দ্রোহের কবি সমুদ্র গুপ্ত

এস ডি সুব্রত | শুক্রবার , ২৬ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৮:৪৬ পূর্বাহ্ণ

মানুষের কাছাকাছি বসি/ঘামের গন্ধের সাথে উষ্ণতাও পাবো/মানুষের কাছাকাছি বসি/হিংসা ও ঘৃণার সাথে ভালবাসা পাবো/মানুষের কাছাকাছি বসি/দুঃখময় স্মৃতির সাথে স্বপ্নও পাবো/এসো/এই অকাল শীতে/মানুষের কাছাকাছি বসি/ঘামের গন্ধের সাথে উষ্ণতাও পাবো।’ (সমুদ্র গুপ্ত)

দ্রোহের কবি সমুদ্র গুপ্ত ।

অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে চিরকাল লড়েছেন, সাহসী কলম চালিয়েছেন। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, লিখতেন। কবি সমুদ্র গুপ্তের জন্ম ১৯৪৬ সালের ২৩ জুন সিরাজগঞ্জে। মৃত্যু ১৯ জুলাই ২০০৮ সালে।

কবির জন্ম সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ থানার প্রত্যন্ত গ্রাম হাসিলে। পিতা মোহসিন আলী ও মাতা রেহানা আলীর সাত ছেলে ও একমাত্র মেয়ের মধ্যে পঞ্চম কবি সমুদ্র। ডাক নাম বাদশা। প্রাতিষ্ঠানিক নাম আব্দুল মান্নান। পিতার কর্মসূত্রে দেশের ষোলটি জেলার স্কুলে পর্যায়ক্রমে তাকে পড়তে হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক নাম এড়িয়ে সমুদ্র গুপ্ত ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সমুদ্র গুপ্ত ছদ্মনামে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কলাম লিখেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক নামকে ছাপিয়ে ছদ্মনামেই তিনি খ্যাতিমান হয়ে যান। কালের গর্ভে হারিয়ে যায় প্রাতিষ্ঠানিক নামটি। কর্মজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি ছিলেন প্রেসের কর্মচারী, করাতকলের ম্যানেজার, জুটমিলের বদলি শ্রমিক, উন্নয়ন সংগঠনের নির্বাহী, ওষুধ ও চিকিৎসা ব্যবসা, প্রুফ রিডার, সাংবাদিকতা, পেশাদার লেখক এবং সর্বোপরি কবি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়ে প্রমাণ করেছেন শুধু কলম হাতে নয়; অস্ত্র হাতেও যুদ্ধ করা অসামান্য সাহসী যোদ্ধা তিনি। জনতার মুক্তির জন্য কমিউনিস্ট সমুদ্র গুপ্ত বেছে নিয়েছিলেন গোপন রাজনীতির ভিন্ন পথ ও মত। দেশের সমস্ত প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে প্রতিবাদীর প্রথম কাতারে তিনি থেকেছেন সাহসী যোদ্ধারূপে। সমুদ্র গুপ্ত আপাদমস্তক কবি ছিলেন। সদাবিদ্রোহী অসাধারণ মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর বন্ধুভাগ্যও ছিলো ঈর্ষণীয়। আবার তাঁর জীবনাচরণে একজন সমুদ্র গুপ্তের নামের আড়ালের আবদুল মান্নান বাদশা কখনো প্রকাশিত হয়নি। মেয়েদের নাম রেখেছেন নীল সমুদ্র ও স্বপ্ন সমুদ্র। আচারসর্বস্ব ধর্মকর্মে তাঁর বিশ্বাস ছিল না। তাঁর বিশ্বাস ছিল সততায়, উদারতায়, মানবিকতায়। ‘সমুদ্রের মতো বিশাল ছিল তাঁর হৃদয়। আর্থিক দারিদ্র্যে কেটেছে তাঁর সংসার। কিন্তু মানসিক দৈন্য তাঁর ছিল না। গবেষক তপন বাগচীর ভাষায় তিনি ছিলেন ‘আধুনিক এক চারণ কবি’। আরো সুন্দর করে তিনি বলেছেন, ‘লোকটি কবি ছিলেন। কবি ছাড়াও লোকটি ভালো মানুষ ছিলেন। আর্থিক দারিদ্র্যে কেটেছে তাঁর সংসার। কিন্তু মানবিক দৈন্য তাঁর ছিল না। হৃদয় দিয়ে কবিতা লিখেছেন। কবিতাই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে।’ দৈনিক আওয়াজ’, ‘দৈনিক সংবাদে’র খেলাঘর পাতা, ‘দৈনিক আজাদে’র মাহফিল, অর্ধসাপ্তাহিক ‘পাকিস্তান’, ‘সাপ্তাহিক নতুন দিন’, ‘ডেইলি মেইল’, ‘সাপ্তাহিক গণশক্তি’, ‘ডেইলি পিপল্‌স’, ‘মাসিক কপোত’সহ বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধা কবি সমুদ্র গুপ্ত ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’, ‘সাপ্তাহিক জনমত’, ‘চরমপত্র’, ‘দৈনিক বাংলার মুখ’, ‘দৈনিক বঙ্গবার্তা’, ‘দৈনিক গণবাংলা’, ‘দৈনিক দেশ’, ‘ডেইলি নিউজ’, ‘সাপ্তাহিক রিপোর্টা’র, ‘পাক্ষিক স্টেডিয়াম’ পত্রিকায় গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। নীতির প্রশ্নে অবিচল থাকার পরিণতিতেই তাকে একের পর এক চাকরি বদল করতে হয়েছে। এজন্য নানা দুর্ভোগের শিকারও হয়েছেন। কিন্তু লক্ষ্যচ্যুত হননি কখনো নিজের অবিচল আস্থা থেকে। রোদ ঝলসানো মুখ, স্বপ্নমঙ্গল কাব্য, এখনো উত্থান আছে, চোখে চোখ রাখে, একাকী রৌদ্রের দিকে, শেকড়ের শোকে, ঘাসপাতার ছুরি, সাত সমুদ্র নদীও বাড়িতে ফেরে, ছড়িয়ে ছিনিয়ে সেই পথ, চলো এবার গাছে উঠি, হাতে হাতে তুলে নিলে এই বাংলার মাটি রক্তে ভিজে যায়, তাহলে উঠে দাঁড়াব না কেন, খালি হয়ে গেছে মাথা শুধু ওড়ে তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।

