‘দ্য পার্ল’ পাঠ অনুভূতি

মোহছেনা ঝর্ণা | সোমবার , ২৬ অক্টোবর, ২০২০ at ৬:৪০ পূর্বাহ্ণ

অনেকদিন পর বই উপহার পেলাম। নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী মার্কিন ঔপন্যাসিক জন স্টাইনবেক এর বিখ্যাত উপন্যাস “দ্য পার্ল”। অনুবাদ -খন্দকার মজহারুল করিম। অনুবাদ সাহিত্য পড়তে গেলে অনুবাদটা নিয়ে মুশকিলে পড়ি কখনো কখনো। অনুবাদের ভাষাটা প্রাঞ্জল না হলে পড়ে আরাম পাই না। সে হিসেবে খন্দকার মজহারুল করিমের অনুবাদ প্রাঞ্জল বলা যায়। পড়তে ভালো লেগেছে।
উপন্যাসটাও দারুণ। আজ যা কিছু অতি মূল্যবান মনে হচ্ছে সময়ের আবর্তনে একদিন তা ই নিছক ক্ষুদ্র অতি সামান্য কিছুতে পরিণত হয়ে যায়, এই উপন্যাস যেন সেই বার্তাটাই দেয় আমাদেরকে।
“দ্য পার্ল” উপন্যাসের প্রধান চরিত্র দরিদ্র কিনো সাগর সেচে মুক্তা এনে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। তার স্ত্রী জুয়ানা। স্বামীর সাথে বেশ ভালো বোঝাপড়া তার। উপন্যাসের বিস্তার একটি মহামূল্যবান মুক্তাকে ঘিরে। যেই মুক্তাটি কিনো এবং জুয়ানা দম্পতির সহজ সরল জীবনকে ক্রমশ ভয়ংকর জটিলতার দিকে ধাবিত করে।
ঘটনার সূত্রপাত একটা বিছাকে কেন্দ্র করে। যে বিছাটি কিনো এবং জুয়ানা দম্পতির ছেলে কোয়েটিটোর গায়ে হুল ফুঁটিয়ে বিপর্যয়ের সূত্রপাত ঘটায়। বিছার কামড়ে পুত্র কোয়েটিটোকে নিয়ে অস্থির হয়ে যায় কিনো- জুয়ানা। চিকিৎসার জন্য পাগল পাগল হয়ে ছুটে যায় ডাক্তারের কাছে। হাতে টাকা পয়সা এত সামান্য যা দিয়ে চিকিৎসা সেবা কিনতে পারে না তারা। পুত্রের কষ্ট, দুর্ভোগ লাঘবের জন্য এত নুয়ে যায়, নিজেদের দারিদ্র্যের জন্য সাহস করে ঠিকমতো আরজিটুকু পেশ করতে পারে না, গরীবের কোনো রকমের কোনো প্রয়োজন থাকতে নেই যেন! চিকিৎসকের সেবা তো দূরের কথা, চিকিৎসকের সম্মুখেও যাওয়ার ভাগ্য হয় না কিনো- জুয়ানার।
ডাক্তাররা যে শুধু আমাদের দেশেই অর্থের কাঙাল, এই উপন্যাস পড়ে সে ধারণাটা ভেঙে যায়। যুগে যুগে সব মহাদেশের চিত্রই হয়তো কম বেশি একই রকম। তা না হলে শুধু মাত্র অথের্র অভাবে দরিদ্র কিনোর ছেলের জন্য কেন চিকিৎসাটা মিললো না?
অথচ যেই না কিনো মহামূল্যবান মুক্তা পেলো এবং মুখে মুখে সর্বত্র রটে গেলো কিনোর পৃথিবীর মহামূল্যবান মুক্তার খবর তখন অন্য অনেকের মতো ডাক্তারের চরিত্রও কেমন বদলে গেলো। মহামূল্যবান মুক্তার খবরে ডাক্তারের চোখও লোভাতুর হয়ে উঠলো। কোয়েটিটোর অবস্থা ভালো থাকা সত্ত্বেও টাকা খসানোর জন্য ডাক্তার ভয় দেখাচ্ছিল কিনো এবং জুয়ানাকে। দুর্ভাগ্য, সব মানুষের কাছেই নিজ সন্তানের চেয়ে বড় দুর্বলতা আর কিছু নেই, পৃথিবীর সব নচ্ছাররাই সে কথাটা জানে।
মহামূল্যবান সেই মুক্তা অতি সাধারণ, দরিদ্র কিনো- জুয়ানা দম্পতির জীবনটাকে ক্ষণিকেই নরক বানিয়ে ফেলে। মুক্তা ব্যবসায়ীরা সব জোট হয়ে যায় কিনোকে ঠকানোর জন্য। মিথ্যাচার করে। অথচ কিনোর পাওয়া পৃথিবীর সেরা মুক্তা চুরি করার জন্য কত রকম ফন্দি আঁটে। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে হয় বেচারা কিনোকে।
শেষ পর্যন্ত হেরেই গেলো কিনো- জুয়ানা দম্পতি। পৃথিবীর মহামূল্যবান মুক্তাটি তাদের কাছে তাদের সাদামাটা জীবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হিসেবে ধরা দিলো। যেই সন্তানকে বাঁচানোর জন্য এই মুক্তা আহরণ, সেই সন্তানকেই নির্মমভাবে হারাতে হয় তাদের। আর তাই পৃথিবীর সবচেয়ে দামী মুক্তাটি মুহূর্তেই পরিণত হয় অতি সাধারণ এক ঢিলে। যেই ঢিল পানিতে ছূঁড়ে দিয়ে পাপমুক্তির পথ খোঁজে কিনো এবং জুয়ানা।
জীবনে কোনো কিছুই যেন চূড়ান্ত নয়! কোনো কিছুই স্থির নয়। সব আপাত। সব আপেক্ষিক। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি যেন জীবনে লুকিয়ে থাকা এই গূঢ় রহস্য উন্মোচন করে জীবন বোধকে ঝাঁকিয়ে দেয় সুনিপুণ ভাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রতারণা যখন শিল্প
পরবর্তী নিবন্ধরাউজানে পূজা মণ্ডপ পরিদর্শনে অতিরিক্ত ডিআইজি