একালের গল্প সেকালের ঘটনা

মু. সিকান্দার খান | রবিবার , ২০ জুন, ২০২১ at ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ

প্রবাসে দৈববশে
লিড্‌স শহরে বিশেষ বিশেষ এলাকায় এক এক দেশের লোকের বসতি। যখনকার কথা বলছি, তখন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের যারা আবাসিক হলে উঠত না তারা নিকটবর্তী এলাকায় রুম নিয়ে থাকতো। এদের কেউ কেউ সস্ত্রীক এরকম এলাকায় অপেক্ষাকৃত ভালো পরিবেশে রুম বা ফ্ল্যাট ভাড়া নিতো। সেদেশীয় বাড়িওয়ালারা কেয়ারটেকারকে ভাড়ার জন্য বাড়ি বুঝিয়ে দিয়ে নিজেরা অপেক্ষাকৃত ভালো এলাকায় চলে যেত। লিড্‌সে আসার কয়েক মাস পরেই দেশ থেকে আমার স্ত্রীও এসে পড়েন। আমাদের বাড়ি চারতলা পুরনো ধরনের দালান। আমরা উঠেছি উপরের একটি ফ্ল্যাটে। এ বাড়ির কেয়ারটেকার কুটেনকভ্‌। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যেসব রাশিয়ান নাগরিক যুদ্ধে অংশ নিয়ে পশ্চিম ইউরোপে এসেছিল, তাদের অনেকে বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়ার কমিউনিস্ট ব্যবস্থায় সুখী হতে পারেনি। এদের কেউ কেউ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আর দেশে ফিরে যাবার আগ্রহ হারিয়েছিল। কুটেনকভ্‌ সেরকমই একজন দেশত্যাগী রাশিয়ান। তার মত অনেক দেশত্যাগী রয়ে গেছে ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে। তার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, বিপ্লবের আগে সে একজন বর্ধিষ্ণু কৃষক ছিল।
বিপ্লবের পর সেখানকার কৃষি সংস্কারের ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সে সমবায়ের সদস্যপদ পেয়েছিল। সমবায়ের সদস্য হিসেবে মূলতঃ খামারে ট্রাক্টর চালকের পদে নিযুক্ত ছিল। তার কথায়, কৃষিকর্মে তার যে অভিজ্ঞতা ছিল খামার ব্যবস্থায় তার সে অভিজ্ঞতার কোন মূল্য নতুন ব্যবস্থাপনা দিতে পারেনি। ভোটে নির্বাচিত পরিষদ কৃষি নয়, পার্টির কাজে অধিক জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সদস্যদের দ্বারাই পরিচালিত হত। তাকে সেই ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্দেশে কাজ করতে বাধ্য করা হত। তার ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশের সুযোগই ছিলনা। ফলে, সে কাজে উদ্যম উৎসাহ হারায় এবং যুদ্ধে যোগদান করার সুযোগে পশ্চিম ইউরোপে যুদ্ধরত মিত্র বাহিনীতে ট্যাঙ্কচালক হিসেবে যোগদান করে । যুদ্ধ শেষে সে ব্রিটেনের স্থায়ী অধিবাসী হয়ে যায়। তার মত পূর্ব ইউরোপ এবং রাশিয়ার বহু নাগরিক ব্রিটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন শহরে স্থায়ী বসবাস গড়ে তোলে। তাদের মধ্যে তখনও যোগাযোগ ছিল একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। তারা তখনও বিশ্বাস করত যে একদিন কমিউনিস্টদের হটিয়ে দিয়ে রাশিয়ায় পুনরায় ‘জার’ সম্রাটের শাসন ফিরে আসবে।
কুটেনকভ্‌ বয়সে বৃদ্ধ। তার ধারণা, তার বয়স সত্তর পার হয়েছে। কিন্তু, কথাবার্তা এবং কাজকর্মে তখনও খুবই সক্ষম। গোটা বাড়িটা সে দিনে একবার ঝাড়মোছ করে। ভাড়াটেদের খোঁজ খবর রাখে। সন্ধ্যার দিকে নিজের ঘরে পানাহার করে ভাড়াটেদের গতিবিধির খবর নিয়ে রাতের বিশ্রামে যায়। আমাদের বাড়িতে সবাই ভালো ভাড়াটে। দু’একজন যুবক বয়সীরা একটু রাত করে ফিরে। সঙ্গে মেয়ে বন্ধু থাকে। আর ঘরে ঢুকেই উচ্চগ্রামে সংগীত বাজাতে শুরু করে। আমাদের ঘুমে ব্যাঘাত হলে কুটেনকভকে বলি। তাতেই কাজ হয়ে যায়। কুটেনকভকে এরা প্রায় ভয় করে। আমাদের বাসায় আসার প্রথম দিন থেকে কুটেনকভ্‌ আমাদের বিশেষ যত্ন-আত্তি করে। আমার নাম সিকান্দার। সুতরাং আমি তার কাছে আলেকজান্ডার। আমার স্ত্রীকে সে প্রথম দিন থেকে প্রিন্সেস সম্বোধন করে। সে পাকিস্তান চিনে না, কিন্তু ইন্ডিয়া খুব ভালো করে চিনে। ইন্ডিয়ান প্রিন্সেসদের গল্প তার ছোটবেলার স্মৃতি। এখনো ইন্ডিয়ান প্রিন্সেস বলতে অজ্ঞান। আমাদের কোন কথাই শুনতে সে রাজি নয়। আমাদের দেশ (ইন্ডিয়া) সম্পর্কে সে রূপকথার গল্পেই বিশ্বাস করে। সুতরাং তাকে প্রিন্সেস থেকে আমার স্ত্রীর ডাক নাম নাজমায় সরানো যাবে না। অগত্যা আমরাই হার মানলাম।
সেদিন ২৬ মার্চ। নিয়মিত প্রাত্যহিক সব কাজ শেষ করে রাতে আমরা শুয়েছি। বাড়ির সবাই ঘুমে। রাতের একেবারে শেষ দিকে, ভোরে ভোরে কুটেনকভ্‌ উচ্চস্বরে আমাদের ডাকতে শুরু করেছে। দরজায় করাঘাত শুনে রীতিমত ভয় পেয়েছিলাম। কি হলো? রাতে তো এ ঘরে কোন ব্যতিক্রমী কিছু দেখিনি। আর আমাদের ফ্ল্যাটে কেন কুটেনকভ্‌ এভাবে এসে ডাকাডাকি করছে? দরজা খুলে দেখি তার হাতে ছোট একটি ট্রানজিস্টার রেডিও। তাতে খবর হচ্ছে। কুটেনকভ্‌ বলছে, কি হলো, তোমাদের দেশে আর্মি কেন নেমেছে? ট্রানজিস্টর এগিয়ে ধরে বলল, ঢাকায় বহু মানুষ মারা গেছে। তোমাদের শহরের নাম কি? এসব বলতে বলতে রেডিওটা আমাকে দিয়ে প্রিন্সেসের দিকে দুঃখ ভারাক্রান্ত চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। আমরা হতবিহ্বল। যা শুনছি তা বিশ্বাস হচ্ছিল না। একদিন আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আমাদের নেতৃত্বকে বেশ শক্ত করে বলতে দেখেছি টিভিতে, ‘অগ্রগতি নাহলে আলোচনা হচ্ছে নাকি?’ এরকম দৃঢ় আশাবাদই তো আমাদের নেতার মুখে শুনে ঘুমাতে গিয়েছি। কিন্তু একি শুনছি এখন? পাঠক, এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমরা দেশের বাইরে থেকে ভেতরকার যে খবর পাচ্ছিলাম তাতে মনে উৎকণ্ঠা থাকলেও সম্যক উপলব্ধি করতে পারিনি কি ঘটতে যাচ্ছে। দেশের ভেতর থেকেও কি কেউ ২৬ মার্চ আগে থেকে অনুমান করতে পেরেছিল?
