কাজী নজরুল ইসলামের ‘ভাব ও কাজ’ প্রবন্ধটির সংক্ষেপিত সংকলন অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্য। তবে বিষয়বস্তু ও ভাষার দুর্বোধ্যতা দেখলে যে কোন প্রাপ্ত বয়স্ক পাঠকই এই রচনা অষ্টম শ্রেণীতে কেন- তা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। গদ্যের শিরোনাম বলে দেয়- এ কোন ছোটগল্প জাতীয় কিছু নয়। সাধু ভাষায় রচিত প্রবন্ধটি বেশ খটমটে। উপরন্তু এ রচনার মর্মার্থ উপলব্ধি করার জন্য গভীর চিন্তাশক্তির প্রয়োজন। চতুর্দশ বর্ষীয় শিক্ষার্থীদের কাছে এতোটা আশা করা যায় কিনা, বোধগম্য নয়। পাঠ্যপুস্তক পরিকল্পনাকারী পর্ষদ এমন জটিল একটা বিষয় অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যসুচিতে অন্তর্ভুক্ত করলেন দেখে বিস্মিত হয়েছি। বিস্মিত হয়েছি একারণেই যে, মূল বিষয়বস্তু ধরতে পারলেও, আমাকেই একাধিক বার গভীর মনযোগ সহকারে পাঠ করতে হয়েছে নজরুলের শব্দজটের পাঠোদ্ধার করতে। দোষটা নিশ্চয় নজরুলের নয়; অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছাত্রীদের কথা মাথায় রেখে হয়তো এ লেখায় হাত দেননি তিনি।
সবার আগে বলে নেওয়া প্রয়োজন, আমাদের নাগরিকদের বিশেষ করে দেশের কাজ করার অভিপ্রায় যাদের, তাদের সকলের জন্য অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত আলোচ্য প্রবন্ধটি। অন্তত শতবছর আগে রচিত এই নিবন্ধ আজও আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য বড় প্রাসঙ্গিক, অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক। এক কী দু’বাক্যে সারমর্ম লিখতে বললে বলা যায়- মুখে মুখে রাজা উজির না মেরে ‘কাজেই শক্তি কাজেই মুক্তি’- হওয়া উচিত আমাদের পরম আরাধ্য। তবে কাজটা হবে অবশ্যই পরিকল্পনামাফিক। সঠিক পরিকল্পনা ও নিষ্ঠার সাথে তার যথার্থ বাস্তবায়ন জাতীয় জীবনে মুক্তি এনে দিতে পারে। সেকারণেই বৈশ্বিক দুর্যোগের এই মুহূর্তে নজরুলের ‘ভাব ও কাজ’ নিবন্ধের পর্যালোচনা।
এমন সহজসরল সারসংক্ষেপ দেখে মনে হতে পারে, বোধহয় একটু বাড়িয়েই বলছি। তাহলে প্রবন্ধের গভীরে আলো ফেলা যাক। কাজী নজরুল ইসলাম ভাব বলতে সৌরভকে বুঝিয়েছেন, তবে তা কেবলই ফুলফলহীন সৌরভ। ভাব অর্থই আবেগ, বায়বীয় একটা ভাবনা। যতক্ষণ না তা কাজের মাধ্যমে ফুলে ফলে বিকশিত হয়, ততক্ষণ তাকে অর্থহীনই বলা চলে। তবে ‘ভাব’ তথা কর্ম পূর্ববর্তী চিন্তা নিতান্ত হেলাফেলার বিষয় নয়। এই প্রবন্ধের বিশেষত্ব এই যে এখানে ব্যক্তিগত কর্মপ্রক্রিয়া ও সাফল্য ব্যর্থতার আদ্যোপান্ত নয়, বরং জাতীয় জীবনে মুক্তির পথনির্দেশ করাই লেখকের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। মুক্তির পথ দেখাতে গিয়ে নজরুল স্বভাবজাত ঘা মেরেছেন প্রচলিত স্বার্থান্বেষী হঠকারী প্রবঞ্চকদের প্রতি।
