এ শহরে আমরা ভালো নেই। দূর থেকে আসে চিঠি। জানা যায় তারাও ভালো নেই। তাহলে কে ভালো আছে? মধ্যখানে ইট ভালো আছে। এই ইট–পাথরের শহরে কে ভালো আছে, বলেন তো? আমি নির্বাক, উত্তর নেই চোখে। চায়ের কাপে উত্তপ্ত ধোঁয়ার কুণ্ডুলি আপনি এসে হেসে আবার পালিয়ে যায়, কাপে মুখ দিই না। আমাদের চা খাওয়া দেরি হতে থাকে।
আমরা দুজন শ্রাবণে, বর্ষার বরিষণে দুজনে ভালো থাকার অঙ্গীকার করেছিলাম কিন্তু আমরা ভালো নেই। তাহলে ভালো নেই যে এ–কথা কেমন করে বললাম? আবার বললামই বা কেনো? না বললে যে আমরা দায়ি হয়ে যেতাম, প্রকৃতির বিরুদ্ধে, সত্যের বিরুদ্ধে।
এই প্রকৃতিবিরুদ্ধ শহরে আমরা ইশ্বরের উপাসনায় মগ্ন হতে চাইলাম। মত্তহাতি এসে দাবড়ে দিলো আমাদের সবজির বাগান। আমরা আমাদের প্রাণের খেয়ায় পাড়ি দিতে চাইলাম, উপকূলে আছড়ে পড়লে ঢেউ। আমাদের জলরাশি অবিরত উচ্ছ্বাসে নেচে উঠলো মানুষের মুমূর্ষুযাপনে আর চিন্তার কয়লায়। তখন মনে পড়ে, আমি এবং তুমি, যে দুজন চা খাচ্ছি এখন আল–আমিনের দোকানে। সে জানে, তুমিও বিশ্বস্ত। এবং আমিও বিশ্বস্ত কিন্তু অচিরেই শয়তান আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে পারে। তুমি জিগ্যেস করলে, কী ব্যপার, চা তো জুড়িয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, তোমার রূপের উত্তাপে পুড়ে যাচ্ছে ফসলের মাঠ, হাতি শিকারিকে তো ঠান্ডা চা–ই পান করতে হয়।
‘তুমি কি আমাকে হাতি ভাবো?’ তুমি হেসে বললে।
আমি বললাম, তোমাকে যে আমি শিকার করতে চাই এ–আবার কে বললো।
তুমি মৃদু হেসে চোখ টিপলে। আমি দেখলাম না।
তখন সন্ধ্যা নেমে ছুঁইছুঁই অন্ধকার। আমরা দু’জন দাঁড়িয়ে আছি আল–আমিনের দোকানে। আর আমাদের সামনে দিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি, রিকশা, হর্ণ বাজিয়ে মোটর সাইকেল। আমরা দু’জন চায়ের কাপে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি এবং চোখ থেকে লাবণ্য খুলে ফেলে চোখের চশমায় লিখে রেখেছি নিজেদের চন্দ্রাভাস। তখন অস্থির কল্পনায়, নিজেদের জলপিয়াসী বাসনায় কোথায় যে হারিয়েছি মনে নেই।
তুমি ছুটছিলে একটি অরণ্যের মুখোমুখি আর আমি পাথর থেকে আরও পাথরে, পাথারে আর নীলের বুকে অবিরাম ছিলাম। পাতাঝরা দীর্ঘশ্বাস আমাকে ক্লান্ত করেছিলো। তোমার বনের সৌন্দর্যের ভেতর দেখলাম অবগাহন, পূর্ণিমার আর ভরা ভাদ্রের। তুমি আমার জলজোছনার সন্ধ্যা হয়ে পুরানা পল্টনে, আল আমিনের চায়ের দোকানে আমাকে থমকে দিয়েছিলে, বলেছিলে, ভালো আছো তো?
এ প্রশ্নের জবাব আমি কীভাবে দেবো জানি না। তবে আপেক্ষিক বিস্ফোরণে, নিজ যানে, আমরা যখন সম্বিতে ফিরে আসলাম তখন তুমি কোনো কথা বললে না। কথা বললে না কোনো। নির্বাক উত্তরময় চোখে তাকালে আমার চোখে। আমার চোখ থেকে ভাষা সরলো না। চায়ের পেয়ালা শেষ হলো। আমরা দ’জন ফিরলাম, কিন্তু কোথায় ফিরবো?
