দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৬ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

বড়দের বই, ছোটদের বই

একটু আগের চিন্তারই লেজ ধরে চলে এল মনে আব্বার বলা সেই কথাটির মানে, বড়দের বই, ছোটদের বই। এ নিয়ে আসলে বড়ই ধন্দে ছিলাম ঐ সময়ে। কিসের ভিত্তিতে কখন যে কোনটা বড়দের বই আর কোনটা ছোটদের বই, এই ব্যাপারটি তখন ঠিক করতো বড়রা, তার কোনো কূল কিনারা পেতাম না। যেমন একবার দেবদাস পড়ছিলাম যখন, তখন আম্মা নিজে তা পড়ার জন্য হাত থেকে ছো মেরে তা নিয়ে যাবার সময়, ধমকে বলেছিলেন ওটা বড়দের বই। আরেকবার তো চমৎকার রঙ্গিন কভারের আরব্য উপন্যাসে নামের বই নিয়ে খেয়েছিলাম কড়া ধমক, কেন হাতে নিয়েছি বড়দের বই? যদিও ঐভাবে ঐসব বই একবার হাতছাড়া হয়ে গেলেও পরবর্তীতে তক্কে তক্কে থাকতাম ওগুলো হস্তগত করার ব্যাপারে। আর একবার তা হাতে পেলে প্রবল সাবধানতায় ও তুমুল কৌতূহলে ওগুলো ঠিকই পড়ে ফেলেছি গোগ্রাসে, লুকিয়ে লুকিয়ে!
তবে যেসব বইয়ের উপরে লেখা থাকত প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য, বা বিবাহিতদের জন্য, সে গুলো যে বড়দের জন্যই নির্ধারিত বই, তা ঠিকই জানতাম। এমনিতে ওগুলো এড়িয়ে চললেও মাঝে মধ্যে সেগুলোর ব্যাপারেও কেন জানি জেগে উঠত একটা দুর্দমনীয় আকর্ষণ। এরকমই একটা বই, অত্যন্ত পবিত্র বইয়ের মর্যাদায় ঘরে আসীন থাকলেও, সেটিরও ছিল একটি প্রাপ্তবয়স্ক অংশ। যা নিয়ে ভেবে কূল পেতাম না। ভাবতাম পবিত্র বইয়ের আসন পাওয়া এই বইয়ে আবার নিষিদ্ধ অংশ থাকবে কেন? ফলে সে সংশয় দূর করার জন্য লুকিয়ে পড়েও ফেলেছিলাম সেটির ঐসব নিষিদ্ধ অংশ বিভিন্ন সময়ে, হাতের কিছু পড়ার মতো কিছু না পেয়ে। সেসময় প্রাপ্তবয়স্ক অংশটি পড়ে অনেক কিছুই না বুঝলেও, যতোটা বুঝেছিলাম তাতে মনে হয়েছিল মুক্সুদুল মোমেনিনের মতো পবিত্র নামের আর পবিত্র বলে সম্মান পাওয়া এই বইয়ে এসব কি লিখেছে ! বহুদিন বিবমিষায় আর সন্দেহে ভুগেছি এ নিয়ে। কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস করিনি, চুরি করে ধরা পড়ে যাবার ভয়ে। তবে বহুদিন পর প্রথাবিরুদ্ধ লেখক হুমায়ুন আজাদের লেখায় সেই বইটির ব্যাপারে তার স্বভাবসিদ্ধ অকপট মত প্রকাশের মধ্য দিয়েই হয়েছিল নিজের শৈশবের বিবমিষার মীমাংসা।
‘বাবা, বাবা ঐ ডান দিকের ঘরটা না, ওটা তো টিকিট কাটার ঘর। ব্যাগ রাখার ঘরটা তো ঐ বায়েরটা। ‘দীপ্রর কথায়, আনমনে ডান দিকে গোত্তা না ঠিক, কিছুটা যে কান্নি মেরে হাঁটছিলাম সে ব্যাপারে সচেতন হয়ে হাঁটার গতিপথ ঠিক করার সাথে সাথে পুত্রকে একটু বাহবা দিয়ে বাড়িয়ে দিলাম হাঁটার গতিও।