যাক, কুটেনকভের কথায় ফিরে যাই। এই যে আমাদের দেশের খবর সেদিন ভোররাতে দিয়েছিল,সে খবর এখন প্রতিদিনের খবরে পরিণত হয়েছে। বাইরে থেকে আমরা এরপরের প্রত্যেকটি দিন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটিয়েছি। কুটেনকভের সঙ্গে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা হতো। কিন্তু, আমাদের সঙ্গে তাঁর পরিবেশ-পরিস্থিতির আকাশ প্রমাণ তারতম্যের কারণে তার সব অনুসন্ধিৎসুর উত্তর খুঁজে পেতাম না। তাই বলে আমাদের দেশের জন্য কুটেনকভের উৎকণ্ঠার কোনদিন কমতি হতে দেখিনি। এত বড় শুভাকাঙ্ক্ষির সঙ্গে আমরাও কখনো নিরুৎসাহিত হবার মত আচরণ করিনি।
লিড্‌স শহরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ছাত্ররা সংগঠিত হয়েছি। বাইরে যারা কাজ করতেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের নিয়ে লিবারেশন ফ্রন্ট গঠন করে সে দেশে আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন করার চেষ্টা করেছি। মহিলারা দেশের মুক্তি কামনায় নফল রোজা করে চলেছেন।
এসবের মধ্যে একদিন কুটেনকভ্‌ আমাদের ফ্ল্যাটে এসে দাওয়াত দিয়ে গেল তার জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে। তার সঙ্গে আমাদের অনেক বিষয়ে অমিলের মধ্যে খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় ছিল প্রধান। সুতরাং এসব কথা না তুলে শুধু দেশের দুর্দিনের কারণে দাওয়াত নিতে অক্ষমতা জানালাম। সে খুব দুঃখ পেলে আমরা নানাভাবে ক্ষমা চাইলাম। মনে হল, সে ক্ষমা করেনি।
কদিন পর, ঠিক যেদিন তার জন্ম তারিখ সেদিন, কুটেনকভ্‌ কিছু খাবার ও পানীয় নিয়ে আমাদের উপরের তলায় উঠে এলো। আমাদের কোন পূর্বানুমতির অপেক্ষা না করে কাবার্ড থেকে বেশ কয়েকটি ডিশ প্লেট নামিয়ে নিয়ে তার সব খাবারগুলো সেখানে সাজিয়ে নিল। শেষে আমাদের আহ্বান জানালো। আমি সহজ হয়ে তার সঙ্গে বসে গেলাম। বসার ঘরের সবকটি বাতি জ্বালিয়ে দেয়ায় অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি আলো ঝলমলে হয়ে উঠল আমাদের বসার ঘরটি। এ পর্যন্ত কোনো খটকা হয়নি, যেন আগে থেকেই এরকম হবার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু, খাবার পর্ব শুরুর জন্য সে প্রিন্সেসকেও আহ্বান জানাল। কিন্তু, প্রিন্সেসের এতে সায় নেই। আমি তাকে বুঝালাম। খাবার গুলো সব আমাদের প্রতিদিনের চেনা বস্তু। তবুও তার মহাআপত্তি। অবশেষে একটু আলাদা হয়ে একটা চেয়ারে বসলো। আমরা দুজন টেবিলে। আমি প্রায় সব আইটেমই খেলাম।
একসময় কুটেনকভ্‌ আমাদের মিটসেফ থেকে গ্লাস বার করলো। তাতে বোতল থেকে পানীয় ঢালতে গেলে আমি ক্ষমা চাওয়ার মতো করে বললাম, তোমার পানীয় আমরা খেতে পারব না। ঘরে আমাদের কোকাকোলা আছে ফ্রিজে। আমরা সে পানীয় খাব। কিন্তু, ব্যাকুল দৃষ্টিতে আবার অনুরোধ জানালো। আমি প্রত্যাখ্যানের ভঙ্গি করে ফ্রিজ খুলে আমাদের বোতল আনতে গেলাম। কুটেনকভের যেন আশা ভঙ্গ হলো। সে চাইছিল, তাদের সমাজে যেমন, আমরাও তেমনি একসঙ্গে পরস্পরের স্বাস্থ্য পান করব তার পানীয় দিয়ে। আমি নানাভাবে তাকে বুঝালাম যে তোমার প্রিন্সেসের মনোভাব যেরকম তাতে আমি তোমার পক্ষ নেয়া সম্ভব নয়। তোমার খাবারের যেগুলো এ পর্যন্ত সে আমাদের সঙ্গে বসে খেয়েছে সেগুলো তার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, আমার তোমার অনুরোধে নয়। আর পানীয়ের জন্য যদি অনুরোধ করি তার ফল বিরূপ হবে। সে তো খাবেই না বরং আমি কেন বেশি করে শক্ত করে প্রত্যাখ্যান করছি না তার জন্য আমাকে সন্দেহ করবে। এত বড় ঝুঁকি আমি নেব কি করে? আমি বরং তার প্রিন্সেসের দলে ভিড়ে গেলাম। করজোড়ে তার কাছে অব্যাহতি চাইলাম।
আমাদের অবস্থা দেখে সে প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিল। মনে হল, আমরা বেঁচে গেলাম। কিন্তু, তার দুঃখ ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমাদের মধ্যে এক অসহনীয় নিস্তব্ধতা নেমে এলো। নিজের দেশ সমাজ সংসার থেকে বিচ্যুত এক বৃদ্ধ রাশিয়ানের জন্য কেমন এক বর্ণনাতীত সহানুভূতি অনুভব করলাম। অবচেতন মনে আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থা, ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে তা ভেবে খুবই অসহায় বোধ করতে লাগলাম। এমন দৈব দুর্বিপাকে কি আমরাও পড়তে যাচ্ছি!
কদিন আগে টাইমস পত্রিকায় পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকবাহিনীর নৃশংসতার বিবরণ পড়েছিলাম। পূর্বপাকিস্তানের প্রত্যন্ত জনপদে আধুনিক মারণাস্ত্র সজ্জিত হানাদার সেনাবাহিনীর অভিযান যে সেখানকার অসহায় মানুষের কি অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ডেকে এনেছিল তার মূর্তিমান ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। মনে সংশয় হতে লাগল কুটেনকভের মত আমাদের আপনজনদের কেউ যদি বেঁচেও থাকে তাদের সঙ্গে কি আগেরমত সেভাবে মিলিত হতে পারব! হয়ত বছরের পর বছর আমাদেরও কেটে যাবে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে। এমনকি আমাদেরও অপশন দিয়ে পড়ে থাকতে হবে আত্মীয়-পরিজন বর্জিত কোন এক ইউরোপীয় দেশে। তখন কোন একদিন এই আমাদেরও কোন বন্ধুপ্রতীম এদেশীয় পরিবারের সঙ্গে কোন দিবস পালন করার সুযোগ খুঁজতে হবে । আর সামাজিক রীতি-নীতির অসামঞ্জস্যতার কারণে কোন এক পর্যায়ে পরিত্যক্ত হয়ে চোখের পানি ফেলার আজকের কুটনকভের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে। বুঝতে পারছিলাম কুটেনকভকে এ অবস্থায় পরিত্যক্ত হয়ে চলে যেতে দেয়াটা অমানবিক হবে।
কিন্তু, কি করা যায় তাও ভেবে পাচ্ছিলাম না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমার এমন অসহায় অবস্থায় প্রিন্সেস করুণ মুখ করে তাকে সাধতে লেগে গেল আমাদের বোতল থেকে পানীয় নিতে। অনেক পাল্টা-পাল্টির পর রফা হল। আমরা দুজন আমাদের পানীয় আর কুটেনকভ তার বোতলের পানীয় নেবে। যেটা তাদের সমাজের নিয়ম সেটা হচ্ছে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে পাত্রে পাত্র ঠেকিয়ে পরস্পরের স্বাস্থ্য পান করার ঘোষণা। আমরা সে লৌকিকতায় অকুণ্ঠচিত্তে রাজি হয়ে গেলাম। কুটেনকভের মুখেও স্মিত হাসি ফুটে উঠল। জীবনে আরও একবার বুঝলাম বিপদে পড়লে স্ত্রী বুদ্ধিতেও সংকটমোচন হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধআলো ছাত্রকল্যাণ পরিষদের আলোচনা সভা