মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীর

ড. পার্থ প্রতীম ধর | রবিবার , ৩১ জুলাই, ২০২২ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন বিশিষ্ট গণিতবিদ ও প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ শান্তিময় খাস্তগীর। চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগোপাড়া গ্রামে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে এলাকার কৃতিসন্তান রেবতী রমন দত্ত মহাশয় তাঁর শিক্ষাগুরু তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সম্মানে এ কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন।
অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীর ১৬ এপ্রিল, ১৯১৬ তারিখে চট্টগ্রামের পটিয়া থানার সুচক্রদণ্ডি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম সারদা চরণ খাস্তগীর ও মাতার নাম শশাঙ্কমালা। বাবা সারদা চরণ খাস্তগীর ছিলেন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। অন্য ভাইয়েরা হচ্ছেন জ্যোতির্ময় খাস্তগীর, কান্তি খাস্তগীর ও একমাত্র বোন কিরণ বালা খাস্তগীর। তাঁর জ্যৈষ্ঠভ্রাতা প্রফেসর করুণাময় খাস্তগীর চট্টগ্রাম কলেজের গণিতের অধ্যাপক ছিলেন। অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীর চিরকুমার ছিলেন। ধুতি, পাঞ্জাবী ও চাদর ছিল তাঁর প্রিয় পরিধেয় পোশাক।
তিনি পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্সপাশ করেন এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে আই.এসসি. ও ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে বি. এসসি.পাশ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কৃতিত্বের সাথে গণিত বিষয়ে এম.এসসি.পাশ করেন। তিনি ভূগোল ও গণিতে দক্ষ ছিলেন। পটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়েই শিক্ষকতা জীবনে প্রবেশ করেন এবং সুনামের সাথে ১৯৪৬-৪৮ এ তিনবছর শিক্ষকতা করেন। তাঁর সুখ্যাতি, জনপ্রিয়তা ও দক্ষতার প্রতি স্যার আশুতোষ কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ বাবু মাখন লাল নাগ মহোদয়ের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। অধ্যক্ষ বাবু মাখন লাল নাগ মহোদয়ের অনুরোধের প্রতি সম্মান জানিয়ে তিনি ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে স্যার আশুতোষ কলেজে যোগদান করেন। পরে তিনি অধ্যক্ষ বাবু মাখন লাল নাগ মহোদয়ের সহায়ক শক্তিতে পরিণত হন। অধ্যক্ষ বাবু মাখন লাল নাগ এরপর ০১-০৩-১৯৬৫ তারিখে শান্তিময় খাস্তগীর অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীর ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয়, শান্তিপ্রিয়, দেশপ্রেমিক বরেণ্য শিক্ষাবিদ। তিনি দীর্ঘ প্রায় ষোল বছর সফলতার সাথে গণিত ও বাণিজ্যিক ভূগোল বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। তৎকালীন চট্টগ্রাম দক্ষিণের মহকুমা প্রশাসক জনাব ইউসুফ উদ্দিন আহমদ শান্তিময় খাস্তগীর মহোদয়কে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেন।
স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ খ্রি. তারিখে কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থানরত অধ্যাপক পার্থ প্রতিম চৌধুরী, অধ্যাপক দিলীপ বাবু ও অধ্যক্ষ শান্তিময় বাবুকে নিরাপদ স্থানে সরে যাবার পরামর্শ দেন; কিন্তু শান্তিময় বাবু কলেজ ছেড়ে চলে যেতে রাজি হননি। তাঁকে কেউ মারতে পারে তা তিনি বিশ্বাস করতেন না। তাঁকে বাঁচানোর জন্য কলেজের অফিস সহকারী নুরুল ইসলাম আপ্রাণ চেষ্টা করেন। পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাঁচাতে নুরুল ইসলাম শান্তিময় বাবুকে তাদের বাড়িতে নিয়ে রাখতেন, পিছনের বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে রাখতেন। পার্শ্ববর্তী খন্দপাড়ায় কিছুদিন আত্মগোপন করেছিলেন। একদিন কলেজ ক্যাম্পাসে শান্তিময় বাবুকে না পেয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজাকার আলবদরবাহিনীর সহায়তায় কলেজের বাসা থেকে অধ্যাপক আমীর হোসেন চৌধুরী, কাজী নুরুল হক ও অরবিন্দু দেওয়ানজীকে তুলে সারোয়াতলী অস্থায়ী ক্যাম্পে নিয়ে যায়; তাঁদেরকে শারীরিক নির্যাতন করে ছেড়ে দেয়।
এরমধ্যে ৩০ জুলাই, ১৯৭১ খ্রি. তারিখে বিকেল বেলায় পাকিস্তানিরা শান্তিময় বাবুকে হত্যার লক্ষ্য নিয়ে কলেজ আক্রমণের খবর আসে এবং কলেজের কর্মচারী বাবু গোপাল দেসহ অন্যরা শান্তিময় বাবুকে সরে যেতে বললেও তিনি কলেজেই রয়ে যান, কলেজ ছেড়ে যাননি। শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি, ৩১ জুলাই, ১৯৭১ খ্রি. তারিখ শুক্রবার। সকাল বেলা থেকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। এরমধ্যে হঠাৎ রাইফেলের গুলির শব্দে সবাই প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যায়। পাকিস্তানিবাহিনীদের সহায়তায় রাজাকাররা শান্তিময় বাবুকে হত্যা করে। গোপাল বাবু প্রথমে খবর পান যে শান্তিময়বাবু ও তাঁর পাচক নারায়ণ বসুকে মেরে ফেলেছে। তবে নারায়ণ বসুর ছেলে ভজন কোনো রকমে পালিয়ে প্রাণে বেঁচে যায়। এ বরেণ্য শিক্ষাবিদকে কলেজের বাসায় পৈশাচিকভাবে হত্যা করে কলেজের দেয়ালে হত্যাকারীরা ‘ফজলুল কাদের কলেজ’ লিখে দেয়। শান্তিময় বাবুর প্রিয় ছাত্র ও ডা. বিভুতি ভূষণ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক বাবু সুকুমার শীল পরের দিন দেখতে পান তাঁর বাসভবনে রাজাকার-দুর্বৃত্তরা গুলি করে পেটের নাড়িভুড়ি বের করে ফেলে এবং জানালার পাশে খাটের উপর তাঁর মৃতদেহ, আর অল্প দূরে পাচক নারায়নের মৃতদেহ পড়ে আছে। তাঁর হত্যাকাণ্ডের পরে কলেজ প্রাঙ্গণ একেবারে জনশূন্য হয়ে পড়ে। চারিদিকে থমথমে অবস্থা এবং নিস্তব্ধতা নেমে আসে। দুদিন পরে ০২ আগষ্ট, ১৯৭১ খ্রি. তারিখে তাঁর প্রিয় ছাত্র বিজয় সেনগুপ্ত, বাবু ক্ষিরোদ কুমার খাস্তগীর, চণ্ডী চক্রবর্তী ও ডাক্তার জহিরুল হক পটিয়ার সুচক্রদণ্ডী গ্রামে পৈতৃক বাড়িতে তাঁর অর্ধগলিত মৃতদেহ নিয়ে যান এবং সমাহিত করেন (কেন দাহ করা হয়নি তা জানা যায়নি)।
সামাজিক ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান রয়েছে। তিনি সুচক্রদণ্ডী গ্রামের ‘মিলন মন্দির’ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে পটিয়া রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয় তাঁর পৈতিৃক ভূমির উপর এবং শশাঙ্কমালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তাঁর মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত। পটিয়া সরকারি কলেজের জন্য তাঁরা ভূমি দান করেন এবং বসতবাড়িসহ অন্যান্য সম্পত্তিও কলেজের নামে দান করেন। পটিয়াতে শান্তিময় স্মৃতি সংসদ এখনও চালু আছে। তাঁর নামে কলেজ প্রাঙ্গণে একটি শহীদ মিনার আছে এবং আরাকান সড়কের কিছু অংশ তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীর এর ঘাতক রাজাকার আলবদরদের বিচার হয়নি এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় শান্তিময় খাস্তগীর এর নাম সরকারিভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি যদি অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীর এর হত্যাকারীদের বিচার করে এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় শান্তিময় খাস্তগীর এর নাম সরকারিভাবে অন্তর্ভুক্ত করে তবেই শান্তিময় খাস্তগীর এর আত্মত্যাগ সার্থক হবে।
স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীবৃন্দ আজ ৩১ জুলাই তাঁর এ আত্মাহুতি দিবসে অধ্যক্ষ মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরশহীদ শান্তিময় খাস্তগীর মহোদয়ের আত্মার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
তথ্যসূত্র:
সুভাষ চন্দ্র চক্রবর্ত্তী, (২০১২). শহীদ অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীর, বোধন (শতবার্ষিকী অভিজ্ঞান, বান্ধব পাঠাগার), পৃ. ১২৮, সুকুমার শীল, (২০১৭). স্মৃতিতর্পণ: শহীদ বুদ্ধিজীবী বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীর, হীরক (স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজ এর হীরক জয়ন্তী স্মারক), পৃ.৫১-৫২. অধ্যাপক পার্থ প্রতীম চৌধুরী, (২০১৮). আমার কানুনগো পাড়া, অনুপম প্রকাশনী, ঢাকা। পৃ. ১২৪. সরোয়ার সুমন, (২০১৭). বিস্মৃত প্রায় তাঁরা, সমকাল ১৪/১২/২০১৭, ইতিহাসের খসড়া, (২০১৭) একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীর। বর্ষ-৩ সংখ্যা-৪, মে-জুন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজ, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধইসলামে পবিত্র হিজরি নববর্ষ ও মহররম মাসের ফজিলত ও তাৎপর্য