এদিকে নিজের হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিতেই, দু পুত্র হাত কাঁধ ঝাকিয়ে তাদের কাঁধে রাখা আমার হাতপাশ থেকে মুক্ত হয়ে, দিল ভোঁ দৌড় সেই ব্যাগঘরের দিকে, বুঝলাম ওখানকার উষ্ণতা ডাক দিয়েছে ওদের। উষ্ণতার এতোটা কাছে এসে তাদের আর তর সইছে না, তার বুকে দ্রুত ঝাপিয়ে পড়ার। এসময় নিজেরও ভেতর থেকে একই তাড়না অনুভব করতেই, দৌড়ে যাবার বদলে পিছু ফিরে তাকাতেই দেখি, এরই মধ্যে হেলেন আর লাজুও দৌড় না ঠিক এগুচ্ছে সেই উষ্ণতার দিকে জগিং এর ভঙ্গিতে।
এভাবে সকলেরই গতি বেড়ে যাওয়াতে দ্রুতই ব্যাগ ঘরে পৌঁছে, নিজেদের ব্যাগের দখল নেবার পর, মনে হল এখন আর দ্রুত এখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়া চলবে না। সময় দিতে হবে কিছুক্ষণ, এখানকার উষ্ণতায় গা ডুবিয়ে যাতে সবাই কিছুটা ধাতস্থ হয়ে নিতে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে কী না জানি না দেশে তো এখন ঘোরতর মাঘেও বাঘের কলজে কাঁপানো সেই শীত আর আসে না। অতএব শীতের অভিজ্ঞতা বিশেষত বাচ্চাদের তো শূন্যই বলা চলে। আর যদি থাকতোও তাদের সেই অভিজ্ঞতা, তাও তো এখানে কোনোই কাজে আসতো না। আসছে না যেমন লাজুর, কারণ তার তো জন্ম আর বেড়ে ওঠার অনেকটা সময় কেটেছে, দেশে সবচেয়ে বেশী শীত উত্তরবঙ্গের যে অংশে পড়ে, সেই অঞ্চলে। তিয়েন আন মেন স্কয়ারের হিমে সেও তো দেখছি একই রকম নাকাল। আজীবন পুকুরে সাতরানোর অভিজ্ঞতা দিয়ে যেমন খরস্রোতা নদীতে সাঁতরানো যায় না, অবস্থা অনেকটা ঐরকমই।
অতএব যার যার ব্যাগ একে একে তার তার হাতে তুলে দিতে সবাইকে আশ্বস্ত করার জন্য বললাম যে, এক্ষুণি বেরুচ্ছি না এখান থেকে। অপেক্ষা করবো ততোক্ষণ যতক্ষণ না সবাই একটু ধাতস্থ হয়ে উঠছে। এ কথায় সবারই মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেও তুমুল স্বস্তিতে শীতকাতুরে হেলেন বলে উঠল
‘যাক ভাল হল। আমিও একবার ভাবছিলাম তোকে বলি এটা। আবার ভাবলাম তুই যদি রাজি না হস, এভাবে সময় নষ্ট করায়। আচ্ছা এখানে এখন কতো শীত পড়েছে ?’
‘মাইনাস সেভেন্টিন বাট মে ফিল লাইক মাইনাস টুয়েন্টি’ বেশ বিজ্ঞের মতো জবাব এলো অভ্রর কাছ থেকে।
বলছ কি? তাই নাকি? জানলে কোত্থেকে? কিভাবে জানলে? কল্পনাও করিনি যে ঠাণ্ডার, সেরকম ঠাণ্ডার এই খবর ছোটপুত্রের মুখ থেকে কানে ঢুকতেই একসাথে প্রশ্ন গুলো বেরিয়ে এলো মুখ থেকে, সাথে সাথেই যেন বা এই ঘরের উষ্ণতার ভেতরেও নতুন করে কেঁপে উঠলাম হিমে!
‘ও মাগো ! বলে কি ?’ প্রায়ই একই গলায় আর্তনাদ করে উঠলো হেলেন আর লাজু।
এদিকে নিজের আইপড এগিয়ে দিতে দিতে অভ্র বলল ‘কেন ? আইপডে দেখেছি, সেই সকালে গাড়ী থেক নেমেই। এই যে দেখো এখন এটাতে’
যদিও এ নিয়ে ভুল কিছু বা মিথ্যা বলার কোনোই কারণ নেই অভ্রর, তারপরও অকল্পনীয় এই ঠাণ্ডার মাত্রার খবরটি নিজ কানে পরিষ্কার শুনতে পেয়েও, বিশ্বাস হতে চাইছিল না তা। তাই চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করার জন্য ওর আইপড হাতে নিয়ে ওটির পর্দায়-১৭ লেখাটিকে আমার দিকে তুমুল ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভাবছিলাম এ আবার কি কথা হল? ঠিক কতোটা ঠাণ্ডা পড়েছে, তা এতক্ষণ না জানলেও সে ঠাণ্ডায় যতই ছেড়াবেড়া কাহিল অবস্থা হয়ে থাকুক না কেন, ঠিকই তো তা সহ্য করেছিলাম। এখন জানার পর তো মনে হচ্ছে ওটা আর সহ্য করা যাবে না! দূরতম কল্পনায়ও তো এখানকার ঠাণ্ডার গায়ে একটা নম্বর কল্পনা করিনি। এরকম ঠাণ্ডা পড়লে পড়তে পারে শুধু এন্টার্টিকায় বা সাইবেরিয়ায় সেই ধারনাই তো পাকাপোক্ত হয়ে গ্যাঁট হয়ে বসেছিল অবচেতনে। কিন্তু বেইজিং এর শীতেও যে এন্টার্টিকা জাঁকিয়ে বসতে পারে তা তো ভাবিইনি কোনদিন। তাইতো ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না সেই থেকে যে, যেরকম কাপড় চোপড় পড়েও এখানে ঠাণ্ডায় নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছি, প্রায় একই ধরনের কাপড় পড়ে তো সুইজারল্যান্ডের মাইনাস সাত আট বা নয় ডিগ্রীতে ঘুরেছিলাম কিভাবে অনায়াসে তাহলে। মিলল এখন সেই উত্তর!
সে উত্তর পেতেই ফের মনে পড়লো, তিন নাকি যেন চার লক্ষ বছর পূর্বেকার আমাদের পূর্বপুরুষ পিকিং মানবের কথা! বিনা কাপড়ে, গরম পশম বা লোমহীন শরীর নিয়ে এই সাইবেরিয়ায় তারা বেঁচেছিল কিভাবে ? আচ্ছা তখন কি তারা আগুন কিভাবে জ্বালাতে হয়, তা শিখেছিল? না কি তারা এই ঠাণ্ডার বিষম ঠেলাতেই শিখে গিয়েছিল, পশুর লোমশ চামড়া গায়ে চড়িয়ে দিলে এই ঠাণ্ডা মোকাবেলা করা যায় সহজে? নাহ এসব প্রশ্নের কোনোটারই উত্তর জানা নেই। তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত তখন তারা ঠাণ্ডা মাপতে জানত না, তাই হয়তো এতো ঠাণ্ডা নিয়ে তাদের অতোটা মাথা ব্যথা ছিল না। নাঙ্গা শরীরে তাদের মাইনাস দশ, আর মাইনাশ বিশ মনে হতো হয়তো যাহা বাহান্ন তাহাই তিপান্ন। কারণ এইতো যতক্ষণ না নিজে জেনেছি এখানকার সঠিক তাপমাত্রার খবর তাতে ঠিকই চলছিলাম। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে এ হিম সওয়া যাবে না আর! আচ্ছা এমনই বা কেন ভাবছি যে, সেই তিন চার লক্ষ বছর আগেকার বেইজিং এর শীত এমনই ঠাণ্ডা ছিল ? তা তো নাও হতে পারে। সাড়ে চার বিলিয়ন বছর বয়সের পৃথিবী নামের এখনকার এই সবুজ গ্রহটির জলবায়ু, আবহাওয়া, তাপমাত্রা সবই তো বদলেছে বার বার বহুবার প্রাকৃতিক ভাবে।
‘আচ্ছা এরপর এখান থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবো আমরা, ঠিক করেছ কি’ স্ত্রীর করা এই অত্যন্ত জরুরি প্রশ্নে বিলিয়ন, মিলিয়ন বছর মার্কা এইসব চিন্তা এক ঝটকায় লেজ তুলে পালালো দ্রুত প্রথমে তিয়েন আন মেন স্কয়ার উল্টা দিকটায়, মানে এখন যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি তার বিপরীতে। লি খাঁর বাহন থেকে নেমে, হিমের ঝাপটায় কাবু হতে হতে চারদিকটায় চোখ যা বুলিয়েছিলাম, তাতে ঐ দিকটায় একটা বেশ আধুনিক ডিজাইনের বিশালাকায় দালান দেখেছিলাম। জানি না ঐ দালানে কি আছে। তারপরও ঐ দালানটির ছবি মনে ভেসে উঠতেই ভাবলাম বলি আমাদের পরবর্তী গন্তব্য সেই দালানে। সাথে সাথেই মনে হল এটা বলার পিঠেই তো প্রশ্ন আসবে, কি আছে ওখানে? আর সে প্রশ্নের উত্তর তো জানি না। তার চেয়ে বরং বলি তা-ই, জানি যা।
তিয়েন আন মেন মানে তো জানি হল গিয়ে, স্বর্গ শান্তির দরজা। এই স্কয়ারের এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তা থেকে বা দিকের শেষ মাথাতেই তো দেখেছিলাম স্বর্গশান্তির দরজা নামে, ঐতিহ্যবাহী চায়নিজ স্থাপত্যের সেই পুরানো লাল রঙয়ের দালানটি, যার সামনের দেয়ালে মাও সে তুং এর বড় একটা ছবি লাগানো আছে। স্বর্গ নরকে বিশ্বাস না থাকলেও মাও সে তুং এর দেহ তো রাখা আছে পরম যত্নে স্বর্গ শান্তির দরজা নামের পাঁচশ নাকি ছয়শ বছর আগে মিং বংশের রাজার তৈরি করা সেই ঘরে। একথা মনে হতেই সবজান্তা ঢং এ বললাম, তিয়েন আন মেন দালানে যাব এরপর।
‘তিয়েন আন মেন তো স্কয়ারের নাম বলছিলা। এখন আবার বলছ দালান। ঠাণ্ডায় কি মাথায় গুলিয়ে গেছে নাকি তোমার’?
না মাথা ঠিক আছে। ঐ দালানটার নামেই এই স্কয়ারের নাম হয়েছে। আর এর মানে হল গিয়ে স্বর্গশান্তির দরজা।
‘রাখো তোমার স্বর্গশান্তি। এখানে দোজখের চেয়েও বেশী ঠাণ্ডা, আর উনি দিচ্ছেন এখানে স্বর্গ শান্তির খবর’ একরাশ বিরক্তি আর অসহিষ্ণুতা একসাথে লাজুর কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়লেও, তা উপেক্ষা করার তুমুল ঝুকি নিয়ে কেন জানি বললাম
শোন তুলনাটা ঠিক হয় নাই। দোজখ কোন ঠাণ্ডা জায়গা না। ওটা হল চূড়ান্ত গরম জায়গা। আগুনে আগুনে আগুনাকার সে জায়গায় কেউ সামান্যতম ঠাণ্ডা পেলেই তো বর্তে যাবে। চায়নিজ রাও সম্ভবত দোজখের মাংশ হাড্ডি গলিয়ে দেবার সেই গরমের কথা জানতো আগে থেকেই, যার কারণেই এখানকার এই ঠাণ্ডা এলাকার স্বর্গশান্তি নাম রেখেছিল।
‘ফাজলামি রাখো তো। ঐ ঘরে কী দেখার আছে বল’?
মাও সে তুং এর আধুনিক মমি আছে, এটা জানি নিশ্চিত। আর কি কি আছে ওখানে গিয়ে দেখতে হবে। স্ত্রীর প্রশ্নের উত্তর দিলাম এবার যথাযথ তমিজের সাথে গম্ভীরভাবে।
‘আবারো ফাজলামি! আধুনিক মমি আবার কী? আর মমি তো আছে মিশরের পিরামিডে। এখানে কি পিরামিডও আছে নাকি?”
নাহ বললাম তো আছে স্বর্গ শান্তির দরজা নামের ঘর আছে, পিরামিড না। তবে পিরামিডে যেমন মৃত ফারাওদের লাশ বিশেষ কায়দায় মমি করে রাখা হতো, তেমনি এই ঘরেও রাখা আছে মাও এর দেহ, আধুনিক ভাবে সংরক্ষণ করে। মমি যেহেতু পচনশীল মানবদেহকে সংরক্ষণ করার একটা কৌশল, সে কারণে মাওয়ের সেই সংরক্ষিত শরীরকেও মমি বলেছি আর কি। আধুনিক কালের এই মমিকরণ পদ্ধতিতে মানুষের চেহারা কিন্তু অনেকটাই ধরে রাখা যায় অবিকৃতভাবে। অতএব প্রাচীন মিশরীয়দের মমি নিয়ে যতই আমার অবাক হই না কেন, তার চেয়ে ঢের বেশী অবাক হব নিশ্চিত আমরা এখানে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনাকে নিয়ে এলোমেলো যত ভাবনা
পরবর্তী নিবন্ধকৃষক ধানের ন্যায্য দাম পেলে বাড়বে উৎপাদন