দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২০ জুন, ২০২১ at ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ

‘কিছু ফেলে গেলেন কি?’
হ্যাঁ ঐ ভাবলেশহীন চায়নিজ মূর্তিটি যে বধির নয়, বোঝা গেল তা। কারণ আমার মুখনিঃসৃত ধ্বনিসমূহ যে তার কানে পৌঁছেছে তা বুঝলাম; যখন সে তাকালো সরাসরি ঐ ধ্বনিসমূহের উৎসের দিকে, মানে সরাসরি আমার চোখে। নাহ আমার ঐ ধ্বনিসমূহ তার মুখমণ্ডলে বা দেহ ভঙ্গিতে আর কোন পরিবর্তন আনতে সক্ষম হল না, যে পড়বো তার দেহভাষা। কিছুক্ষণ অপেক্ষাও করলাম ঐরকম কিছু প্রতিক্রিয়া দেখার । কিন্তু না কাজ হল না তাতে! ফলে মনে হঠাৎ লাফ দিয়া উঠল; দূর এই মূর্তি, নাহ মূর্তি না খাম্বার সাথে কথা বইলা লাভ নাই। আর খাম্বার সাথে কথাই বা বলবো কেন? আমি তো মাতাল না। মনে ঐ কথা ফাল দিতে না দিতেই, ঘুরে দরজার কাছে গিয়ে দরজা ঠেলে আবারো পা ফেললাম মোটামুটি জনমানবহীন, অথচ নানান রঙয়ের মৃদু আলোয় আলোকখচিত বেইজিং নামের হিমসাগরের রাস্তায়।
ঘরের বাইরে পা ফেলতেই দশদিক থেকে দৌড়ে আসা হিম ফের এক্কেবারে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জাপটে ধরতেই টের পেলাম যে ,ঐ ঘরটির ওম ওম আরামের কারণে ঐ সামান্য সময়ের মধ্যেই, কখন যে মাথা থেকে হুডটি নিচে নামিয়ে ফেলেছিলাম মনে নাই তা। আর সেটি যে যথাস্থানে নেই, প্রথমেই জানান দিল তা, দু কান, আর নাক। অতএব দ্রুত হুড টি তুলে কান ঢেকে, মাথায় ঠিকঠাক মতো বসিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হিমের প্রকোপে কী না জানি না; মনে হল একদম মাতাল হওয়ার মতো না হলেও, দু এক পেগ খেতে পারলে ভালই হতো এ ঠাণ্ডায়। তবে মাতাল হওয়ার মত খাওয়াতো দূরের কথা, বউ বাচ্চা সাথে থাকায়, বিশেষত বউয়ের শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে, যে দু এক পেগ খাব তার উপায় থাকলেও সাহস যে নাই, স্বীকার করছি তা অকুণ্ঠচিত্তে!
আমাদের মতো অতিধার্মিক দেশে, চুরি বাটপারি, রাহাজানি , ঘুষ দুর্নীতি এসবে কারো চরিত্র যায় না। লোক চরিত্রহীন হয়ে যায়, যদি খোলামেলা ভাবে কেউ এক আধটু গিলে ঐ রঙিন পানীয়। কিম্বা লুকিয়ে খেয়ে, জনসমক্ষে করে মাতলামি। যদিও আজো ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারি নি, আসলেই মানুষ মাতাল হয় কী না। হ্যাঁ অতি পানে স্নায়ুর উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তা, বুঝি তবে তা মাতলামি করে উল্টাপাল্টা বলার বা করার মতো হবে কেন?
নাহ থাক ওইসব মাতলামি চিন্তা। দেশে ঐ সব পানিয় যেমন থাকে, যাকে বলে লোকচক্ষুর আড়ালে; পান টানও যারা করার করে লুকিয়ে চুরিয়ে। কিস্তু বেশীরভাগ দেশের মতো এখানেও আছে তা সারাক্ষণই চোখের সামনে। অতএব দেশের সমাজের নিষিদ্ধ এই দ্রব্যের প্রতি অকারণ টান সবসময় বাড়ে যেমন দেশের বাইরে গেলে, এখানেও হয়েছে তা। তার উপর এখানকার ঠাণ্ডা তো আছে সে ছাইচাপা ইচ্ছার আগুনে ঘড়া ভর্তি ঘি না, এক্কেবারে পেট্রল অকটেন ঢালার জন্যই। ফলে যতবারই হোটেলের লবি পেরিয়েছি এরই মধ্যে, ততবারই লবির ডান দিকের কোনায় মদির আলোয় ঢাকা নান্দনিকভাবে সজ্জিত বারটি ঢুলু ঢুলু চোখে ডেকেছে ইশারায়, আয় আয়। যদিও তাকাইনি সরাসরি ঐদিকে, যতক্ষণ ছিল দারাপুত্র পরিবার সাথে। তবে চোরাদৃষ্টি গিয়েছিল অবশ্যই নিজেরই অজান্তে। শুধু এই এখন যে একাকি বেরুলাম, তখনই লিফট থেকে নেমে, কন্সিয়ার্জ ডেস্কের দিকে যাওয়ার সময় একবার করে ভালমতো করেছিলাম চোখজরিপ সরাসরি। আবার কাজ শেষে, রাস্তায় নামার জন্য চক্রাকার গেটের দিকে রওয়ানা হতে হতে তাকিয়েছিলাম আরেকবার ঐদিকে, কাতর নয়নে।
সেই কাতর হাহাকারের সাথে এই রাস্তায় দ্রুতপায়ে হেঁটে যেতে যেতে বোঝার উপর শাঁকের আটি হয়ে গ্যাঁট হয়ে বসছে মনে ক্রমশই হতাশা। কারণ বা পাশের সব কিছুর দুয়ার দেখছি বন্ধ। লোকজনও দেখছি না রাস্তায় কোন, যে জিজ্ঞেস করবো এরকম করে কতদূর হাঁটলে পাবো আমার সেই সম্ভাব্য ভারতীয় রেস্টুরেন্ট। অবশ্য কোন দরজা খোলা থাকলেই বা কাউকে পথে পেলেই যে কোন লাভ হবে তারও তো ঠিক নাই। এই তো কিছুক্ষণ আগে দোকানের ঐ লোকটাতো আমার প্রশ্নের জবাবে করলো খাম্বাবৎ আচরণ!
এ কথা মনে হতেই মনে হল, আরে ঘটনা কি তাহলে এরকম যে; কারো কোন ভাষা যদি জানা না থাকে , তবে সে ভাষায় বক্তা যাই বলুক না কেন, শ্রোতার কাছে তা নিতান্তই অর্থহীন ধ্বনি ভিন্ন অন্যকিছু নয়। আরে! এ ব্যাপারটা এর আগে এভাবে তো কখনো হৃদয়ঙ্গম করিনি। সে দোকানের লোকের সাথে বাৎচিত করার চেষ্টাটি আমার পণ্ডচেষ্টা হয়নি এক্কেবারে! এ ঘোর হিমরাতে মোটামুটি জনমানবহীন রাস্তা পেরিয়ে একজনের সাথে দেখা হওয়ার পর তার খাম্বাবৎ আচরণে, একদম নতুন কিছু নতুনভাবে না শিখলেও সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, এ ব্যাপারে একটি নতুন বোধোদয় হল! আরে সেইজন্যই তো জ্ঞানীরা বলেছেন জানার কোন শেষ নাই। এখন তো মনে হচ্ছে, আমার মতো গবেটের জন্য জ্ঞান তো দূর অস্ত, যখন নিজেরই নিজ সম্পর্কে বোধোদয় নাই সঠিক! সাধে কি মহামতি সক্রেটিস সেই কবে এথেন্সে বসে মানবজাতির উদ্দেশ্যে বলে গিয়েছিলেন Know Thyself!
