দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৩১ জুলাই, ২০২২ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

এক টাকায় কেনা নয় ঘোড়া

নাহ ‘কেবা আখি মেলেরে’ ভাব ধরে আর সোফায় শুয়ে থাকা গেল না। চোখ তো খুলতেই হল, সাথে সোফা থেকে নেমে দৌড়াতেও হল, রুমের দরজার দিকে! কারণ দরজা খোলার সাথে সাথে ঐ ফ্রন্টে শুরু হয়ে গেছে দুই ভাইয়ের মধ্যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ।
দ্রুত গিয়ে ঝাপটাঝাপটি করে থাকা দু’জনকে দু দিকে সরিয়ে দিতেই, দীপ্র তীব্র স্বরে জানাল অভ্র কী রকম বেয়াদব হয়ে উঠেছে ইদানীং! এতোবার বেল বাজানোর পরও এতোক্ষণ ধরে সে বড় ভাইকে বাইরে এভাবে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল ইচ্ছে করে। এরকম বেয়াদবি কি সহ্য করা যায় মোটেও? এদিকে বড় ভাইয়ের গলার সাথে পাল্লা দিয়ে গলা চড়িয়ে অভ্র বলছে, ইদানীং ভাইয়া কী অসহ্য রকমের স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছে। ঐ রুমে গেলে টিভির রিমোট তো ধরতেই দেয় না ওকে, তদুপরি সারাক্ষণই তাকে এটা ওটা ফা ফরমাশ দিয়ে কাজ করায়! এখন এ রুমেও এসে করছে স্বৈরাচারী আচরণ। সাথে সে এও জানিয়ে দিল, কিছুতেই এখন রিমোট সে হাতছাড়া করছে না। কারণ বহু কষ্টে সে একটা দেখার যোগ্য কার্টুন খুঁজে পেয়েছে টিভি চ্যানেলে, বলেই দ্রুত দৌড়ে চলে গেল সে বিছানায়।
‘যাও, যাও আমি এখন আর তোমার ঐ ফালতু কার্টুন দেখব না। বাবাকে নিয়ে বাইরে যাব। অনেক কষ্ট করে ভি পি এন দিয়ে গুগুল ম্যাপে ঢুকতে পেরেছি একটু আগে। এখানকার আশেপাশেই মনে হচ্ছে একটা অ্যাপেল স্টোর আছে। তখন আবার আমাদের সাথে যেতে চেও না’ রুমের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আমার হাত ছোটার চেষ্টা করতে করতে উচ্চ কণ্ঠে জানাল দীপ্র, যা নিয়ে মোটেও গা না করে গভীর মনোযোগে অভ্র টিভি দেখতে থাকল। এতে দীপ্রর রাগ বেড়ে গিয়ে, ফের এক জোর ঝটকায় ছুটতে চাইলো আমার হাত থেকে, কিন্তু সে সুযোগ তাকে না দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে নিয়ে এসে সোফায় বসতেই, আব্দার করলো যে, যেতে চায় সে বাইরে এক্ষুণি, সেই অ্যাপেল স্টোরটা খুঁজতে।
শোন আমি এখনো গোসল করিনি। যেতে চাচ্ছ বাইরে, তা যাব। কিন্তু আমি আগে গোসল করে নেই। ভাল কথা তুমি কি গোসল করেছ? যদি না করে থাকো, তবে করে নাও। দেখছ না অভ্র কী রকম গোসল টোসল করে ফ্রেশ আর ফিটফাট হয়ে আছে। এখন মা গোসল করে বেরিয়ে যদি শোনেন যে তোমার গোসল হয়নি, তবে খুব রেগে যাবে কিন্তু!
