১ মার্চ কায়েদে আজম রিলিফ ফান্ডের কাছে আবেদনপত্র পাঠানো হয়।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, তারা কোনো অনুদানের ব্যবস্থাতো করেননি, উপরন্তু তারা নজরুলকে কাফের বলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখান। পত্র পত্রিকায় ছাপানো হয় তাঁর অসুস্থতার কথা, কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ। চিফ মিনিস্টারের সময় নেই। শিক্ষামন্ত্রী তমিজ উদ্দিন খান নীরব। ১৯৭২ সালের ২৪ মে ১১টা ৪০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে বাংলাদেশের মাটিতে আনলেন। ১৯৭৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তাকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়। তাকে জাতীয় কবির স্বীকৃতি দেয়া হয়। তখন কবি নির্বাক, নির্বোধ।

পিক্স ডিজিজে আক্রান্ত হবার পর ১৯৭৫ সালে কবি আক্রান্ত হন ব্রাঙ্কো নিউমোনিয়ায়। ২২ জুলাই তাঁকে ভর্তি করা হয় পি. জি. হাসপাতালে ১১৭ নং কক্ষে। ১৯৭৬ সালের ২৯ শে আগস্ট রবিবার সকাল ১০ টা ১০ মিনিটে কবি আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমান। কবি বেঁচেছিলেন ৭৭ বছর ৩ মাস। কিন্তু জীবন্মৃত ছিলেন ৩৪ বছর। তাঁকে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে দাফন করা হয়। তাঁর কবর আজ নজরুলের মাজার হিসেবে খ্যাত। কাজী নজরুল ইসলাম আজ শুধু একটি নাম নয়, শুধু একজন কবি নন, বরং এই নামটি আজ একটি দেশের সাহিত্যের অস্তিত্বকে ধারণ করে আছে।

দুঃখের মাঝে জন্মেছিলেন বলে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল দুখুমিয়া। সত্যিই দুঃখ যেন তাঁর জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। সুখ যেন তাঁর জীবনে ছিল আলেয়ার মত। যেটুকু সম্মান স্বীকৃতি তাঁর কাম্য ছিল তা পেলেন বটে তবে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই আজ একজন পাঠক হিসেবে নয়, একজন নাগরিক হিসেবে, একজন ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে বড়ই অপরাধী মনে হচ্ছে। কেন আমরা সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের মূল্যায়ন করতে পারিনা? কেন? এ প্রশ্ন আজ বিবেকবান সকল মানুষের।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মৃতিময় নজরুল
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে