দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৫:০৯ পূর্বাহ্ণ

ডমিনো এফেক্ট

“আচ্ছা এই অডিটোরিয়ামের ভেতরে এতো এতো চেয়ার পেতে রেখেছে, অথচ বাইরে এই হল ঘরে বসার মতো একটা টুলও নাই। এখানে দু চারটা চেয়ার রাখতে পারতো, তাতে ঘুরতে আসা মানুষ একটু বসে রেস্ট নিতে পারত। ঠিক আছে, এখন এই সিঁড়িতে বসেই রেস্ট নেই একটু। লোকজন তো নাই। “দুপুত্র সমেত নীচে নামতে নামতে হেলেন আর লাজুকে উপরে উঠতে বারণ করতেই, ততোক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে আধাআধি ওঠা হেলেন ও কথাগুলো বলতে বলতে ধপ করে বসে পড়ল লালকার্পেট মোড়া ঐ সিঁড়িতেই।
সাথে সাথেই সেই যে বিখ্যাত থিওরির মানে, ডমিনো এফেক্ট থিউরির সার্থকভাবে নিজচক্ষের সামনে প্রমাণিত হতে দেখে বেশ আমোদিত হলাম। মানে বাইরে এই এলাকায় পা রেখে প্রথম হিম চ্যানেলের ঠাণ্ডায় নাকাল হওয়ার পর এতোক্ষণ এই গ্রেটহলাভ্যন্তরে ঘোরাঘুরি হাঁটাহাঁটিতে ক্লান্ত হেলেন সিঁড়ির উপর ধপ করে বসে পড়তেই, কোনরূপ অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে লাজুও বসে পড়ল সেই সিঁড়িতেই, যা নাকি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সর্বক্ষণ অত্যন্ত সজাগ থাকায়, সে করে না সাধারণত! একইসাথে ততোক্ষণে উপর থেকে তাদের ব্যর্থ অভিযান শেষে হুড়মুড় করে নেমে আসা দু পুত্রের ঘাড়েও কিনা ভর করলো সেই একই ডমিনো এফেক্টের আছর!
নিজের ভেতর থেকে সেই একই এফেক্টের তাড়নায় সাড়া দেওয়ার তাগিদ এলেও ,তা উপেক্ষা করে ভাবলাম বাহ এ তো চমৎকার একটি দৃশ্য! মানে হাত পা সব ছড়িয়ে দিয়ে গোটা পরিবার যে বসে আছে এ মুহূর্তে মোটামুটি জনবিরল গ্রেট হলের এই এলাকার লাল কার্পেট মোড়া সুপ্রশস্ত সিঁড়িতে, এর তো ছবি তুলতেই হয় । শুরু হল যে ভাবা সেই কাজ ।
ছবি তুলতে তুলতে আবছাভাবে মনে পড়ল, সম্ভবত আমাদের ভাষা আন্দোলনের বছর আর তার পরপরই এখনকার পৃথিবীর একমাত্র মোড়ল আমেরিকার, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ বা ন্যাশানাল সিকিউরিটি কাউন্সিল, এই ডমিনো এফেক্ট থিউরির অবতারণা করেছিল। তাদের মতে তাদের সেই উদ্দেশ্য ছিল অতি মহৎ। আর তা হল এ বিশ্বের এ এলাকায়, মানে চায়নার আশেপাশে যাকে বিশেষত ডাকা হয় ইন্দোচায়না নামে, সে এলকায় যাতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছড়িয়ে না পড়ে। তাদের সেই অতীব মহৎ উদ্দেশ্য সুসম্পন্ন করার জন্য এই ডমিনো এফেক্টের দোহাই দিয়ে তারা সে সময় ভিয়েতনামে সৈন্য পাঠিয়ে ২০ বছর ব্যাপী একটি যুদ্ধের সূচনা করেছিল! সে যুদ্ধে অবশ্য চায়না ভিয়েতনামের পক্ষেই ছিল। শুধু তাই না, এমনিতে চায়না আর রাশিয়া তৎকালীন এই দুই সমাজতান্ত্রিকদের দেশের সম্পর্ক এক্কেবারে সাপে নেউলে না হলেও বেশিরভাগ সময়েই আদায় কাঁচকলায় থাকতে দেখলেও, এই দুই পরাশক্তিই তখন গাঁটছড়া বেঁধে ভিয়েতনামের পাশেই দাঁড়িয়েছিল।