‘আমি কী করবো? এন তো সেই তখন থেকে ঢুকে আছে ওই রুমের বাথরুমে’। খোঁড়া যুক্তিতে নিজের গোসল না করার দায় চাপাতে চাইল দীপ্র ফুপ্পির উপর।
গোসলখানায় একবার ঢুকলে ও নিজেই যে বেরুতে চায় না সহজে তা তো ঘরে সর্বজনবিদিত। সেজন্যই হেলেন দখল নিয়েছে বাথরুমে, এ তো বুঝতেই পারছি। তবে এতে সুবিধাই হল আমার। কারণ এই মুহূর্তেই বাইরে পুত্রের বেরুনোর দাবী তো এড়ানো গেলই, সাথে বোনাস পাওয়া গেল আগামী তিরিশ চল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা সময়। কারণ এখন গিয়ে ও গোসল করতে ঢুকলে, ঐ রকমই সময় নেবে ও। এ ফাঁকে নিজের রেস্ট নেওয়া এবং গোসল করা দুটোই হয়ে যাবে। তাই বললাম শোন বাবা, অ্যাপেল স্টোর এখানে থাকুক আর যেখানেই থাকুক, ওটা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। আর আছি আমরা আরও দু দিন। দূরেও কোথাও যদি থাকে সে স্টোর তাতেই সমস্যা নেই, ওটা খুঁজে বের করে নিয়ে যাবই তোমাদের সেখানে। আগে তুমি গিয়ে গোসল করে আসো।
‘ঠিক আছে আমি গোসল করতে যাচ্ছি। আর বাবা, আমি কিন্তু আজ এই হোটেলে ডিনার করবো না। একটু আগে গাড়িতে আসার সময়, রাস্তার ঐ পাশে একটা চায়নিজ নুডুলসের রেস্টুরেন্ট দেখেছি। ওখানে ডিনার করবো’ সোফা ছেড়ে রুমের দরজার দিকে এগুতে এগুতে এ কথা বলতে বলতে, বিছানায় নিবিষ্ট মনে টিভি দেখতে থাকা ছোট ভাইকে একটা ভেংচি কাটলেও, অভ্র সেটিকে মোটেও পাত্তা না দেয়ায়, রুমে আর কোনো জরুরি অবস্থার অবতারণা না হওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। অতএব ফের যাকে বলে মটকা মেরে পড়ে থাকা, ঐরকম মটকা মেরে পড়ে থাকার জন্য চোখ বন্ধ করে কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম সোফায়। কিন্তু কতক্ষণ ওরকম মটকা মেরে পড়ে থাকতে পারলাম, জানি না’।
“কী ব্যাপার? সেই তখন থেকেই এখানে ঘুমাচ্ছ নাকি? গোসল করবে না? যাও যাও, উঠো’। রুমে সমন কানে যেতেই ধড়মড় করে উঠে বসে মনের মাধুরি মিশিয়ে আও আও কাও কাও শব্দ তুলে ক্লান্তি মেশান ঘুমটি না ঝিম ঝিমানি ভাবটি তাড়াতে তাড়াতে ভাবছি, আসলে হলোটা কী? এর চেয়ে ঢের বেশী ঘোরাঘুরিতেও এরকম ক্লান্তি আসে না তো আমার, বিশেষত দেশের বাইরে যখন ঘুরতে যাই। যা কিছু ঘোরাঘুরি করেছি আজ, তা তো হলো ঐ শুধু তিয়েন আন মেন স্কয়ারের গ্রেট হল আর যাদুঘরে। এছাড়া পথ হারিয়ে ঐ নিষিদ্ধ নগরী এলাকায়ও কিছু অনিশ্চিত ঘোরাঘুরিও করতে হয়েছিল, কিন্তু তাতেই এমন ক্লান্ত লাগছে কেন? বয়স হয়ে গেল নাকি? মনে তো হয় না কখনো তা আমার যে বয়স বেড়েছে একটুও। প্রায়শই মনে হয় যা, তা হল এই তো মাত্র সেদিন ছেড়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ে। মনে আমি যাই করি, শরীর তো মনে হচ্ছে দিচ্ছে না সায়। বড়ই মন খারাপ হয়ে গেল নিজ মনে এই সত্যের মুখোমুখি হতে। কবি তো আসলে ঠিকই বলেছেন যে ‘সত্যের মতো বদমাশ’ আর হয় না!