কিন্তু কথা হচ্ছে, ভাষারপ্ত করার আগে মানবশিশুর কর্ণকুহরে এরকম ধ্বনি প্রবেশ করলে ধবনির উৎসের দিকে চোখ ঘোরানোর সাথে সাথে, তার মুখেরও আদল পাল্টায়, এমনকি দেহভঙ্গিও বদলে যায়, যা নাকি আমরা পড়তেও পারি অল্পবিস্তর। কিন্তু এ মূর্তিতে ঐ সবের কিছুই ঘটে নি! যার কারণেই তুমুল বিরক্ত হয়ে দ্রুত দোকান থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিলাম। এখন দেখি মন বলছে, আরে মিয়া চায়নায় ভাষা বিভ্রাট নিয়ে জানা থাকা সত্ত্বেও, নিজে সেধে চায়নায় এসে পড়েছ বাপু চায়নিজের পাল্লায়; অতএব তোমার কথা বোঝার দায় তাদের নাই। দায় তোমারই যেভাবেই পারো, হাত পা নেড়ে চেড়ে প্রয়োজনে বুকডন মেরে ডিগবাজি খেয়ে হলেও, তোমাকেই বোঝাতেই হবে প্রয়োজন তোমার, এখানে। এ নিয়ে অতো অসহিষ্ণু হলে আখেরে তুমি পড়বে ঝামেলায় বউবাচ্চাসহ।
বউবা”চার প্রসঙ্গ মনে আসতেই সম্বিৎ হলো, আরে কম তো হাঁটিনি এরই মধ্যে! কতোক্ষণ হবে হাঁটলাম? নাহ পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখতে আলসেমি লাগছে। আসলে সময় যতোক্ষণই হোক, তাতে কিছু যায় আসে না। কতদূর এলাম সেটই বরং মুখ্য। অতএব চট করে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম হোটেল থেকে কতোটা দূরে এসেছি।
নাহ হোটেল তা চোখে পড়ছে না সরাসরি। কারণ যে রাস্তা ধরে হাঁটছি এখন, তার একদম বরাবর সরল রেখায় তো সেটির অস্তিত্ব নয়। দাঁড়িয়ে আছে তা বরং এই রাস্তা থেকে আরো পচিশ ত্রিশ মিটার ভেতরের দিকে। গাঢ় কুয়াশার পর্দা ভেদ করে এখান থেকে আবছাভাবে দেখতে পাচ্ছি যা, তা হল হোটেলের সামনের সেই বৃক্ষরাজিশোভিত ফুলেরবাগানটি। অবশ্য তাও দেখা যেত না, যদি না ছোট বড় বৃক্ষরাজিকে জড়িয়ে থাকতো নানানরঙয়ের আলোর মেলা। চোখের দেখা দিয়ে মন আন্দাজ করলো কিলোমিটার খানেক হবে হেঁটে এসেছি, খাবারের খোঁজে। এতে কাজের কাজ যা হয়েছে, তা হল পেয়েছি শুধু একটা মুদি দোকান খোলা, যাতে ছিল এক খাম্বাবত! নাহ আর না এগিয়ে দেখিনা সামনে চোখ ফেলে, মেলে কিনা কোন আলোর দিশা ।
ভেবেই তাকালাম সামনের দিকে, মানে হাঁটছিলাম যেদিকে এতক্ষণ, সেদিকে। নাহ যতদূর চোখ যায় কুয়াশা ভেদ করে, তাতে ডান পাশে থাকা এই হাঁটা রাস্তা আর এয়ারপোর্ট থেকে আসা মূল সড়কটিকে আলাদা করে রাখা, গাছ পালা শোভিত সড়ক দ্বীপটির গাছেগাছে জ্বলতে থাকা মৃদু আলোর রঙ্গিন বাতির ঝাপসা আভাস ছাড়া কোন জোরালো আলোর আভাসও দেখা গেল না বা দিক থেকে, যেদিকে আছে দোকান গুলো। মনে হল আর সামনে এগিয়ে গিয়ে লাভ নেই কোন। আরো এগিয়ে গিয়ে যদি কোন ভারতীয় রেস্টুরেন্টের হদিস না পাই, তাতে ফিরতে হবে খালি হাতে । আর পেলেও আমাদের পছন্দের খাবার যে একদম তৈরি আছে তা তো নয়। যার মানে হলো খাবার তৈরি করেই যদি দেয় তারা সময় লাগবে আরো বেশি। আর যদি প্যাকেট করে খাবার বিক্রি করার বিধান না থাকে সে হোটেলে, তবে হোটেলে ফিরে সবাইকে নিয়ে আবার গেলে, সে রেস্টুরেন্ট খোলা পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েও আছে ঘোরতর সন্দেহ। এ দিকে লাজু আর হেলেন দুজনেই অনিচ্ছুক রাতের খাবারের জন্য বেরুবার ব্যাপারে!