ছবি তোলা শেষে ডমিনো এফেক্টের এরকম চাক্ষুষ করার পরও, তদুপরি আজকের এই বৈশ্বিক পৃথিবীর একদেশের অর্থনীতি যখন অহরহই অন্য দেশের অর্থনীতির সমস্যার কারণে নিজেও সমস্যায় যে পতিত হয় তা জানা সত্ত্বেও, এই মুহূর্তে নিজে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসালাম না। কারণ এই থিওরির জন্মের সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, যাকে প্রকারান্তরে খলের ছলের অভাব হয় না বলেই মনে হয়, তার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতে মন সায় দিল না। সুতরাং নিজে আর পরিবারের আর সকলের সাথে সেই অবস্থান ধর্মঘট যোগ না দিয়ে, দিলাম ঘুরে হাঁটা। উদ্দেশ্য বেরিয়ে যাবার আগে যতোটা পারা যায় গ্রেটহলটা দেখে নেয়া। আবার কবে আসব এখানে বা আদৌ আসা হবে কি না তাতো জানি না।
“এই তুমি আবার যাচ্ছ কোথায়?” পেছন থেকে আসা স্ত্রীর অনিবার্য প্রশ্নের জবাবে, ঘাড় ঘুরিয়ে আশ্বস্ত করলাম, নাহ যাচ্ছি না কোন তেপান্তরে বা সাত সমুদ্দুর পেরিয়ে, সামনের ডান দিকের করিডোরটা কোন দিকে গেছে, আর ওখানে কি আছে তা দেখে এসেই অচিরেই হাজিরা দেব। বেশিক্ষণ আর থাকবো না এখানে। বাইরে ঢের কিছু দেখার বাকী আছে, বলতে বলতে পকেট থেকে ফোন বের করে যখন দেখলাম আর কিছুক্ষণের মধ্যে বেজে যাবে বারোটা, তাতে নিজের অজান্তেই বেড়ে গেল সামনের দিকে হাঁটার গতি। কারণ এখানে অতিরিক্ত সময়ক্ষয় করলে আজকের দিনের যে পরিকল্পনা আছে মাথায় , সেটারই বারোটা বেজে যাবে যে!
খুব লম্বা নয় এই করিডোরটা। বেশ দ্রুতই সেটি পেরিয়ে এসে পৌঁছুলাম এদিকটার আরকেটা হলঘরে । চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারছি এই হলঘরের দু দিকে সোনালি রঙয়ের কারুকার্যময় বন্ধ দরজা দেখে বুঝলাম, দরজার ওপাশে আছে নানান সাইজের মিটিং রুম। আর দরজা যেহেতু সেগুলোর বন্ধ এখন, অতএব ভেতরটা দেখার তো অবকাশ নেই। দেখা যাক তাহলে এর বহিরাঙ্গই!
চোখ গেল বাঁয়ের দেয়ালে। বাহ বেশ বড় একটা শিল্পকর্ম দেখা যাচ্ছে তো, লাগানো আছে যা দেয়ালে! আচ্ছা কি নামে ডাকা হয় এ ধরনের শিল্পকর্মকে? তা তো জানি না। কাছে থেকে ওটা খুঁটিয়ে দেখার জন্য এগুতে এগুতে ভাবছি। প্রায় ২০/২২ ফুট দীর্ঘ আর উচ্চতায় হবে ছয় সাত ফুট, দেয়ালে লাগানো পিতলের তৈরি এই শিল্পকর্মটিতে, তিন ভঙ্গিতে তিনটা ছুটন্ত ঘোড়াতে আছেন তিনজন নারী। প্রত্যেকেরই হাত ছুটন্ত ঘোড়ার রাশে থাকার বদলে, হাতে তাদের ধরা আছে নানান বস্তু , যেগুলোর কোনটা কি বুঝতে পারছি না। তবে মাঝের নারী দুই হাত উপরে তুলে যা ধরে রেখেছে, সেটিকে একটা পিতলা ব্যানার জাতীয় কিছু মনে হচ্ছে। আরো মজার ঘটনা হচ্ছে সামনের ঘোড়াসিন নারীটি ছুটন্ত ঘোড়ার উপর বসে সামনে তাকিয়ে থাকলেও, মাঝের জন মানে ব্যানার ধরা নারী ঘোড়ার পিঠের উপর অনেকটা হাঁটু গেড়ে বসে তাকিয়ে আছে সোজা আমার চোখে চোখে। পেছনের ঘোড়ায় যে নারী, সেও মনে হচ্ছে ঘোড়া পিঠে হাঁটু গেড়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনের দিকে চোখ নিবদ্ধ করে, গতির কারণে লম্বা চুল যার উড়ছে বাতাসে পেছনের দিকে। কি যে বোঝাতে চাচ্ছেন শিল্পী এই শিল্পকর্মে তা ঠিক ঠাহর করতে পারছে না, এসব ব্যাপারে গণ্ডমূর্খ মনন আমার! অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না, যখন এটিকে দেখতে বড়ই সুন্দর লাগছে।
আরো মনোযোগ দিতেই, নারী মূর্তিগুলোর গুরু নিতম্ব, সরু কোমর, আর ততোটা না হলেও মোটামুটি উন্নত বক্ষের যে আভাস দেখতে পেলাম, তাতে ছবিতে দেখা খাজুরাহ মন্দিরের দেয়ালে গড়া নারী মূর্তি গুলোর কথাই মনে পড়ছে। আর গোটা শিল্পকর্মটিতে ছুটন্ত ঘোড়ার দুরন্ত গতির একটা বিচ্ছুরণ দেখতে যে পাচ্ছি তা নিশ্চিত, হই না কেন যতই এবিষয়ে আকাট মূর্খ। এই শিল্পকর্ম নিয়ে কিছুমাত্র আগে জেগে উঠা অধমের শিল্পতৃষ্ণা মিটে যাবার পর সামনের দিকে পা ফেললাম, কারণ ঐদিকে ডানে আরেকটা করিডোর দেখতে পাচ্ছি। সে করিডোর ধরে হেঁটে সামনে গিয়ে আরেকটা হলঘরের মতো জায়গায় পৌঁছেই কেন যেন মনে হল এখানে এসেছিলাম সবাই একটু আগে। কেন এমন মনে হল তা নির্ণয় করার জন্য গোটা হলঘরটায় একবার চোখ বোলাতেই দেখা মিলল সেই ইউরোপিয়ায়ন নারীর, মানে নারী মূর্তিটির! তাতে প্রমাণিত হল, এইমাত্র মনে হওয়াটা অকারণ কোন মনে হওয়া নয়। একই সাথে অদূরে একটা কক্ষের খোলা দরজার পাশে ম্যাকাও কথাটা লেখা দেখে আরো নিশ্চিত হওয়া গেল, হ্যাঁ এসেছিলাম সবাই এখানটায় এই গ্রেট হলে ঢোকার কিছুক্ষণ পর। সাথে সাথে ঐ নারীমূর্তিটির ইউরোপিয়ান চেহারা আর ফিগারের একটা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যাও দাঁড়িয়ে গেল, নিজের কাছে। যা হল, বহুকাল পর্তুগীজ কলোনি থাকার কারণেই হয়তো, ম্যাকাও দ্বীপবাসীদের শিল্পকর্মে ঐ ইউরোপিয়ান ধাঁচের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
আচ্ছা, আমরা কি তাহলে ঘুরে ফিরে একই জায়গায় ঘুরছিলাম না কি এতোক্ষণ? কারণ খুব তো পিছু ফেলে আসিনি পরিবারকে সেই গ্রেট হলের গ্রেট অডিটোরিয়ামের সিঁড়িতে বসিয়ে রেখে। তখন যন এই এলাকা পেরিয়েছিলাম, গিয়েছিলাম তাহলে কোন দিকের কোন করিডোর দিয়ে? ওদের কে বসিয়ে রেখে যে চলে এলাম এদিকটায়, ফিরে যেতে পারব তো আবার দ্রুত? আজন্ম দিককানা আমি এখনও বুঝতেই পারছি না এখানকার পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ। ওদের খুঁজে বের করতে যদি দেরী হয় তবে তো অযথা সময় নষ্ট হবে! এখনি ফেরা উচিৎ। যদিও মনে করতে পারছি না যে আসার সময় ক’বার কোনদিকে বাঁক নিয়ে, কোন করিডোর দিয়ে হেঁটে এখানে এসে পৌঁছেছিলাম? নাহ, আর দেরী করা ঠিক হবে না। কপাল ভাল যে ঐ পিতলা শিল্পকর্মটি একটা ল্যান্ডমার্ক, এক্ষুণি ঐটির কাছে ফিরে গেলে সহজেই ফিরতে পারবো কক্ষ কক্ষে, করিডোরে করিডোরে, হলঘরে হলঘরে মিলে তৈরি হওয়া এখানকার গোলক ধাঁধা পেরিয়ে।