কপাল ভাল এ ভাবনার পিঠেই মনে হল, আজ যতোক্ষণ বাইরে ছিলাম হাড় জমানো হিমে এরকম তো থাকিনি কোথাও আগে। এরকম অকল্পনীয় হিমের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে নিজের অজান্তেই তো শরীরকে প্রচুর শক্তি ক্ষয় করতে হয়েছে বাড়তি তাপ উৎপাদন করে, এই বঙ্গ সন্তানটির ধড়ে প্রাণটি ধরে রাখার জন্য, যাতে তিয়েন আন মেন প্রান্তরে সে যেন বেঘোরে পটল না তুলে। এই বেইজিং আর তার তিয়েন আন মেন চত্বর যতোই বিশ্বখ্যাত হউক না কেন, ঐ খানে এভাবে বেঘোরে প্রান হারালে, দেশের মান ইজ্জত থাকতো নাকি!
যাক নিজ মনে ব্যাপারটার এই রকম একটা একটা চমৎকার জৈব রাসায়নিক ব্যাখ্যা দিতে পারায়, বেশ সন্তুষ্ট হয়ে, হৃষ্টচিত্তে এগুলাম হাম্মামখানার দিকে।
হাম্মামখানার মতো ঐ একান্ত নিজস্ব ঘরে ঢুকে, দ্রুতই জামা কাপাড় ছেড়ে, শাওয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে নব ঘুরিয়ে নিজের পছন্দ মতো উত্তাপের পানি পেতেই, দাঁড়িয়ে গেলাম নিচে। তাতে বৃষ্টির মতো ঝির ঝির আওয়াজ তুলে কুসুম গরম পানি গায়ে পড়তেই, এতক্ষণের ঘুম ঘুম ঝিমানো ভাবটা কেটে গিয়ে বেশ চাঙা হয়ে উঠতেই, একটু আগের ঐ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার সূত্র ধরে ফের মনে হল, আচ্ছা এই শহরের আদি বাসিন্দা পিকিংমানবদের সময়ে, মানে সাত আট লক্ষ বছর আগেও কি এমনই হিম ছিল নাকি এখানে? এই আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে এসে আমরা তো প্রতিনিয়তই নানান রকম চতুর্মুখী চাপে এ গ্রহের পরিবেশের আর জলবায়ুর প্রাণ ওষ্ঠাগত করে রেখেছি। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কথা বলছে বিশ্বের তাবৎ রাজনীতিবিদেরাও যেমন, বলছে তেমনি চায়ের কাপে ঝড় তুলে আড্ডা মারা বাংলার গ্রামের হাটুরেরাও। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের আর পরিবেশ দূষণের ব্যাপারটা তো সবাই দেখতেই পাচ্ছে নিজ চোখে। আজ যেমন সারাদিন এমন হিমে বেইজিং আমরা যে ফ্রেশ কুয়াশাতো দেখিনি তা বোঝার জন্য তো পরিবেশবিদ হওয়া লাগে না। নিজ চোখে যা দেখেছি সবাই, তা তো ছিল ধোঁয়াশা। কিন্তু কথা হচ্ছে এখন না হয় আমরা নানানভাবে বারোটা বাজাচ্ছি পরিবেশের, কিন্তু এই গ্রহের জলবায়ু তো এমনিতেও বারবার পরিবর্তিত হয়েছিল। সে হিসাবে এমনও তো হতে পারে যে পিকিং মানবের আমলে হয়তো এতো ঠাণ্ডা পড়তো না এখানে পড়ছে যা এখন। কিন্তু আসলেই কি ওরকম ছিল নাকি ঘটনা, তা নিয়ে তো নিশ্চিত কোনো খবর জানা নেই আমার।
আচ্ছা থাক ঐ সব মাথা গুলিয়ে যাবার মতো চিন্তা আর না করি। তার চেয়ে বরং, কাল যখন যাবো গ্রেট ওয়াল দেখতে, তখন একটু টোকা দিয়ে দেখতে হবে লি খাঁকে যে সে চিনে কিনা পিকিংমানবের বসবাসের জায়গটা। আর যদি হয় সেটা ঐদিকে মানে মহাপ্রাচীর দেখতে যাচ্ছি যেদিকে, সেইদিকে, তবে একটা ঢুও মারা যেতে পারে ঐখানে ফাঁকতালে। আমাদের দেশের এমনকি বিশ্বের নানান দেশের যতো পর্যটক আসে বেইজিং এ তাদের সবাই নিশ্চিত মহাপ্রাচীরে যায়, তার মধ্যে কয়জন করে খোঁজ পিকিং মানবের ? সেদিক থেকে এটা তো হবে একটা ব্যতিক্রমী ব্যাপার। সমস্যা হচ্ছে লি খাঁকে ব্যাপারটা বোঝাই কিভাবে? সে কি আদৌ জানে পিকিং মানবের কথা?