জাতির দুর্দিনে জনতাকে পথ দেখানোর জন্য আবির্ভূত হন কত শত নেতা! সাধারণ মানুষের হৃদয়ের দুর্বলতম স্থানে আঘাত করে তাদের মাঝে আবেগ বা স্বপ্ন জাগিয়ে তোলেন তাঁরা। কারণ স্বপ্ন ছাড়া মুক্তি আসেনা, বিপ্লব সফল হতে পারেনা। বিপ্লবের কথা আসছে, কারণ পরাধীন ভারতবর্ষে জাতীয় মুক্তির যে স্বপ্ন নজরুল দেখিয়েছিলেন বিপ্লবই ছিল সে লক্ষ্য পূরণের একমাত্র পথ। কিন্তু যিনি ভাবের ঘরে নাড়া দেবেন, স্বপ্নের বীজ পুঁতবেন তিনি যদি সৎ, নিঃস্বার্থ ও নিবেদিতপ্রাণ না হন, তবে কিন্তু সব ভাব হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে। স্বপ্নের বেলুনে যতই ভাবনার বাতাস দাও, সময়মতো কাজ করিয়ে নেওয়া না গেলে চুপসে যাবে সেই বেলুন। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় রিক্ত শ্রান্ত জনতা মিইয়ে যাবে চুপসে যাওয়া সেই বেলুনের মতো, আর নিদ্রাচ্ছন্নের মতো ক্রমাগত তলিয়ে যেতে থাকবে অতল গহ্বরে। কুয়োর ব্যাঙের মতো সয়ে যাবে যাবতীয় অনাচার, দুঃশাসন।
নজরুল বেশ মজা করেই বলছেন- মনের গহীনে বিশেষ জায়গায় নাড়া খেলে মানুষ মেতে ওঠে এবং তাকে দিয়ে যেকোন কাজ করিয়ে নেওয়া যায় ‘আমাদের এই ভাব-পাগলা দেশে’। ভাব-পাগলা বলতে তিনি হয়তো হুজুগে বলতে চেয়েছেন। আজও কী আমরা হুজুগে বাঙালি নই? তবে কী বংশপরম্পরায় আমরা ভাব-পাগলা জাতি? নজরুলের কালে কয়েক হাজার ছাত্র কী একটা দাবিতে পথে নেমেছিল। সঠিক দিকনির্দেশনা না পেয়ে ভেস্তে যায় সেই বিদ্রোহ। ঐক্যে ফাটল এবং ত্যাগের ক্ষণস্থায়ী রূপ প্রমাণ করে সবই ছিল সাময়িক উত্তেজনা, হুজুগমাত্র। সেই সহস্র শিক্ষার্থী কিন্তু পরিণামে অকালকুষ্মাণ্ডদেরই দলে ভিড়ে গেল। দ্বিতীয় কোন প্রতিবাদ সভা সততার সঙ্গে আয়োজন করা তাদের কাজ নয় আর। একইভাবে সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে আসা যে বুদ্ধিজীবী সমপ্রদায় চোখমুখ বুজে পুনরায় কাজে যোগ দিয়ে নিজ নিজ আত্মার সঙ্গে হঠকারিতা করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, তাঁরাও কী জাতির ডাকে সাড়া দিতে পারবেন কোনকালে?
হুজুগে বাঙালির ভাবগতিক নিয়ে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ কেউই সন্তুষ্ট ছিলেননা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে মালেকা বেগমের ‘রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধটি থেকে ছোট্ট একটা উদ্ধৃতি তুলে ধরছি- “রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: ‘বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন।’ দুঃখ ভারাক্রান্তভাবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছেন: ‘তাঁর সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়াছেন। তিনি সুখী ছিলেন না।…প্রতিদিন দেখিয়াছেন আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না। যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না ও যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না।…এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক ও তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল” ( অন্য আলো, প্রথম আলো, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০)।
হুজুগ প্রসঙ্গে আমাদের জাতীয় ও সামাজিক জীবনে উৎসবের উন্মাদনার কথাও বলা যায়। উৎসাহের আতিশয্যে শোকদিবসকে অনায়াসে রূপান্তরিত করে ফেলি আমরা আনন্দোৎসবে। আমাদের প্রতিটি জাতীয় উৎসবে গৌরবের আনন্দের সঙ্গে মিশে থাকে বিষাদের গল্প। পোশাকি আয়োজনের সময় আমাদের বেশীর ভাগ মানুষই তা ভুলে গিয়ে উৎসবে উন্মাতাল হয়ে যায়। জননেতা থেকে শুরু করে অনেক বুদ্ধিজীবী, সমাজের মাথা- এই হুজুগে গা ভাসান। আমাদের এই ‘ভাব পাগলা দেশে’ নিজেকে দেশপ্রেমিক হিসেবে উপস্থাপন করে পায়ের তলার মাটি শক্ত করার এমন সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারাতে চাননা তাঁরা।
সমাজের সর্বত্র যেখানে কারচুপির জোয়ার, অপশক্তির নামে জয়ধ্বনি ওঠে, সেখানে মুখোশধারী দেশপ্রেমিক চেনার উপায় কী? উপরন্তু মুখোশধারীদের দৌরাত্ম্য ক্রমাগত বাড়ছে, কোণঠাসা হয়ে পড়ছে প্রকৃত সাধুজন। নেতার অভাব নেই আমাদের দেশে। কিন্তু ত্যাগী আছে ক’জন? সহজসরল জনতার সাধ্য কী আসল নকলের ফারাক খুঁজে বের করা, প্রকৃত ত্যাগী আর মুখোশধারীর পার্থক্যের চুলচেরা বিচার করা! মনের ভুলে কিংবা চিন্তার দৃঢ়তার অভাবে তারা হয়তো আসল ত্যাগী নেতাকে পরিত্যাগ করে মুখোশধারীর পক্ষাবলম্বন করে বসে। পরিণতিতে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে আসল নকল সবার ওপর থেকে। ‘দশচক্রে ভগবান ভুত’ কথাটাকে তাইতো মস্ত সত্যি কথা বলে ঘাট মেনেছেন স্বয়ং নজরুল।
মাত্র দুই পৃষ্ঠার এক নিবন্ধে এত এত ঘা মেরেছেন নজরুল সমাজের ঘুম ভাঙাতে! দেশের প্রাণশক্তি সেকালে যেমন একালেও তেমনি, তরুণ-যুবা। কেন ওরা ঝিমিয়ে আছে? নজরুল প্রশ্ন তোলেন। ওদের আত্মার শক্তি কত পবিত্র! কেন আমরা তাকে কাজে লাগাতে পারছিনা? জ্ঞানবুদ্ধি হবার আগেই কেমন করে অপরাধ জগতের বাসিন্দা হয়ে যায় আমাদের কিশোররা ? ওদের পুনর্বাসনের জন্য মহাসমারোহে তৈরি সংশোধন বা উন্নয়ন কেন্দ্র ওদেরকে আলোর পথে না ফিরিয়ে আরও কেন অন্ধকারে ঠেলে দেয়? এই প্রশ্ন ভীষণ প্রয়োজনীয় আমাদের জন্য, কারণ এই কিশোর যুবকরাই আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ।
অফুরাণ প্রাণশক্তিতে ভরপুর আমাদের যুবকদের বুকে সত্য দর্শনের বীজ বুনে দিতে হবে, ওদের মাঝে মানবতার সংক্রমণ ঘটাতে হবে। অতুল প্রসাদ সেনের ‘হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর, হও উন্নত শির নাহি ভয়’ হোক আমাদের মূলমন্ত্র। ‘ভাব ও কাজ’ প্রবন্ধে নজরুলের সতর্কবাণী দিয়েই আজকের আলোচনার সমাপ্তি টানা যাক। তরুণ যুবাদের উদ্দেশ্যে চির উন্নত শির নজরুলের উচ্চারণ- “আবার বলিতেছি, আর ভাবের ঘরে চুরি করিওনা। আগে ভালো করিয়া চোখ মেলিয়া দেখ। কার্যের সম্ভাবনা-অসম্ভাবনার কথা অগ্রে বিবেচনা করিয়া পরে কার্যে নামিলে তোমার উৎসাহ অনর্থক নষ্ট হইবেনা। মনে রাখিও তোমার ‘স্পিরিট’ বা আত্মার শক্তিকে অন্যের প্ররোচনায় নষ্ট করিতে তোমার কোন অধিকার নাই। তাহা পাপ-মহাপাপ”।