আশার কথা, পথ হারিয়ে ফেলার সম্ভাব্য আশংকাকে অমূলক প্রমাণ করে দ্রুত পরিবারের কাছে ফিরে আসার পথ খুঁজে পেলাম সহজেই। ফিরে আসার করিডোর ধরে সেই সিঁড়ির দিকে এগুতেই করিডোরের শেষ মাথায় আসতেই বুঝলাম, সবাই এতোক্ষণ এই দিকেই চোখ রেখে বসেছিল আমারই ফেরার অধির অপেক্ষায়। করিডোরের মুখে এ শর্মার দেখা মিলতেই দুই পুত্র হৈ চৈ করে এগিয়ে এলো।
‘আচ্ছা বাবা, স্টেডিয়ামের মতো বড় ঐ হল ঘরটাতে কোন কনসার্ট হয় নাকি?’ জিজ্ঞাসা দীপ্রর।
তা হয় কি না জানি না। অবশ্য চীনে কখনও কোথাও কনসার্টের আয়োজন হয়েছে এমন তো শুনিনি । তবে ঐ হল ঘরে বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধান বিশেষত এরা যাদেরকে বড় দেশ মনে করে, সেসব দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের সম্মানে মিটিং যেমন হয়, তেমনি ডিনার পার্টিও হয় জানি। আবার এদের কোন জাতীয় নেতা মারা গেলে তার শেষকৃত্যানুষ্ঠান মানে ফিউনারেলও হয়, হাজার দশেক মানুষ বসতে পারা ঐ হল ঘরে। এসব বলতে বলতে তখনও সিঁড়িতে বসে থাকা দুই নারী সদস্যের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে তাড়া দিলাম গাত্রোত্থানের।
অতপর পুরোদল একাট্টা হতেই, উল্টাপাল্টা নানান করিডোর ধরে হেঁটে বের হতে গিয়ে অতিরিক্ত সময় নষ্ট না করার মানসে চায়নিজের সাথে ছোট্ট করে হলেও ইংরেজি “এক্সিট” লেখা দেখে দেখে এগুতে এগুতে ঠিক করলাম, যে বাইরে বেরুবো সামনের দিক দিয়ে। কারণ ঢোকার সময় কোন দিক দিয়ে যে ঢুকেছিলাম মনে নাই। সামনের দিকে দিয়েও যদি ঢুকে থাকি, তবে হিমের ঝাপটা নাকানি চুবানি খাওয়া সবাইকে নিয়ে দ্রুত এর ভেতরে ঢোকার জন্য এতোটাই উদগ্রীব ছিলাম যে, এই গ্রেটহলের চেহারা যে কেমন, মানে সামনের অংশটা কেমন তা মনে করতে পারছি না। অতএব বের হবার পর হিমে যতই নাকাল হই না কেন, দেখতে হবে ভাল করে এর চেহারা মোবারক।
এক্সিট সাইনের উপর নজর রেখে এখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার যে পরিকল্পনা করেছিলাম মনে মনে, তা দেখলাম কাজ করেছে ভাল। দ্রুতই চলে এলাম বাইরে বেরুবার দরজায়। কিন্তু এসেই বাইরে পা রাখার আগে, একটু থেমে সাবধানতা হিসাবে সবাইকে মনে করিয়ে দিলাম সবাই যেন ঠিকঠাক মতো, মাথা কান ঢেকে নেয় যার যা কিছু আছে গায়ে তা দিয়ে। আর অতি অবশ্যই সবাই যেন পরে নেয় হাতে হাত মোজা, যদিও নিজেরই হাত থাকবে নাঙ্গা, কারণ এগুলোতো দিয়েছি অভ্রকে। বাইরে বেরিয়ে হিমসাগরে ঝাপিয়ে পড়ে সামনের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে, সবার মুখ থেকে, বাঁয়ের খোলা তিয়েন আন মেন স্কয়ার থেকে মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো হু হু করে ভেসে আসা আমাদের দেশে যাকে বলে উত্তুরে হাওয়া, সেই হাওয়ার ঝাপটার তীব্র প্রতিবাদ করতে থাকলেও, নামছি নিজে চুপচাপ দাঁতমুখ খিঁচে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধতায়েফ- নবীজির রক্তে সিক্ত মরু প্রান্তর
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম টিভির ২৪ ঘণ্টা সম্প্রচার এবং একজন কীর্তিমান হাছান মাহমুদ