ভাবতে ভাবতে শাওয়ার বন্ধ করে, আরামদায়ক গরম পানির বৃষ্টি থামিয়ে দিয়ে, গা মুছে, জামা কাপড় বদলে, মাথা মুছতে মুছতে হাম্মামখানা থেকে বেরুতেই হুকুম জারী হলো, চা বানানোর জন্য রুমের হট ফ্লাক্সে পানি চড়িয়ে দেবার।
তথাস্তু বলে, গত রাতে সস্তা পেয়ে কেনা ভোমা সাইজের পানির বোতলগুলো যেগুলো বয়ে আনতে হয়েছিল আমার হেস্তনেস্ত অবস্থা, যে গুলোকে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম কেবিনেটে, সেখান থেকে একটা বোতল বের করতে গিয়ে বুঝলাম, একটাকায় নয় ঘোড়া পেয়ে যে কিনেছিলাম তা মহানন্দে, আস্তাবলে আছে তার প্রায় সবই। যার মানে হল এই পানির গো ইন স্টক করলাম, তা কিন্তু শেষ করতে পারবো না আমাদের বেইজিং থাকাকালীন অবস্থায়। কারণ গতরাত থেকে আজ সারাদিনেও একটা পুরো বোতলও শেষ হয়নি। রুমের সাপ্লাই দেয়া পানিতেই চলে গেছে দিন। এমনিতেই কি আমাদের গুরুজনেরা বলেছেন যে এক টাকায় নয়টা ঘোড়া পাওয়া গেলেও তা কেনার দরকার নেই, যদি না থাকে কোনো প্রয়োজন। প্রয়োজন যখন হবে তখন, দরকার হলে নয় টাকা দিয়েই একটা ঘোড়া কেনা উচিত! বোতল খুলে ফ্লাস্কে পানি ঢেলে চায়ের পানি গরম করার আঞ্জাম করতে করতে মনে হল, হায় ঐ কথাটা আগে শুনলেও, তা তো হৃদয়ঙ্গম করিনি কখনও, করলাম যা এখন, দেশ ছেড়ে বেইজিং এ এসে! কপাল ভাল এটা বুঝতে গিয়ে ঝড় যা গেছে, গেছে তা কাল রাতে শরীরের উপর দিয়ে। পকেটের উপর দিয়ে ঐরকম ঝড় বয়ে গেলে, মনে দুঃখ যতো পেতাম তার চেয়ে ঢের বেশি পেতাম গঞ্জনা। তবে সব জিনিষেরই যেমন ভাল মন্দ দিক থাকে, কাল রাতে একাকী এতো ওজন অতো দূর থেকে বয়ে নিয়ে আসতে হাঁফিয়ে নাকাল অবস্থা হলেও, তারও একটা ভাল দিক ছিল। তা হলো, এতে বেইজিং এ নেমেই হিমে কাবু হয়ে যাবার ফুরসৎ পাইনি। ফ্লাস্কের সুইচ অন করে দিয়ে, সোফার দিকে এগুনোর জন্য পা বাড়াতেই এসময় মিহি গলায় সুর তুলে ডোরবেল, বেজে উঠতেই দিক পরিবর্তন করে এগুতে হল বরং দরজার দিকেই। দরজা খুলতেই, করিডোরে দাঁড়িয়েই তুমুল বিরক্তিতে জানালো হেলেন যে, ঐ রুমের হাম্মামখানায় গোসল করার নামে, পুরো বাথটাব টইটুম্বুর করে পানি জমিয়ে তাতে ধুন্দুমার ঝাপাঝাপি করছে দীপ্র! তাতে গোটা বাথরুম পানিতে এমনি সয়লাব যে অচিরেই তা উপচে চলে আসবে রুমে। বারবার মানা করা সত্ত্বেও কানে তুলছে না সে ফুপ্পির কথা!
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবন্ধুত্ব মানে বিশ্বস্ততা, বন্ধুত্ব মানে সঞ্জীবনী শক্তি
পরবর্তী নিবন্ধমহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীর