কৃষক ধানের ন্যায্য দাম পেলে বাড়বে উৎপাদন

চালের আমদানি নির্ভরতা

রেজাউল করিম স্বপন | রবিবার , ১৬ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে চাল আমদানিতে দ্বিতীয়। সমপ্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) ডিসেম্বর ২০২১ এর ‘খাদ্যশস্য: বিশ্ববাজার ও বাণিজ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায় চাল আমদানিতে শীর্ষ দেশ হলো চায়না। তারা আমদানি করে ৪৫ লাখ মে. টন চাল। দ্বিতীয় বাংলাদেশ আমদানি করে ২৬.৫ লাখ মে. টন চাল। এরপর ফিলিপাইন আমদানি করে ২৬ মে. টন চাল, তারপর নাইজেরিয়া, তারা আমদানি করে ১৯ মে.টন চাল। এরপর সৌদি আরব, তারা আমদানি করে ১৩ মে. টন চাল আমদানি। শুধু চাল নয়, বাংলাদেশ বছরে ৭২ লাখ টন গমও আমদানি করে। সে হিসাবে বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় বছরে প্রায় ১ কোটি টন। অর্থাৎ ১৮ কোটি মানুষের দেশে বছরে প্রায় ১ কোটি টন চাল/গম আমদানি করতে হয়। বিষয়টি সত্যি ভাবনার। কারণ কোনোভাবে এই আমদানীর পাইপলাইন বন্ধ হয়ে গেলে দেশে চরম বির্পযয় নেমে আসবে।
২০১০ সাল হতে সরকার চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ দাবী করে আসছিলো। কিন্তু গেলো দশকের শুরুর দিকে কয়েক বছর দেশে উৎপাদিত চাল দিয়ে চাহিদা মিটাতে পারলেও ২০১৩ সাল থেকে ধারাবাহিক ভাবে চাল আমদানি করতে হচ্ছে। তবে চাল আমদানি নির্ভর করে ধান উৎপাদনের উপর। যে বছর ধান উৎপাদন কম হয় সে বছর আমদানি বেশি করতে হয় আর যে বছর উৎপাদন বেশি হয় সে বছর আমদানি কম করতে হয়। তবে প্রতিবছরই কিছু না কিছু চাল আমদানি করতে হয়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বাংলাদেশে চালের দাম বেশী। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ৮/১২/২০২১ইং এ দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে মোটা চাল খুচরা পর্যায়ে কেজি ৪৪-৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরু চালের দাম কেজি ৬৬-৭০ টাকায় ও মাঝারি চালের দাম কেজি ৫২-৫৪ টাকায়। গতবছর মার্চে করোনার কারণে চালের দাম অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল যা আর কমেনি। এক্ষেত্রে সরকারি গুদামে চালের মজুদ একটি বড় নিয়ামক। দেখা যায় সরকারি গুদামে মজুত ১০ লাখ টনের নীচে নামলে বাজারে চালের দাম বেড়ে যায়। মজুত যত কমে চালের দাম তত বাড়ে। সে কারণে চালের দাম স্থিতিশীল রাখতে হলে চালের মজুত অবশ্যই ১০ লাখ টনের উপরে রাখতে হবে। এখন সরকার খোলাবাজারে বিক্রি কর্মসূচির (ওএমএস) আওতায় কম দামে চাল বিক্রি করে, যেখানে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের লম্বা লাইন দেখা যায়। এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন ভারত থেকে চাল আমদানি করলে দাম পড়ে প্রতিকেজি ৩২-৩৩ টাকা। পাকিস্তান থেকে আমদানি করলে পড়ে ৩৪ টাকা। ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করলে পড়ে ৩৮ টাকা, থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করলে পড়ে ৪০ টাকা। এর মানে হলো বাংলাদেশ থেকে ঐসব দেশে চালের দাম কম। এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশে চালের দাম বেশি কেন? কারণ আমাদের দেশে কৃষি জমি দিনকে দিন কমে যাচ্ছে ফলে উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। আবার যে পরিমান কৃষি জমি আছে, সেখানেও কৃষকরা ধান চাষ না করে ফল ও মাছ চাষের দিকে ঝুঁকছে। কারণ ধান চাষের চেয়ে ফল ও মাছ চাষ অধিক লাভজনক। আবার অনেক ক্ষেত্রে কৃষকেরা ধান উৎপাদন না করে জমি খালি রাখছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ধান উৎপাদনে কৃষকের আর্থিক ক্ষতি হয়। কারণ বর্তমানে ধানের উৎপাদন খরচ বেশী। সেই তুলনায় ধানের বিক্রয় মূল্য কম। যেমন উৎপাদন করতে দিনমজুরের পারিশ্রমিক(ন্যূনতম পাঁচশ টাকা), হাল, সেচ, কীটনাশক, সার প্রয়োগ, ধান কাটা, মাড়াই ও অন্যান্য খরচ সহ প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ পড়ে প্রায় ৮০০ টাকা। কিন্তু সরকারি ধান ক্রয় কেন্দ্র না থাকায় দেশের অনেক জায়গায় কৃষকগণ তাদের উৎপাদিত বোরো ধান বিক্রি করতে হচ্ছে প্রতি মণ ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়। প্রশ্ন হলো খরচের অর্ধেক দামে বিক্রি করে কৃষক কেন ধান উৎপাদন করবে? তাই উৎপাদন বাড়াতে হলে ধানের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। অন্য দিকে ধান চাষের উপকরণ যেমন উচ্চ ফলনশীল বীজ সার কীটনাশক ও সেচের পানি ক্ষেত্র বিশেষে বিনামূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। চাষাবাদে কারিগরি উপকরনের প্রয়োগ ও প্রয়োজন বোধে সমবায়ের মাধ্যমে জমিতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। এজন্য কৃষি মন্ত্রণালয়কে অধিকতর উদ্যোগী হয়ে মাঠ পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। না হয় দিনকে দিন চালের উৎপাদন কমবে। আমাদের মনে রাখা দরকার প্রতিদিন দেশে চাষাবাদের জমির পরিমান কমছে আর মানুষ বাড়ছে। যা বাংলাদেশের মত একটি ছোট দেশের জন্য অশনি সংকেত।
এদিকে ইউএসডিএর প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বাংলাদেশ ২০১৯ সালে ৩ কোটি ৬৫ লাখ টন চাল উৎপাদন করে এবং ২০২০ সালে মোট উৎপাদন ৬ শতাংশের বেড়ে ৩ কোটি ৭১ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ফুড আউটলুক-জুন ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানা গেছে, বিশ্বে চাল উৎপাদনে তৃতীয় স্থান দখল করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালে বাংলাদেশে চাল উৎপাদন বেড়ে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টন হবে বলে মনে করছে সংস্থাটি। চীন ও ভারত এক ও দুই নম্বর অবস্থানে থাকবে বলে প্রতিবেদনে আভাস দেওয়া হয়েছে। চীন উৎপাদন করবে ১৪ কোটি ৬৬ লাখ ও ভারত উৎপাদন করবে ১২ কোটি ৩১ লাখ টন চাল। ফলে তারা তাদের স্থান ধরে রাখবে বলে মনে করছে সংস্থাটি। তবে চীন, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ায় চালের উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও ভারতে বাড়ছে না। দীর্ঘদিন ধরে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ বৈশ্বিক অবস্থান ছিল চতুর্থ। চীন ও ভারতের পরেই তৃতীয় স্থানটি ছিল ইন্দোনেশিয়ার। তবে এবার ইন্দোনেশিয়াকে টপকে তৃতীয় স্থান নেবে বাংলাদেশ। এটি একটি আশার কথা। তবে সাথে সাথে আমদানি বেড়ে যাওয়া দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে।
দেশে উৎপাদিত চালের ৫৫ শতাংশের বেশি আসে বোরো ধান থেকে। বাকিটা আসে আউশ ও আমন থেকে। বছরে একই জমিতে তিন বার ধান উৎপাদন করা হয়। বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা ধান আবাদের আওতায় আনা হচ্ছে। হাওর অঞ্চলের উপযোগী ধানের জাত সমপ্রসারণের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। চলতি মৌসুমে হাওর এলাকায় ধানের বাম্পার ফলনের মাধ্যমে দেশের চালের উৎপাদনের একটি বড় পরিবর্তন আসতে পারে। সর্বশেষ বোরো মৌসুমেও সাড়ে ৪ লাখ টন বাড়তে পারে চালের উৎপাদন। তিন মৌসুমে উৎপাদন বৃদ্ধির সম্মিলিত ফলাফলই বাংলাদেশ শীর্ষ তিনে চলে আসার প্রকৃত কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চলতি বছর বোরো মৌসুমে কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী প্রতি কেজি চালের উৎপাদন খরচ ছিল ৩৮ টাকা। আর সরকার প্রতি কেজি চাল ৪০ টাকা ও ধান ২৭ টাকা দরে কেনার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু বাজারে ধানের দাম সরকারের সংগ্রহ মূল্যের চেয়ে চার পাঁচ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৪ থেকে ৪৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার সুফল যাচ্ছে চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের পকেটে। অথচ কৃষক এক্ষেত্রে ন্যায্য দাম পাওয়া হতে বঞ্চিত হচ্ছে ও সরকার ঘোষিত ধানের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। ফলে সরকারকে এমন নীতিমালা নিতে হবে যাতে কৃষক ধানের ন্যায্য দাম পায় আবার অন্য দিকে চালের দামও আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বিত হয়। মনে রাখা দরকার কৃষক ধানের ন্যায্য দাম পেলে উৎপাদন আরো বাড়বে। ফলে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধআন্দোলনরত ছাত্রীদের ওপর হামলার অভিযোগ শাবি ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে