ধর্ষণ যখন মহামারী

সুবর্ণা দাশ মুনমুন | শনিবার , ১০ অক্টোবর, ২০২০ at ১১:১৮ পূর্বাহ্ণ

সকাল ১০ টা কি ১১ টা । প্রতিদিনের মতো চর চাকতাই সিটি কর্পোরেশন হাইস্কুলে নিয়মিত ক্লাস শুরু হয়েছে। আমি তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী। হঠাৎ করেই এলাকার কিছু উঠতি ছেলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের মহড়া শুরু করে দিল স্কুল এরিয়ার ভিতরেই। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তেই এদল আর ওদলে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছিল। তার মধ্যে ছিল আমাদের ক্লাসেরই একটা ছেলে। আমাদের একজন সহপাঠী পিস্তল হাতে নিয়ে ছুটছে, (আমার চোখে সে তখন হিরো)তাকে দেখার জন্যই মূলত আমরা কয়জন মেয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের শিক্ষিকা রাশেদা আপা বের হয়ে এসে বললেন, “এই ছেলেদের মধ্যে কেউ একজন যদি তোমাদের ওড়না ধরে টান মারে তাহলে কি তোমাদের ইজ্জতের আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে”? এই কথার সাথে সাথেই হুড়মুড়িয়ে ক্লাসে ঢুকে গেলাম আমরা।
এই হচ্ছে আমাদের সমাজব্যাবস্থা। আমার সমবয়সী ছেলেটি যখন অবৈধ অস্ত্র উঁচিয়ে তার বীরত্ব প্রদর্শন করছে,তখন একটা ওড়না ধরে টান দিলেও আমার ইজ্জত যায়। বাঙালি রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় এতই কম একজন নারীর ইজ্জতের মূল্য।
এই বছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল”নারীর ক্ষমতায়ন মানবতার উন্নয়ন”। নারীর ক্ষমতায়নে যখন মোট দেশজ উৎপাদন সহ সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এক ইতিবাচক প্রভাব পরতে শুরু করেছে,তখন মানবতার উন্নয়ন কথাটি সার্বিকভাবেই একটি বিব্রতকর প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখে যায়।
একজন নারীর প্রতি কতটা মানবিক হতে পেরেছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা? মূলধারার অর্থনীতিকে শ্রমে -ঘামে এগিয়ে নিতে মূল চালিকা শক্তির একটি বড় অংশই নারী হলেও বরাবরের মতোই উপেক্ষিত এবং অবহেলিত তাদের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টিও।
মার্চের শেষদিকে করোনা মহামারীর কারণে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়লেও নারীর প্রতি সহিংসতা কমেনি বরং একটি ঘটনার ভয়াবহতা নিষ্টুরভাবে অতিক্রম করেছে অন্যটিকে। পুলিশ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯ সালে যখন ধর্ষিতার সংখ্যা ১৪১৩ জন, তখন ২০২০ সালের প্রথম ১০ দিনেই ধর্ষিত হয়েছে ১২৮ জন নারী। যার অনুপাত ৩.৮ শতাংশ। প্রতিমাসে গড়ে ৮০-৯০ জন শিশু ধর্ষণের শিকার। প্রতি এক লাখ নারীর মধ্যে নিপীড়িত হচ্ছে ৪ জন কন্যা শিশু। গত ২৬ শে মার্চ একটি ৪ বছর বয়সী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে তার ৪৫ বছর বয়স্ক পিতার কাছেই।এপ্রিলে ত্রাণ নিতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয় একজন ১০ বছরের শিশু।
