করোনাকে নিয়ে এলোমেলো যত ভাবনা

মোঃ শফিকুল আলম খান | রবিবার , ১৬ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

গেল মঙ্গলবার, এগারো জানুয়ারি আমার শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর আগের দিন সকাল থেকে সমস্ত শরীরে তীব্র ব্যথা, জ্বর এবং শুকনো কাঁশি অনুভব করছিলাম। বিকেলের দিকে তাপমাত্রা একশ দুই এবং তিনের মধ্যে উঠা নামা করছিল। নাপা সেবন করেছিলাম।রাতে তাপমাত্রা কমে যায়। পরিবারের সবাই বলছিল কোভিড টেস্ট করার জন্য। আমার কিন্ত টেস্টের কোন আগ্রহ ছিল না। কারন আমি খুবই সচেতন ব্যক্তিদের একজন ছিলাম।গত দু ‘বছর স্বাস্থ্য বিধি একদম পুরোটাই মেনে চলেছি। তাছাড়া দু ‘ডোজ টিকা যথাসময়ে নিয়েছি। বুস্টার ডোজও দিয়ে দিয়েছি। অনীহা সত্বেও শ্যালক ডাক্তারের পরামর্শে র‌্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট করালাম। দশ মিনিটের মধ্যে রিপোর্ট পেলাম, পজিটিভ। আমার চোখ যেন কপালে উঠল। বিশ্বাস করতে পারছি না। এই রিপোর্ট কতটুকু সত্য মনে সন্দেহ রয়ে গেল। তাই ফৌজদারহাট বিআইটিআইডিতে আরটিথ পিসিআর টেস্ট এর জন্য শ্যালক ফৌজদার হাটে ফোন করে বাসায় এসে স্যাম্পল নিতে লোক পাঠাতে বলল। দুপুরে লোক এসে স্যাম্পল নিয়ে গেছে। রাতের মধ্যেই জানলাম এখানেও রিপোর্ট পজিটিভ। তার মানে শতভাগ নিশ্চিত আমার করোনাই হয়েছে।
ভাবছি, আমার কেন করোনা হল? দেশে করোনার প্রার্দুভাব দেখা দেয়ার পর থেকে প্রায় দেড় বছর ঘর থেকেই বের হই নি। এমনকি বাজারে, মসজিদেও যাই নি। যাই নি কোন ঘরোয়া অনুষ্ঠানে বা আত্মীয়ের বাড়িতে। গত বছরের আগস্ট/সেপ্টেম্বর থেকে খুবই জরুরী প্রয়োজনে মাঝে মধ্যে বের হলেও সার্জিকেল ডাবল মাস্ক ব্যবহার করেছি। মসজিদে নিজ থেকেই দূরত্ব বজায় রেখে নামাজ আদায় করেছি। কারো সাথে কথা বললে দূরত্ব মেনে কথা বলেছি। বাসায় ফিরে সাবান দিয়ে বার বার হাত ধুয়েছি। মোবাইলসহ হাতের সব জিনিস বারে বারে স্যানিটাইজ করেছি। আ্যসট্রোজেনিকার দু’ ডোজ টিকা আগেই দিয়ে দিয়েছি। আমার বয়স সত্তর বছর।একুশ ডিসেম্বর দিয়েছি বুস্টার ডোজ।
তাহলে মনে প্রশ্ন জাগেএত সতর্কতার মাঝেও কেন করোনা হল? হ্যাঁ, ডিসেম্বরের শেষ দিকে দেশে বিয়ে শাদীর ধুম পরে। বেশ কয়েকটিতে যেতে হয়েছে। তবে খুবই সর্তকতার সাথে ডাবল মাস্ক পরে। অবশ্য খাওয়ার সময়তো আর মাস্ক রাখা যায় না। তাওতো এগুলো আট/ দশ দিন আগের ঘটনা।
আবার ভাবছি, রেলওয়ে হাউজিং সোসাইটির নির্বাচন উপলক্ষে কয়েকদিন যাবত রেলওয়ের কর্মকর্তা/ কর্মচারীরা ব্যক্তিগত/দলগতভাবে ভোটের জন্য বাসায় এসেছিল। তাদের সবার সাথে অবশ্য মাস্ক পরে দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলেছি। তবে সর্বশেষ ৫/৬ জনের একটি গ্রুপকে কলিং বেল দেয়ার সাথে সাথে দরজা খুলে দিয়েছি। তারা বাসায় ঢুকেনি। দরজায় দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট তাদের সাথে কথা বলেছি। তখন এই সর্ব প্রথম মাস্ক পরতে ভুলে গেছি। ওনারা বিদায় হওয়ার পর বারবার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল কেন মাস্ক পরতে ভুলে গেলাম। জানি না সেটাই আমার জন্য কাল হয়েছে কিনা। কারণ বারবার ঘুরে ফিরে আঙুল সেদিকে তাক করছে।
যাক রোগ কখন কিভাবে আসে বলে কয়ে আসে না। আল্লাহতালার ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হয়না। তিনি রোগ দিয়েছেন আবার তিনিই সুস্থতা দান করবেন।বর্তমানে সামান্য উপসর্গ ছাড়া আল্লাহর রহমতে ভাল আছি।
করোনা মারাত্মক ছোঁয়াচে ও সংক্রমণ রোগ। আক্রান্ত রোগী থেকে এটা দ্রুত ছড়ায়। স্বাভাবিক কারনে শরীরে জ্বর দেখা দেয়ার সাথে সাথেই অর্থাৎ কোভিড টেস্টের আগেই পৃথক কক্ষে অবস্থান নিয়েছি। রিপোর্ট পাওয়ার পর বাসার সবাই আতঙ্কগ্রস্ত। এদিকে শুরু হয়েছে গৃহকর্ত্রীর ঘেনঘেনানী ও ফ্যানফ্যানানী।
তার ভাষায় ‘কিছুই মানেনি। এই কয়েকদিন বিয়ে শাদী, বাড়িতে যাওয়া,জানাজা পরা,এগুলো না করলে হত না? তার হয়েছে।এখন আমাদের সবার লাগাবে। আরো কত কিছু।’ কয়েকটি বিয়ের মধ্যে যে তার পক্ষের তিনটি অনুষ্ঠান ছিল সেটা কিন্ত বলে না। নাতনিদের সামনে মজা করার জন্য দূর থেকে দু’ হাত প্রসারিত করে তাকে বললাম এসো একটু হাগ দি। এ কথা শুনার সাথে সাথে সে দ্রুত পিছিয়ে যায় তিন পা। এরপর ছোট নাতনিকে বললাম আসো তোমাকে একটু আদর করি। যেই বললাম তখনই সে ভোঁ দৌড় দিয়ে চলে যায় মায়ের রুমে। হ্যাঁ, এটাই বাস্তবতা। সবাইকে অবশ্যই সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে।
আর অসর্তকতার কারণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নিরলস প্রচেষ্টা সত্বেও এই মহামারীকে থামানো যাচ্ছে না। একটি গরীব দেশ হয়েও স্বল্প সময়ে বিনামূল্যে দেশের একটি বৃহৎ অংশকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা তার অসাধারণ দৃঢ়চেতা নেতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ। টিকা নিলে আর কোন সর্তকতা মানতে হবে না ভাবনাটাই ভুল। টিকা নিশ্চিতরূপে মৃত্যুর হার একেবারে নিম্ন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই বিশ্ব মহামারী থেকে মুক্তির জন্য যে কেউ বাইরে বের হলে অর্থাৎ হাটে বাজারে; শপিংমলে,অফিস আদালত, মসজিদ, মন্দির, গীর্জায় গেলে সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। বার বার হাত ধুতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।
প্রশ্ন জাগে কেন সময়ে সময়ে বিশ্বব্যাপী এধরনের মহামারী দেখা দেয়। এর বাহ্যিক বিভিন্ন ব্যাখ্যা থাকতে পারে। আধুনিক বিজ্ঞান এ সম্পর্কে নিত্য নতুন ধারণা দিতে পারে।
তবে পবিত্র কোরআনে এবং হাদিসে মহামারী ও বালা মুসিবতকে মানুষের গুনাহের ফসল বলা হয়েছে। মানুষের পাপের সীমানা ছাড়িয়ে গেলে মানুষকে সর্তক করার জন্য আল্লাহতালা তখনই এ ধরনের শাস্তি নাযিল করেন। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সুরাতে আল্লাহতালা বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তাদের পাপের শাস্তি প্রদানের কথা বলেছেন। সুরা বাকারার আয়াত ২৬ ও ২৪৩, সুরা রূম আয়াত ৪৩, সুরা আনাম আয়াত ৪২, ছাড়াও অনেক স্থানে মহামারীর বর্ণনা রয়েছে। সুরা আরাফের ১২৩ আয়াতে আল্লাহ বলেন, অতপর আমি তাদের প্লাবন, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ ও রক্ত দ্বারা ক্লিষ্ট করি। বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) বলেন, যখন কোন সমপ্রদায়ের মাঝে পাপাচার, অশ্লীলতা ও ব্যভিচার বেড়ে যায় তখন সেখানে মহামারী দেখা দেয়।
বতর্মান যুগে সমগ্র বিশ্ব অশ্লীলতা ও ব্যভিচারে কানায় কানায় ভর্তি। আমেরিকা, কানাডা ব্রাজিল ; বৃটেন, ইটালি জার্মানী, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে পাপাচারের ব্যাপ্তি এত বেশি যে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যার কারণেই হয়তো বা তাদের সমস্ত আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে হার মানিয়ে সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এর মধ্যে এ সমস্ত দেশে লক্ষ লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করেছেন। বর্তমানেও প্রতিদিন হাজারের উর্ধে লোক মারা যাচ্ছে। আর প্রতিদিন শনাক্তের সংখ্যা লাখের আশে পাশে থাকছে। সে তুলনায় খুবই ঘন বসতির দেশ হয়েও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের দেশের অবস্থান অনেক অনেক ভাল। এখানে আত্ম তুষ্টি নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আগেই বলেছি প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মহামারী বিস্তার রোধে যে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তা পুরোটাই মেনে চলতে হবে। নিজে টিকা দিতে হবে। অন্যকে টিকা নেয়ায় উৎসাহিত করতে হবে। পথে ঘাটে, হাটে, বাজারে মসজিদ, মন্দির যেখানেই যাই না কেন সবাইকে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। না হয় এ মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়া দুস্কর হবে।
লেখক : বাংলাদেশ রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমা আমার
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে