নগরে শনাক্ত ৬০৩ ছিনতাইকারী

সক্রিয় ২২টি গ্রুপ, মাদকের টাকা জোগাড়ে জড়াচ্ছে উচ্চবিত্তের সন্তানরাও

ঋত্বিক নয়ন | বৃহস্পতিবার , ৮ জুন, ২০২৩ at ৫:৩০ পূর্বাহ্ণ

নগরীতে দাপিয়ে বেড়ানো অন্তত ২২টি গ্রুপের ৬০৩ জন ছিনতাইকারীকে শনাক্ত করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। টানা তিন মাসের অনুসন্ধান শেষে চূড়ান্ত করা হয়েছে এ তালিকা। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে তারা ছিনতাই করছে নগরজুড়ে। এমনকি মাদকের টাকা জোগাড় করতে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। পুলিশের অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ক্রমশ ছিনতাইয়ের শহরে পরিণত হওয়া চট্টগ্রামে ছিনতাইকারীদের লাগাম টানতে হালনাগাদ তথ্যের ভিত্তিতে তালিকাটি করা হয়েছে।

১৬ থানার ছিনতাইকারীদের মধ্যে কোতোয়ালী থানা এলাকায় ৫০ জন, সদরঘাটে ২২ জন, চকবাজার এলাকায় ২৯ জন, বাকলিয়াতে ৬৫ জন, পাঁচলাইশ থানা এলাকায় ২৯ জন, চান্দগাঁও থানা এলাকায় ৫৮ জন, খুলশীতে ৫৭ জন, বায়েজিদ বোস্তামি থানায় ৪২ জন, ডবলমুরিং এলাকায় ৬ জন, হালিশহর এলাকায় ১১ জন, পাহাড়তলীতে ৩০ জন, আকবরশাহ এলাকায় ৬৮ জন, বন্দর থানা এলাকায় ৭১ জন, ইপিজেড এলাকায় ৩৮ জন, পতেঙ্গা এলাকায় ১৬ জন এবং কর্ণফুলী এলাকায় ছিনতাইকারীর সংখ্যা ১১ জন। গত ৩ মাসে নগর গোয়েন্দা পুলিশের পাশাপাশি থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ১০০ জনের বেশি ছিনতাইকারীকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে এ ৬০৩ জনের পরিচয় নিশ্চিত করেছে অনুসন্ধানকারী দল।

পুলিশ জানায়, ছিনতাইকারীরা মূলত ভোরে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা দূরপাল্লার যাত্রীদের যেমন টার্গেট করছে, তেমনি তাদের শিকারে পরিণত হচ্ছে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে যাওয়া সাধারণ নগরবাসী।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (গোয়েন্দা) নিহাদ আদনান তাইয়ান বলেন, ছিনতাইচক্রগুলো নিরিবিলি স্থান ও যেখানে রাস্তার ডিভাইডার রয়েছে সেখানে সক্রিয় থাকে। তিনি বলেন, তালিকা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, সাধারণ ছিনতাইকারীদের পাশাপাশি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান এবং উচ্চশিক্ষিত তরুণরাও জড়িয়ে পড়ছে ছিনতাইয়ে। বিশেষ করে পরিবার থেকে মাদকের টাকা না পেয়ে ছিনতাইয়ে সম্পৃক্ত হয়েছে। এ ধরনের অন্তত ২০ তরুণকে শনাক্ত করা হয়েছে।

গোয়েন্দা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর অন্তত ২৫০ ছিনতাইকারী যেমন নতুন করে তালিকায় এসেছে, তেমনি ২০০’র বেশি পুরাতন ছিনতাইকারীর কোনো হদিস মিলছে না। সে সঙ্গে কারাগারে রয়েছে প্রায় ১৫০ ছিনতাইকারী। সর্বনিম্ন পাঁচটি থেকে সর্বোচ্চ নয়টি ছিনতাই মামলা রয়েছে তালিকাভুক্ত এসব ছিনতাইকারীর বিরুদ্ধে।

নিত্য নতুন কৌশলে এখন ছিনতাই চলছে। যেমন নগরীতে দুই ভাইয়ের সাত সদস্যের একটি ছিনতাই দলকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছে ডবলমুরিং থানা পুলিশ। নগরীর ডবলমুরিং, আকবরশাহ ও হালিশহর থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে ডবলমুরিং থানা পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, এ দুই ভাই হলো রানা ও বাবলু। দুজনের বাড়ি রাউজানের আধারমানিক গ্রামে। তবে থাকে নগরীর হালিশহরের আনন্দধারা আবাসিকের একটি ভাড়া বাসায়। এই দুই ভাই চাকরি বা ব্যবসা না করে নিজেরাই গড়ে তুলেছে একটি ছিনতাইকারী দল। ওই দলে সদস্য হিসেবে নেওয়া হয় ঢাকা, নোয়াখালী, লক্ষীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের লোকজন। রানাবাবলুর পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে চক্রের অন্য সদস্যরা বিভিন্ন জেলা থেকে চট্টগ্রাম নগরে একত্রিত হতো এবং কিছু নিম্নমানের আবাসিক হোটেলে অবস্থান করতো। এরপর তারা একত্রিত হয়ে সপ্তাহের রোববার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ব্যাংকিং সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের টার্গেট করে ছিনতাই কাজে জড়িত থাকতো তারা।