তুমি বললে, চলো, অফিসেই যাই। আমি বললাম, না, মন বসছে না। চলো টিএসসিতে যাই।
মাঠে? তুমি খুশি হয়ে বললে।
আমি তোমাকে আশ্বস্ত করলাম চোখ টিপে। দ’জনে একটি রিক্সায় উঠে মাঝখানে ছ’ইঞ্চি ফাঁক রেখে বাতাসের গতি কেটে ছুটে চলতে লাগলাম শাহবাগ পানে। তুমি গানে গানে একটি সুর ভাজতে চেষ্টা করলে। সে সুরে আমরা হারিয়ে গেলাম দু’জনেই উপত্যকায়। যার কাছাকাছি সরোবরে ধবল রাজহাঁস, যার কাছাকাছি স্বপ্ন–নীল। আর যার স্বপ্নের মতো বেদনা অতি আস্তে, নিজেকে পুড়িয়ে ফেলে, ছুঁড়ে দেয় অন্ধকারে, তেমনি রাত নামলো যেনো কোনো অতিসন্ধ্যায় আর আমরা ছুটছি রিকশায় নয়, যেনো একে অন্যকে না ছোঁয়ার খেলায় কোনো। কোথাও একটা জ্যাম লেগেছে। আমরা দ’জনেই চাইছি জ্যামটা দীর্ঘ হোক। জ্যামটা দীর্ঘ হলো। আরেকটু দীর্ঘ হলে হয়তো তুমি দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলতে, ফলে জ্যামটা ছুটে যায়। আমরা দ’জন উপত্যকা থেকে শাহবাগে গিয়ে নামি।
একখণ্ড সবুজের ভেতর আমাদের মনটা ভালো হয়ে ওঠে। বাদামওয়ালা এসে বাদাম দিয়ে যায়। লালনের চত্ত্বর থেকে গানের সুর ভেসে আসে। আমরা ছবির হাট থেকে অদূরে ওয়াকওয়ের পাশে একটি গাছের শেকড়ে বসে থাকি। বাদামে লবণ লাগাতে লাগাতে তুমি বলো– আর যদি ঘরে ফিরে না যাওয়া লাগতো! আমি বললাম, ঘরই মানুষকে ফিরিয়ে নেয়। তুমি বললে, মানুষই একটি ঘর। আমি বললাম, ঠিকই বলেছো। তাহলে অরণ্য কোথায়? আমাদের ভেতরে–তুমি বললে। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। আশ্চর্য, বিপরীত দিকেও তুমি বসে আছো!
আমি ভাবলাম, এ–অরণ্য থেকে আসলেও মুক্তি নেই। তুমি সত্যিই অরণ্য–আমি বললাম। আর তুমি–তুমি প্রশ্ন করলে। আমি বললাম–আমি পাথর। তুমি বিশ্বাস করলে। চাইলে, আমার দিকে। বললে, পাললিক ভেঙেই কিন্তু উর্বরা; তুমি কি ভুলে গেলে? আমি বললাম, না আমি ভুলিনি। এবং সত্যিই ভুলিনি যে আমার মধ্যে মহাবন আমাজন আছে। আমিও তো ঘুড়ি উড়িয়েছি। দশদিক, আর দশপাশে বিস্তৃত করেছি নিজের ডানা। তুমি বললে, সবারই একটা সোনালি শৈশব থাকে।
আমরা কি ফিরে যেতে পারি না সেই শৈশবে? এ প্রশ্নের উত্তরে আমি বললাম– না, পারি না। তুমি বললে তাহলে হিমহিম রাতে, যখন কুয়াশারা ছুটে বেরাচ্ছে এই শাহবাগ উদ্যানে, তখন এমন ঘুমঘোরে ঝিল্লিরব কেনো জেগে থাকে? আমি বলি– তা রাতের ভাষা। আসলে আমাদের কানকে অবকাশ দাও, দেখবে শৈশব আর বর্তমান আসলে একই সুতোয় গাঁথা। তুমি বললে– তাহলে ফাগুন, যা এসেছিলো আমাদের জীবনে, তখন তুমি এমন স্থির থাকলে কেনো? আসন্ন শীতে যেনো কষ্ট না পাই– আমি বললাম। তাহলে মুখ তুলে, তাকাও এদিকে, দেখো, আমি তোমার প্রতীক্ষায়ই আছি। তোমারই অপেক্ষায় রাতজাগি–আমার সারাটা রাত। চোখের পাতায় এক হয় না ঘুম। না হয় চোখের পাতা ভারি, তোমার এ নেহারি–আঁখি আমি গেঁথে রাখি আঁখির কাজলে। আমি বললাম, আমি ধন্য। তাহলে আর কাব্যিকতার দরকার কী? এবার উঠে পড়ি, চলো।
ধুর, তোমার সাথে আমার একদম ভালো লাগে না। তুমি বিরক্ত হয়ে বললে। আমি বললাম, আরে না, সাড়ে এগারোটা বাজে। এখন না উঠলে বাসায় দেরি হয়ে যাবে। হোক–তুমি বললে। লোকে কী ভাববে–আমি বললাম। লোকের কথায় আমি চলি নাকি–তুমি বললে। আমি বললাম, আসলে তুমি একটি নদী। বনহারা পাখিরা যেমন নিজের ঠিকানায় যায় দিগ্বিদিক, তুমিও তেমনি পাড় ভাঙতে থাকো। মোহনার খোঁজে আমরা দু’জন মিলিত হলে দোষ কী–তুমি প্রশ্ন করলে। তা হয় না–আমি সরাসরি বললাম। এজন্যই তোমাকে ভালোবাসি–তুমি বললে।
ফিরতি রিক্সায় আমরা দু’জন পথ ভুলে গেলাম। ড্রাইভারকে বলতে গেলাম, ডানে। ড্রাইভার বললো জানি, আসলে আপনাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নাই, তাই আমি আপনাদেরকে ঠিক জায়গায় নিয়া যাইতাছি। আমি বললাম–আচ্ছা, তাই নাও।
রাত ঝরে এলে আমরা দু’জন রাস্তা চিনলাম। গোলাপরাত আবাসিকের স্মৃতিগুলোকে মুছে ফেলতে চাইলাম দ্রুত। বাতাস কেটে এগিয়ে যাচ্ছে রিকশা। শীত পড়েছে বাতাসে। তুমি কপালের পাশে একফালি এলোচুল ঠিক করতে করতে বললে, কী একটা বিশ্রী ব্যাপার হয়ে গেলো, বলো তো? আমি চুপ করে থাকলাম। তোমার বুকের ভেতর থেকে গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যেতে শুনলাম। যেনো শ্বাস নয়, হাজার হাজার পাথরের পাখি।