ঝটিতে মগজে এতসব বিকল্প চিন্তার কাটাকুটিতে মনে হল, নাহ আর এগিয়ে লাভ নেই। আরো এগিয়ে খালি হাতে ফেরার সময় যদি দেখি ঐ মুদিখানাও বন্ধ হয়ে গেছে, তবে আমও যাবে, যাবে ছালাও! দ্রুত ফিরতি হাঁটা দিলাম তাই। কারণ মনের মধ্যে কেউ বলতে শুরু করেছে, ‘হাঁট হাঁট দ্রুত হাঁট। ঐ লোক খাম্বাবৎ হউক আর যাই হউক, দোকান বন্ধ হয়ে গেলে সকালের নাস্তা আর রাতে খাওয়ার জন্য যে পানি কিনতে চেয়েছ, তা কিন্তু হয়ে যাবে হাতছাড়া।’
ফিরতি হাঁটায় মনে হল, আচ্ছা এমন ভুল কেমনে হইল। বাসের জানালা থেকে তো, আলো ঝলমলে সারি সারি খোলা দোকান দেখলাম অনেক এ পাশে। সব কি হঠাত হাওয়া হয়ে গেল নাকি ভোজবাজির মতো। অবশ্য হোটেলের স্টপেজে আসার বেশ কিছুটা আগেই বাসের পাইলট সাহেব যখন হাতের ইশারায় তৈরি হতে বলেছিল, ঐ ক্ষণটি থেকে সবাইকে নিয়ে দ্রুত নামার জন্য, বাংকের উপরে থাকা ব্যাগসমূহ নামানো আর ছোটবেলায় অসংখ্যবার দেশের বাসের ভেতরে লেখা আপ্তবাক্য “কিছু ফেলে গেলেন কি” যা গেঁথে আছে মনে এখনও, সেটির তাড়ায় এতোটাই ব্যস্ত ছিলাম যে , বাইরের দিকে নজর দেবার ফুসরতই ছিল না ঐ সময়টায়। অতএব এ এলাকাটি তখন পার হলেও, বাসের জানালা দিয়ে এই দোকানগুলো খোলা না বন্ধ তা তো দেখতেই পাই নি। আর বাস যদি খুব জোরে চলে থাকে তবে সেই ৫/৭ মিনিটে তো সেটই অতিক্রম করেছে কমপক্ষে ৫/৭ কিলোমিটার! অতএব খোলা দোকান যদি কিছু থেকেও থাকে, আর থাকে সেই ভারতীয় খাবারের রেস্টুরেন্টটিও, তবে সেটির দূরত্বও হবে এখান থেকে কয়েক কিলোমিটারই! যা ভাবার ফুরসৎ পাইনি এতোক্ষণ!
বাহ এসেই তো পড়লাম দেখছি এই রাতে এই অকুল পাথার হিমসাগরের একমাত্র খড়কুটো সেই খাম্বামহাশয়ের দোকানের কাছে! হাঁটতে হাঁটতে ডান দিকে চোখ রেখে হাঁটাতেই, চোখে পড়লো সরু দরজা দিয়ে বের হওয়া সেই দোকানের আলো। দ্রুততর পায়ে এগিয়ে হাঁটাপথ থেকে ৭/৮ ফুট দূরের, রাস্তা থেকে দু সিড়ি উপরে সেই দোকানের আপাত শক্ত করে ভেজানো দরজাটি ঠেলে ঢুকে পড়লাম তাতে দেরি না করে।
নাহ, দোকানে পা দিয়ে, খাম্বা মহাশয়ের দিকে মোটেও দৃকপাত করলাম না। বরং ঢোকার মুখেই দরজার পাশে রাখা একটার উপর আরেকটা এভাবে সাজিয়ে রাখা প্লাস্টিকের ঝুড়ির গুলোর একটা হস্তগত করে, জরিপ করতে লাগলাম ডান দিকের সেলফ রাখা বাটার বন জাতীয় রুটিগুলোর দিকে। ওগুলোর প্যাকেটের উপরের ছবি দেখে বুঝতে চেষ্টা করছি যে বাটার না কি চায়নিজ স্পেশাল কিছু আছে ওর ভেতরে। নাহ মাখনের ছবি দেখলাম না একটাতেও। উপরে থাকা নানা ফলের ছবি দেখে মনে হল, আছে ঐ সব ফলেরই জ্যাম বা জেলি আছে রুটির ভেতরে। লেখক
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার বাবা, আমার কল্পতরু
পরবর্তী নিবন্ধএকালের গল্প সেকালের ঘটনা