২৪ তারিখ রাতে খাগড়াছড়ির একটি চাকমা বাড়িতে ঘরের দরজা ভেঙে ৮/১০ জন বাঙালি পুরুষের একটি দল ধর্ষণ করে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়েটিকে। অসহায় পিতা মাতার কাঁধে ভর করে তার চিকিৎসা নিতে যাওয়ার ছবিটি ফেইসবুকে ভাইরাল। আমি মনে করি এই ছবি দিয়ে মেয়েটিকে আরো বেশি অপমানিত, অসম্মানিত করা হলো। ২০০৫-২০০৬ সালে বাবা এবং ভাইকে হারিয়ে যে মেয়েটি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন, আমাদের দেশের মতো গোঁড়া, রক্ষণশীল সমাজে তার আর ভবিষ্যৎ বলে কিছুই থাকবেনা। বরং ১০ বছর পরও এই ছবিটি দিয়েই তাকে মনে করিয়ে দেয়া হবে সে একজন সতীত্ব হারানো নারী।
পাহাড় কি সমতল প্রতিটি স্থানেই যেন লুকানো থাবা নিয়ে অপেক্ষারত হিংস্র শ্বাপদ। সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীর সাথে বেড়াতে গিয়ে ধর্ষিত হয়েছেন এক নববধূ। আরেকজন ধর্ষিত হয়েছেন হাসপাতালের বেডে পরে থাকা মুমূর্ষু স্বামীর জন্য রক্ত যোগাড় করতে গিয়ে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্কুলছাত্রী নিজ চাচাতো ভাইয়ের কাছে ধর্ষিত হওয়ার পর শালিশ নামক প্রহসনে আরেকবার অপমানিত হয়ে অবশেষে বেছে নিল আত্মহত্যার পথ। মীরপুর মডেল থানায়ও হিংস্র শ্বাপদের থাবায় আক্রান্ত নারী। সর্বশেষ বর্বরোচিত ঘটনা নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। আর কিইবা রইলো নারীর সম্মান?
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০২৩ সেকশন ৯ অনুযায়ী ধর্ষণ এবং হত্যা বা হত্যার চেষ্টার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং একলাখ টাকা জরিমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বোচ্চ ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিস্পত্তির কথা বলা হলেও, বছরে মাত্র ৩.৬১ শতাংশ মামলার নিস্পত্তি হয়েছে। এখনো আদালতে ঝুলন্ত অবস্থায় আছে দেড় লক্ষাধিক মামলা। যা এই অপরাধ বৃদ্ধির জন্য অপরাধীকে আরো উৎসাহিত করছে।
যতবারই ধর্ষণ শব্দটি লিখছি বিমর্ষ হচ্ছে মন। সমার্থক শব্দ লিখতে গিয়ে যা পেলাম তা আরও মর্মান্তিক (নষ্ট,সতীত্ব নাশ, বিবস্ত্র করিয়া লুণ্ঠন)। নারী কি কোন পণ্য, যে তার নষ্ট হওয়ার প্রশ্ন উঠে? ধর্ষণের একটি ঘটনা একজন নারীর শরীরে যতটা না ক্ষত সৃষ্টি করে তার চেয়ে অনেক বেশি বিপর্যস্ত করে দেয় লোক সমাজের কানাঘুষো। তাই ভিকটিমের পক্ষ থেকে এই ধরনের ঘটনাগুলো লুকিয়ে রাখার বা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয় সর্বান্তকরণে।
চারিত্রিক অবক্ষয়ের এই মহামারীতে অবোধ শিশু থেকে শুরু করে ভিখারি, প্রতিবন্ধী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী- শিক্ষক, গৃহবধূ, নারী পুলিশ, এমনকি ৮০ বছরের বৃদ্ধাও রেহাই পাচ্ছেনা। সামাজিক অবক্ষয়,মাদকের সুলভ প্রাপ্তি, আর্থিক অনটন,পর্ণো ছবির সহজলভ্যতা সর্বোপরি নারীর প্রতি সমাজের নেতিবাচক মনোভাব, এসব সমাজে আগেও ছিল কমবেশি। কিন্তু প্রত্যেকটি ঘটনার বিচারহীনতা আরও বেশি করে উজ্জীবিত করে তুলছে এই নিকৃষ্ট নরপশুগুলোকে। কেন প্রতিবাদী মানুষের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙছেনা? কেন কোন একজন বিচারকও কোন একটি ঘটনাকে মানবিক বিবেচনায় নিয়ে সুয়োমুটো জারি করেননা? ছয়মাসের একটি দুগ্ধপোষ্য শিশুকে দেখেও সুড়সুড়ি জাগে যেসব যৌন বিকলাঙ্গ পুরুষের মধ্যে তাদের যথাযথ আইনের আওতায় এনে প্রাপ্য শাস্তির ব্যাবস্থা করা হোক।
শুধুমাত্র কিছু সুন্দর শব্দ প্রয়োগ করে প্রতিবাদ জানানোর সময় কি এখনো আছে?

পূর্ববর্তী নিবন্ধহালিশহরে শ্রমিকদের সচেতনতামূলক ক্যাম্প ও প্রচারণা সভা
পরবর্তী নিবন্ধ‘ভাব পাগলা বাঙালি’ ও নজরুলের আক্ষেপ