প্রবন্ধগ্রন্থ : ডিসেম্বরের রচনা। সম্পাদনা গ্রন্থ: বাংলাদেশে বঙ্কিম অন্যান্য।

কবিতার জন্য হুমায়ুন কবির পুরস্কার, যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, কবি বিষ্ণু দে পুরস্কার, ভারতের ত্রিপুরা সরকার প্রদত্ত ভাষা দিবসসহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

লড়াই করে বেঁচে থাকার কঠিন পথটি অবলম্বন করেই বেঁচেছিলেন। মার্ক্সবাদী মতবাদে বিশ্বাসী কবি সমুদ্র গুপ্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবর্তনে আজীবন লড়াই করেছেন। নীতিআদর্শ ত্যাগ করে গতানুগতিক প্রচারপ্রতিষ্ঠা পেতে চাননি বলেই লড়াকু কবি সমুদ্র সকলের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার মানুষ হতে পেরেছিলেন। সমুদ্র গুপ্ত আজীবন মাথা উঁচু করে চলেছেন। মানুষ সমুদ্র এবং কবি সমুদ্রের মধ্যে কোনোরূপ বৈপরিত্য পাওয়া যায়নি কখনো।

আর্থিক দারিদ্র্যের কাছে তিনি কখনো মাথা নত করেননি। কবিতাকে করে তুলেছেন তার জীবনের একমাত্র সাধনার বস্তু। এখানেই কবি একজন এবং অনন্য হয়ে পাঠককুলে মহাকায়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি এই বাংলার মাটিকে রক্তে ভেজা মাটির চোখে দেখেছেন। তিনি তার ‘এই বাংলার মাটি’ কবিতায় লিখেছেন– ‘আদর্শ বর্গ আয়তনে/ সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র পরিমাপের একখণ্ড মাটি নিয়ে হাতে তুলতেই সন্দেহ হলো/ লাল নাকি! মাটির মতো লোহাও লবণ! মাটি মাটিতে রাখলে মাটি/ হাতে তুলে নিলে এই বাংলার মাটি রক্তে ভিজে যায়।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাখিরা পাথর হয়ে গেছে
পরবর্তী নিবন্ধসিআইইউর স্প্রিং সেমিস্টারের ওরিয়েন্টেশন