আবার আরেকটি টিম পাঁচলাইশে ধরা পড়ার পর দেখা গেছে, সপ্তাহে একদিন ভাড়া করা প্রাইভেটকার নিয়ে বের হয় দলটি। মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত চলে ছিনতাই ও ডাকাতি। টার্গেট প্রতি রাতে অন্তত ৪ থেকে ৫টি ছিনতাই। দিনের বেলায় থাকে বিশ্রামে। রাত হলেই চার যুবক মিলিত হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের গাড়ি পার্কিং স্থানে। রাতে বিভিন্ন স্থান ঘুরে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে করে ছিনতাই। একটি ছিনতাই করা প্রাইভেটকার দিয়েই নগরী এবং এর আশপাশে ঘুরে ঘুরে লুটপাট, চাঁদাবাজি, ছিনতাই করে বেড়ায়।

এছাড়া নগরীতে এ মুহূর্তে ‘টানা পার্টি’ হিসেবে পরিচিত ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি। এরা সাধারণত ভোরে এবং সন্ধ্যার পর সিএনজি টেঙি নিয়ে বের হয়। অফিসগামী এবং অফিসফেরত রিকশাযাত্রী ও পথচারীরাই তাদের টার্গেট থাকে। তারা চলন্ত টেঙি থেকে ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। অথবা নির্জন স্থানে পথচারীদের আটকে টাকামোবাইল কেড়ে নেয়।

সিএমপির জনসংযোগ বিভাগের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত উপ কমিশনার স্পিনা রাণী প্রামানিকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে নগরীর ১৬ থানায় ৪৮টি ছিনতাইয়ের মামলা রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে কোতোয়ালী থানায়।

কোতোয়ালী থানা এলাকার পূর্বের তালিকাভুক্ত তিনজন স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে। এদের মধ্যে আছে ১৬ মামলার আসামি ইদু মিয়া ওরফে হাতকাটা ইদু। ছিনতাই ছেড়ে মোবারক হোসেন বাবলু নামে একজন সবজি বিক্রি করেন। পোশাক কারখানায় যোগ দিয়েছেন সুজন নামে একজন। আটজনের কোনো হদিস মিলছে না।

সদরঘাট থানা এলাকায় তিনজন ছিনতাই ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে এসেছে। জাহাঙ্গীর নামে একজন ট্রাক চালায়। চকবাজারে তিনজন নিষ্ক্রিয়। এদের মধ্যে জাহাঙ্গীর নামে একজন সবজি বিক্রেতা এবং সাদ্দাম ভিক্ষা করে।

বাকলিয়ায় আটজন স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। এদের মধ্যে হোসেন ও দুলাল রিকশা চালায়, ফোরকান চটপটি বিক্রি করে, রাসেল ‘সোর্স’ হিসেবে কাজ করে, শহীদ আলম লেদু মাছ বিক্রি করে, মানিক টমটম চালক এবং জাবেদ কাপড়ের দোকানে চাকরি করে বলে তালিকায় উল্লেখ আছে।

চান্দগাঁওয়ে নিষ্ক্রিয় দু’জনের মধ্যে শাহাদাত হোসেন রিফাত বাইক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ছিনতাই ছেড়ে দিলেও এখনো গ্রুপের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। আরেকজন রুবেল ভাতের হোটেলের ব্যবসা করে। খুলশীতে নিষ্ক্রিয় আছেন সাতজন। আকবর শাহ থানা এলাকায় শাহীন ও নজরুল নামে দু’জন ছিনতাই ছেড়ে এখন মাদক বিক্রিতে জড়িত। সাগর নামে আরেকজন ছিনতাই ছেড়ে গাড়ি চালায়। বন্দর থানা এলাকায় কামাল নামে একজন ছিনতাই ছেড়ে এখন বন্দরে চাকরি করে। হাসান ও জুয়েল অটোরিকশা চালায়।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে সর্বশেষ নগরীতে ছিনতাইকারীদের একটি তালিকা তৈরি হয়েছিল। এরপর আট বছরে ডাকাতছিনতাইকারীসহ পেশাদার অপরাধীদের কোনো তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়নি সিএমপি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৬ মাসের জন্য কালুরঘাট ফেরির টোল আদায়ে আগ্রহী নয় কেউ
পরবর্তী নিবন্ধকলেজছাত্র দুই বন্ধুর সঙ্গে প্রাণ গেল হোটেল কর্মচারীরও